মানুষ বা কোনো প্রাণীর ত্রিমাত্রিক প্রতিকৃতিকে সাধারণত আমরা মূর্তি বলি। এসব মূর্তি টেবিলের ওপরে রাখা ছোট হাতি থেকে খোলা চত্বরে বেদির ওপরে রাখা বিশাল আকৃতির মাও সে তুঙও হতে পারে। আমার এক বন্ধু কবিগুরুর ছোট আবক্ষমূর্তি পেপার ওয়েট হিসেবে ব্যবহার করে। খেলনা হিসেবে রঙিন বাঘ-সিংহ বা ঘোড়া শিশুদের প্রিয় বস্তু।
ঐতিহাসিক বিখ্যাত ব্যক্তিদের আবক্ষমূর্তি, সক্রেটিস, প্লেটো, জুলিয়াস সিজার- এসব অনেকে সংগ্রহ করে সাজিয়ে রাখেন। মানুষ, কুকুর বা পাখির আকৃতির রোবোটও এক ধরনের মূর্তি, যে সব রোবোট গৃহকর্মে সহায়তা বা হাসপাতালে সেবা করবে বলে তৈরি করা হয়। সেগুলোর চেহারা বা আকৃতি মানুষের মতো হলে আমরা সাচ্ছন্দ্যবোধ করি। সিনেমার মডেল হিসেবে বিশাল ডাইনোসর বা অতিকায় কোনো প্রাণীর মূর্তিও রয়েছে। মূর্তি তৈরিতে যে কোনো উপযুক্ত উপাদান ব্যবহার করা যায়, উদ্দেশ্য প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলা। বড় বড় মূর্তি তৈরিতে পাথর, কনক্রিট, লোহা, তামা ইত্যাদি স্থায়ী উপাদান ব্যবহার করা হয়। অনেক দেশে মোমের মূর্তির মিউজিয়াম রয়েছে। লন্ডনের ‘মাদাম তুসো’ মিউজিয়াম জগৎ বিখ্যাত। সারা দুনিয়ার বিখ্যাত মানুষের মূর্তি রয়েছে সেখানে। একদম অবিকল সেই মানুষটির মতো তবে নিশ্চল। আইনস্টাইনের সঙ্গে যে কেউ ছবি তুলে নিতে পারবে! মূর্তি হলেই সেটা পূজনীয় নয়, পূজার জন্য চাই ‘প্রতিমা’ বা ইংরেজিতে বললে ‘আইডল’। এর মূলে আছে ভক্তি, যাকে ভক্তি করা, তিনি যদি বাস্তবে সম্মুখে না থাকেন তাহলে তার ছবি বা প্রতিকৃতি স্মৃতিবহ হয়ে দাঁড়ায়। পিতা-মাতার ছবি সংরক্ষণ সবাই করতে চায়। সন্তানের ছোট কালের জামাটি মা সযত্নে গুছিয়ে রাখেন। এই অনুপস্থিতকে স্মরণ করার প্রক্রিয়াটি যখন ব্যক্তিগত পর্যায় ছেড়ে সমাজের কোনো নিয়মের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট হয় তখন আনুষ্ঠানিক পূজা কথাটা এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। তখন শ্রদ্ধার স্থান দখল করতে পারে প্রার্থনা, আর ‘প্রতিমা’ হয়ে পড়ে বিমূর্ত কোনো আইডিয়ার রূপ, সরাসরি কোনো ব্যক্তির প্রতিকৃতি নয়। যুগে যুগে মানুষ আকাশ, বাতাস, সূর্য, বিশাল বৃক্ষ, বিভিন্ন প্রাণীকে পূজা করেছে, তাদের প্রতীক তৈরি করে পূজার উপকরণ সাজিয়েছে। শিবলিঙ্গ কোনো প্রাণীর মূর্তি নয়, পশু-পালক কৃষিজীবী সমাজের প্রজননের প্রতীক। নটরাজ মূর্তি কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতিকৃতি নয়, দুর্গা মূর্তি কোনো বাস্তব নারীর নয়, কতগুলো বিশ্বাস বা ধারণা থেকে এই প্রতীকগুলো এসেছে।