কাগজের গোলাপ, যেমনটি তেমনই আছে সব সময়: কতক্ষণ আর ভালো লাগে ? আসল গোলাপ কেবলই চলেছে সমস্ত বিশ্বের সঙ্গে সম্বন্ধের পর সম্বন্ধ রচনা ক’রে। সেই চলার ছন্দই তার জীবন। সেই বহুরূপী জীবনটি ঠিকমত দেখা গেলে সে আর কিছুতে ফুরোয় না ; কাজেই কিছুতেই ফুরোয় না আর্টিস্টের ভালো লাগা। অবশ্য, কাগজের গোলাপও ভালো লাগতে পারে বিশেষ পারিপার্শ্বিকের মধ্যে, বিশেষ স্মৃতির সঙ্গে জড়িত হয়ে। তখন সেও শিল্পের বিষয় হয়ে উঠবে।
আসল কথা, যে জিনিস আঁকবে সেটি ভালো লাগা চাই। সে যেন তোমার মনোহরণ করে। তখন সেই ভালো লাগা তূলির ডগে আপনি ফুটে উঠবে। তা হলেই সত্যকারের ছবি হবে। ছবি আঁকার এই সব চেয়ে বড়ো, সব চেয়ে গূঢ় কৌশল।
মনে রস না পেলে, ভালো না লাগলে, ভালো লাগা দিনে দিনে বাড়তে না থাকলে, সেই ভালো লাগার প্রেরণাতেই কাজ না করলে, শুধু কলাকৌশল আয়ত্ত করবার চেষ্টা নিষ্ফল। . . . একবার আমার এস্রাজ বাজাতে শখ হয়ে-ছিল ; নিয়মিত সা-রে-গা-মা সাধতে লাগলাম। কয়েকটা গৎও শিখেছিলাম। কিন্তু, যেই বাজানো বন্ধ করলাম ছ মাসের শিক্ষা নি:শেষে ভুলতে ছ দিনও লাগল না আমার। কারণ, সংগীতের ব্যাকরণই শুধু ‘মুখস্থ’ করেছিলাম, রসের ভিতর প্রবেশ করি নি।
অনুরাগ চাই, ধৈর্যও চাই ; সাধনার সফলতা চাই। শিল্পচর্চা একটা সাধনাই, শখ তো নয়। . . . নইলে অনেকে আছে, সেই আমেরিকান সাহেবের মতো করে। সে ভদ্রলোক সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এসেছিল মহাতড়বাজির আশ্রমে তাঁর সঙ্গে দেখা করবে ব’লে।আশ্রমের লোক বললে, ‘এখন তাঁর সময় নেই ; তুমি দু-এক দিন থেকে যাও।’ কিন্তু, সাহেব কী করে থাকে! কোনটার পর কী করবে সব তার আগে থেকে ছক কাটা আছে, পরবর্তী ট্রেনটা তার ধরাই চাই। কাজেই মহাতড়বাজির সঙ্গে দেখা না করেই চলে গেল। একে বলে মূঢ়তা। আর, দেখা হলেই বা কী লাভ হত কে জানে ; হয়তো নামসংগ্রহের খাতায় আর-একটা স্বাক্ষর পড়বে- এর থেকে বেশি তার আকাংক্ষা ছিল না।
নিত্য অভ্যাস চাই। প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করা চাই। ভয় আর লোভ বর্জনীয়। শিল্পী যেটুকু অনুভব করবে শুধু সেটুকুই তার প্রকাশ করা উচিত।কবির কখনো কখনো এরকম হয়- অবান্তর একটা শব্দের মোহ বা একটা উপমার মোহ বা একটা আইডিয়ার মোহ তাকে পেয়ে বসল।তেমনি শিল্পী হয়তো দেখলে গাছের তলায় একটা লোক বসে আছে ; ভালো লাগল ; তার পর ছবি আঁকবার সময় একটা কুঁড়েঘর তার সঙ্গে জুড়ে দিলে বা গাছের পাতাগুলি ধরে ধরে আঁকলে বা আকাশের মেঘে রঙের বাহার দেখাতে গেল : সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। ফলে ছবি নষ্ট হল। একেই বলে লোভ বা মোহ। পূর্বের কল্পনার সঙ্গে নতুন কল্পনার জোড় মিলল না ব’লেই ছবি নষ্ট হল।
পরম্পরাগত আদর্শ দরকার? যদি সমস্ত পরম্পরাই কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনায় লোপ পায়, শিল্পকলা চিরদিনের জন্য লুপ্ত হবে কি? শিল্পের কারণ আদিকারণে। যে আনন্দে সৌরজগতের আর পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে, সেই আনন্দেই শিল্পী ছবি আঁকে। সুতরাং মহাপ্রলয়ের পর পুনরায় যেমন সৃষ্টি হবে, পুনরায় মানুষের মতো ধীমান জীবের জন্ম হবে, অমনি আর্টেরও শুরু হবে।তবে পরম্পরাগত শিল্প ব্যাবসার মূলধনের মতো। তাকে খাটিয়ে অল্পায়াসে আরও অনেক ঐশ্বর্য লাভ করা সম্ভব হয়।
যে আর্টিস্ট্, সর্বত্র সকলেই তার বন্ধু, সে কখনো নি:সঙ্গ হয় না। তোমায় ভালো লাগছে। তুমি চলে গেলে গাছটা ভালো লাগছে। গাছও নেই তো এই দরজাটাই ভালো লাগছে। ভালো লাগে কেন? বলা বড়ো কঠিন। তবে, আবেগপ্রবণ ভালো লাগা বা নিজের জিনিস ব’লে যে ভালো লাগা তার গভীরতা কম। কৌতূহলে ভালো লাগে, সেও অচিরস্থায়ী, আর- একরকম ভালো লাগা আছে, তা গভীর একাতড়বানুভূতি। কোনো দৃশ্য এত ভালো লাগল যে মনে হল তার মাঝখানে ম’রেও সুখ আছে। . . . সকলেই গভীর আশ্বাস দিচ্ছে ; সকলেই যে বন্ধু। একটি বস্তুকে যে পরিমাণ ভালো লাগল সেই পরিমাণেই মরবার ভয় ঘুছে গেল। কারণ, জানলাম- আমি মরে গেলেও এ তো রইল! সে তো আমারই থাকা!
ছবি দু-রকম। এক, শিল্পী যে ছবি করেছে ; আর, শিল্পী যে ছবি হয়েছে। ভালো ছবিতে আছে- বিষয়, পদ্ধতি এবং শিল্পী স্বয়ং।
ছবিতে রঙ দেওয়া সম্পর্কে বোঝাবার কথা এই। – ধানখেতের সবুজ তোমার এত ভালো লাগা চাই যে, তুমি ঐ সবুজ হয়ে গেলে।তোমার সত্তার অন্তহীন পরিচয়ে ঐ পরিচয়টুকু যুক্ত হল। তার পর ছবি আঁকতে বসলে কেমন ভাবে সবুজ লাগাতে হবে, তার সঙ্গে অন্য কোন রঙটি কোথায় মানাবে, অন্তরঙ্গ অনুভব থেকেই অনায়াসে তুমি বুঝতে পারবে ; তূলির ডগে যেন আপনি এসে যাবে। আর-এক কথা, আলংকারিক চিত্রপদ্ধতিতে শিল্পী ধান-খেতের সবুজ আকাশেও দিতে পারে, মেঘেও দিতে পারে, পাহাড়েও দিতে পারে, তাতে কোনো দোষ হয় না। কারণ, প্রকৃতির কাছে শিল্পী শিখে নেয় রঙে রঙে সূক্ষ্ম যে সম্বন্ধ বা সংগতি, গভীর যে আত্মীয়তা, সেইটেই ; নইলে সে স্বাধীন, স্বতন্ত্র। এই রীতি প্রাচীন রাজপুত মোগল বা পারসিক চিত্রে দেখা যায়। রচনার তাতে কিছুমাত্র ন্যূনতা না ঘটে বরং বিশেষ উৎকর্ষই হয়েছে।
যে পাহাড় দেখে নি, সে মেঘ আঁকতে জোর পাবে না। স্থিরতার ধারণা না থাকলে চঞ্চলতার ধারণা হয় না। ইন্দ্রিয়ের চাঞ্চল্যে যে রস আর চিত্তের ধ্যান মগ্নতায় যে রস, দুই-ই আর্টিস্টের জানা প্রয়োজন। আর্টিস্টের একদেশ- দর্শী হলে চলে না। তার হওয়া চাই সর্বদর্শী ও নির্লিপ্ত।
গল্প আছে : একজন বলেছিল নবোদগত যবের শিষ দেখতে কেমন, না, যেন ডানাছেঁড়া প্রজাপতি। কিন্তু যথার্থ প্রতিভাসম্পন্ন এক কবি বললেন : শিষটি দেখে মনে হচ্ছে দুখানা ডানা হলেই ও প্রজাপ্রতির মতো উড়ে যাবে। একই উপমা, কিন্তু দেখবার ভঙ্গিতে আর বলবার কৌশলে কী অসীম তফাত! ছিল প্রাণহীন, হল জীবন্ত।
প্রকৃতির দুটো ধারা আছে। একটাতে দেখি রূপের সঙ্গে রূপের অমিল, ফলে বৈচিত্র্য। এ হল স্থূল। আর-একটাতে দেখি এই সমস্ত গরমিল বা বিচিত্রতা যে অন্তর্নিহিত নিয়ম থেকে নিয়ত উদ্ভূত হচ্ছে তারই ঐক্য। বৈসাদৃশ্যের ও বৈচিত্রের অন্তরে ঐক্য, এই হল প্রকৃতি -বিশ্বপ্রকৃতিও বটে আর তার ভিতরের মানবপ্রকৃতিও বটে।
প্রথমে আকৃষ্ট হয় শিল্পী বাইরের রূপে। তার পর রূপের সঙ্গে রূপের সম্পর্কে। তার পর যে ভাব ও যে রস প্রত্যেক রূপকে প্রত্যেক মুহূর্তে রূপায়িত ও সঞ্জীবিত করে চলেছে সেই জিনিসটিতে। এই ভাবে শিল্পী যত এগিয়ে যায় ততই তার সৃষ্টিক্ষমতা বাড়ে, ততই ক্রমপ্রসারিত হয় তার সৃষ্টিক্ষেত্র।বিশেষ শিল্পের বিশেষ ভাষা বা কন্ভেন্শন্ (convention) জিনিসটা বিষয়কে সহজ করা নয়, সম্পূর্ণ করা। জ্ঞানের ও সাধনার বিশেষ পরিণতি থেকেই তার উদ্ভব। সর্বত্র যে নিখুঁত ভাব আর নিখুঁত রূপের দিকে উন্মুখ হয়ে চলেছে প্রকৃতির সকল আবেগ ও ইচ্ছা, অথচ ঝড় রৌদ্র শিলাবৃষ্টি আছে- কীট পশু মানবের শত উপদ্রব আছে -জড় উপাদানের জড়ত্বের বাধা আছে -তাই ঠিকমত পৌঁচচ্ছে না, দৃষ্টি দিয়ে, প্রীতি দিয়ে সেইটিকেই দেখা ও দেখানোতে তার সার্থকতা।
চীনা চিত্রকলার এবং ভারতীয় ভাস্কর্যের তুলনা নেই। কারণ ভারতীয়েরা বিষয়কে চারি দিক থেকে (in the round) দেখেছে, আর সে দেখা প্রকাশ করবার ঠিক ক্ষেত্র হল ভাস্কর্য, স্থাপত্য। কিন্তু, চিত্রের জমি দৈর্ঘ ও প্রস্থ এই দুই আয়তনের, তাতে বিশেষ দ্রষ্টব্য হল দূরত্ব বা স্পেস ; এই দুই আয়তনের ক্ষেত্রে দূরত্বের রসসৃষ্টি চীনাদের নিসর্গদৃশ্যের চিত্রে যেমন সম্ভব হয়েছে অন্যত্র তা কেমন করে হবে? চীনাদের ছবি-আঁকা তাদের লেখারই মতো। সেজন্যও চিত্রের সমতল ক্ষেত্র তাদের সৃষ্টির পক্ষে খুব অনুকূল হয়েছে।
ওকাকুরা বলেছিলেন: স্বভাব (Nature), পরম্পরা (Tradition) ও স্বকীয়তা (originality) এই তিন নিয়ে হয় সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ আর্ট্।স্বভাবজ্ঞান না থাকলে আর্ট্ হয় দুর্বল ও কৃত্রিম। ঐতিহ্যে অধিকার না থাকলে হয় স্থাণু ও কাঁচা। আর, শিল্পীর নিজস্ব দান যদি কিছু না থাকে তবে অন্য সব থাকলেও শিল্প ঠিক প্রাণ পায় না। অপর পক্ষে, শুধু স্বভাবসম্মত হলে হয় নকল ; শুধু পরম্পরায় দখল থাকলে হয় কারিগরি ; আর, শুধু মৌলিকতা টুকু সম্বল করে মানুষ উন্মত্তের মতো আচরণ করে।
বিভিন্ন বয়সে মানুষের জীবন বিভিন্ন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে চলে। শৈশবে মা ; কৈশোরে বন্ধুবান্ধব ; যৌবনে স্ত্রী বা প্রেয়সী ; পরিণত বয়সে আর-কিছু। সেই কেন্দ্রটি থাকলে জীবনের স্বাদ থাকে, সুখ থাকে, উৎসাহ থাকে। কেন্দ্রটি হারালে সবই হয় বিস্বাদ ; তাই কাজেরও কোনো প্রেরণা থাকে না। কাজেই যে যত স্থায়ী জিনিসকে কেন্দ্র ক’রে জীবন গড়ে তার জীবনের সুখশান্তি ও কর্মের প্রেরণা তত অফুরন্ত হয়। এরকম স্থায়ী জিনিস বলা চলে -এই বিশ্বপ্রকৃতি। এ কথা জীবনেও সত্য, শিল্পেও সত্য।
নিত্যনিয়মিত সাধনার ফলে অবশেষে মনটি হবে পরিপূর্ণ কলসের মতো। পরিপূর্ণ কলস একটু হেলিয়ে দিলেই যেমন জল ছলকে পড়ে, তেমনি কোনো কারণে মন একটু নাড়া পেলেই মনের অক্ষয় রসানুভূতি রূপানুভূতি ছলকে পড়ে হবে -ছবি, মূর্তি, নৃত্য, কবিতা, গান।অনেক আশা উদ্যম নিয়ে আরম্ভ করে আজ ভাবছ কিছুই হল না। কিন্তু, আসলে হয়তো হবার আর দেরি নেই। ধরো, তুমি পুরীর মন্দিরে চলেছ। সকালবেলা অনেক দূরে দেখতে পেলে গাছপালার মাথা ছাড়িয়ে মন্দিরের চূড়া। উৎসাহের সঙ্গে হাঁটতে লাগলে। যত বেলা গেল রৌদ্র আর বালির উত্তাপ বাড়তে লাগল, ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর হলে, কখন্ মন্দিরের চূড়াও নিকট- বর্তী লোকালয়ের বাড়িঘর গাছপালায় ঢাকা পড়ল। একেবারে দিশা হারালে। চৌমাথায় প’ড়ে কোন্ দিকে যে যাবে বুঝতে পারলে না। তবু হয়তো প্রত্যেক পদে একটু একটু এগিয়েই এসেছ তুমি ; যখন একেবারেই হতাশ হয়েছ তখন রাস্তার আর-একটা বাঁক পেরোলেই বা সমুখের আর একটা গাছ ছাড়ালেই দেখবে একেবারে মন্দিরের খোলা দরোজা।
শিল্পীকে সদা সচেতন হতে হবে। ভাগীরথীতে মৃণাল-সমেত পদ্মফুল পদ্মপাতা ভেসে যাচ্ছে ঢেউয়ের তালে তালে উঠে প’ড়ে। মাছও খেলা করছে সেই জলে ; ইচ্ছামত অনুকূলে বা প্রতিকূলে যাচ্ছে স্রোতের। দুয়ের প্রভেদ আছে। সেই প্রভেদ হল সাধারণ মানুষে আর শিল্পীতে। রিয়েলিটি কী, কুমারস্বামী একটি সংস্কৃত বচন উদধৃত করে ব্যাখ্যা করেছেন। যেখানে অভাববোধ থাকে না। অর্থাৎ, আর্টের ক্ষেত্রে বলা যায়, চিত্রে এবং চিত্রের বিষয়বস্তুতে মিল না থাকলেও যখন অভাববোধ হয় না। চীনেরাও এই কথাই বলেছেন। পাকা আর্টিস্টের কাজ কেমন? না, আশ্চর্যভাবে বস্তুর প্রতীতি হয় অথচ কাছে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় -কালির পোঁচ, তূলির ছাপ, তা ছাড়া কিছুই নয়।চীনেরা এইজন্যই বলেন টেক্ নিক্ সব আর টেক্ নিক্ কিছুই নয়। মনই আঁকে। মন যখন যেতে চায় তখন টেনে-হিঁচড়ে কোথা দিয়ে কোথায় নিয়ে যায় তার কিছু ঠিক-ঠিকানা নেই। পাকা আটিস্টের টেক্ নিক্ বা ঠিক টেক্ নিক্ হল, তন্ত্রের একটি শ্লোকে যেমন বলেছে পাখির ওড়ার মতো, এক গাছ থেকে আর-এক গাছে গিয়ে বসল -বাতাসে পথের কোনো চিহ্ন রইল না।
কারও কারও এইটি হয়েছে, যে জিনিসই আঁকুন তাতে প্রবেশ করতে পারেন। প্রবেশ করা কিরকম? তোমার হাত ধ’রে এইখানে এইভাবে রেখে দিলাম, আবার তুলে নিয়ে অন্য স্থানে অন্য ভঙ্গিতে রাখা গেল, তোমায় ধরে ওঠালাম বা বসালাম -এই এক। আর এক হল- তোমার ভিতরেই যদি আমি প্রবেশ করতে পারি তা হলে তোমার হাত নিয়ে পা নিয়ে আমি যা খুশি করতে পারি ; উঠতে বসতে দৌড়তে নাচতে কিছুতেই কোনো আয়াস লাগে না, বাধা হয় না ; সেটা সহজও হয়, সত্যও হয়।
ছোটো ছেলের আঁকা ছবিও খুব সুন্দর হয় ; আশ্চর্য ছন্দ, আশ্চর্য রঙ তাতে থাকে। তবুও ছোটো ছেলের কাজের নকল করে আর্টিস্ট্ হওয়া যায় না। ছোটো ছেলের কাজের গুণ বড়ো আর্টিস্টের কাজে আসে, যখন তিনি ‘জ্ঞানে’র চরমে পৌছোন। কারণ, বড়ো মানুষ ছোট ছেলের অনুকরণ করলে হয় ন্যাকামি, অথচ বড়ো মানুষও ছোট ছেলে হয়ে থাকে জানি- তাঁকেই আমরা বলি প্রতিভাবান্ বা পরমহংস।
এক জাপানি কবিতায় কবি বলেছেন তাঁর চেরী ফুল হতে ইচ্ছা হয়। মানুষ তো চেরীফুলের চেয়ে অনেক বড়ো, অনেক মহান্, তবে এরকম বিপরীত ইচ্ছা কেন? তার মানে আছে। মানুষ মানুষ ব’লেই এমন ইচ্ছা তার হয়েছে, চেরীফুলের ইচ্ছা হয় না মানুষ বা আরকিছু হতে। বিচিত্র দিকে বিচিত্র লক্ষ্যে ধী ও অনুভূতি প্রসারিত হয় মানুষের : মানুষের চেতনা জগতের সর্বত্রই প্রবেশ করতে চায়।আর-এক অর্থ এই ধরা যেতে পারে- মানুষ মানুষই থাকাতে চায় অথচ চেরীফুলও হতে চায়- মানুষের সত্তার যে অনন্ত জটিলতা, অশেষ মিশ্রণ, অপরিসীম ঐশ্বর্য, সব নিয়েই ; সবকে জয় ক’রেই ফোটা চেরীফুলের সহজ শোভা সে পেতে চায়।ভারতীয় ভাস্কর্য অনেক বড়ো জিনিস। ওতে যা করেছে আর-কোনো দেশে আর-কোনো যুগে তা করে নি। একটা নটরাজমূর্তি, একটা বুদ্ধমূর্তি বা ত্রিমূর্তি, যতক্ষণ আছে ততক্ষণ সংস্কৃতির জগতে ভারতবাসী মাথা উঁচু করে থাকতে পারে- ভারতশিল্প বা ভারতীয় সভ্যতা এরই মধ্যে সম্পূর্ণ আছে। ওতে বিমূর্ত আইডিয়াকে মূর্তি দিয়েছে। স্বভাবের এটা- সেটার নানারকম প্রতিরূপ অনেকে অনেক দিয়েছে।কিন্তু, একটা করুণা বা মৈত্রী বা অন্য কোনো আইডিয়ার মূর্তি সমস্ত শিল্পজগতে দুর্লভ। চিহ্ন বা প্রতীক রচনা করে নি, প্রতিমা সৃষ্টি করেছে ; অর্থাৎ, আইডিয়ার ‘বাচন’ ওখানে কষ্টকৃত বা কল্পনাকৃত নয়, রসিকের কাছে তার বোধ ব্যাখ্যাসাপেক্ষ নয়। আইডিয়াই জন্ম নিয়েছে, আইডিয়াই মূর্তি হয়েছে।
এক সময় ইউরোপ স্বভাবের হুবুহু নকল করার দিকে ঝুঁকেছিল। সেটা আর্টের ঠিক রাস্তা নয়, তাতে শেষ পর্যন্ত তৃপ্তি দিতে পারে না।প্রতিক্রিয়ার বশে এখন স্বভাবকে একেবারে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছে ; সেটাও অস্বাভাবিক ; তাতে কোনো রস নেই। সমস্ত অনুষঙ্গ বাদ দিয়ে মানুষ ভাবতেও পারে না, দেখতেও পারে না। বিজ্ঞানের বা মনস্তত্ত্বের তথ্য নিয়ে কী হবে? সেটাই যে আর্টের সত্য তা নয়।. . . আর্টের বিষয় আর আর্টিস্টের মন, ঠিক যেন বস্তু আর আলো। সূর্যের আলো মাটি পাথরে শুষে নেয়, সেই হল স্বভাবের অনুকারী আর্ট। কাঁচে আয়নায় জলে প্রতিফলিত করে, সেই হল ভারতীয় বা প্রাচ্য শিল্পের জাত। এ আর্ট্ খুব করে অনুকরণ করতে যায় নি, খুব বেশি অ্যাব্স্ট্রাক্ট্ বা অনুষঙ্গভীরু হবারও তার দরকার নেই। এর যা সত্য তা রূপ ও অরূপ দুই মিলিয়ে দুয়ের মাঝামাঝি বিরাজ করছে। নিসর্গচিত্রে বা ল্যান্ড্স্কেপে যে রস তা নবরসের কোনোটা নয়। বড়ো- জোর শান্তরস বলতে পারো বা একাতড়বতার রস। চীনেরা, মনে হয়, ওদের ঋষি লাওৎসের বাণী থেকে তা পেয়েছিল।
একটা ভূদৃশ্যের মধ্যে একজন মানুষ। ভূচিত্রটাই বিশেষ ক’রে আঁকবার উদ্দেশ্য থাকলে, মানুষটি আঁকতে চেষ্টা করা উচিত। মানুষটি আঁকাই যদি লক্ষ্য হয় তবে ভূচিত্রটি এঁকে তুলতে যতড়ব করা ভালো। ছবির বিষয়কে সামনাসামনি বা হঠাকারিতার সঙ্গে আয়ত্ব করতে গেলে তা এড়িয়ে যায়। প্রেমেরও যেমন রীতি, তাতে বাঁকা ভঙ্গি আছে। যে দিকে যেতে চাও সেদিকে সোজা যাও না, যা বলতে চাও তা সোজাসুজি বলো না, যা চাও তা ব্যঞ্জনায় সুন্দর করে প্রকাশ করো -ইঙ্গিতে ইশারায়। তাতেই প্রেমিক আর প্রিয়া দুজনেই খুশি হয়, প্রেম সফল হয়। আর্ট্ই বলো আর প্রিয়াই বলো, তার সম্পর্কে হঠকারিতা ভালো নয় -‘না চাহিলে তারে পাওয়া যায়।’
ভূদৃশ্যের ছবিখানি কেবল গাছপালা, বালির চর, জলের ধারা এঁকে হয়তো সম্পূর্ণ মনের মতন হল না -তখন একটা কোথাও একটি ল্যাজঝোলা ফিঙে, কি পাঁচনি-হাতে রাখাল, কি উপুড় হয়ে একটা বাঁদর জল খাচ্ছে, এইটে এঁকে দিতে হল; অমনি দেখা গেল সমস্ত নড়ে-চড়ে কথা কয়ে উঠল। প্রাণের সঙ্গে প্রাণের পরিচয়। উদাস বা সুন্দর ভূদৃশ্যের মাঝখানে ঐ ফিঙে পাখিটি কি ঐ রাখাল লেছেটি হল আর্টিস্ট্ স্বয়ং।শিল্পে যে সিদ্ধ হয়েছে তার ভুল হয় না। গল্পে শোনা যায় চীনা শিল্পীর পা লেগে কালির বাটি উল্টে গেল, তৎক্ষণাৎ হাত বুলিয়ে এঁকে দিল আশ্চর্য এক ড্রাগন।
আঁকিয়ের মনেতে আঁকবার বিয়ষটি ঠিক-ঠিক যখন আছে তখন মন থেকে তুলে কাগজে রেখে দিলেই যেন হল। কিম্বা পর্দা সরিয়ে দিতেই যেন দেখা গেল কী আছে। এজন্য যে হাত, হাতিয়ার, কাল এবং কলা-কৌশলের প্রয়োজন তা থেকেও নেই; কারণ,শিল্পীর এবং শিল্পরসিকের তার সমন্ধে কোনো হুঁশই নেই যেন।তীর ধনুক নিয়ে অনেক নিাশানা ক’রে,অনেক যত্ন করে লক্ষ্যভেদের চেষ্টা করা যেতে পারে; তাতে লক্ষ্য বিদ্ধ হতে পারে, না-হতেও পারে। আর-এক, যখন লক্ষ্যই তীরকে আকর্ষণ করে নেয় চুম্বকের মতো, কোনো চেষ্টা নেই বলেই ভ্রান্তি বা চ্যুতির কোনো সম্ভাবনা নেই।
বর্তমান যুগে এবং বিশেষ করে পাশ্চাত্য দেশে বিজ্ঞানের প্রভাব শিল্পের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। কতকটা তারই ফলে ‘অবচেতন’ মনের বা ‘অতি-সচেতন’ মননের দ্বারা একপ্রকার শিল্পসৃষ্টির প্রয়াস দেখা যায়। সেরকম কাজ দেখে স্বভাবতই প্রশড়ব ওঠে যা কেবল কৌতূহল জাগায়, হেঁয়ালি অথবা প্রব্লেম আকার নেয়, তাও শিল্প কি না। আমাদের ধারণা, শিল্প রসের ব্যঞ্জনায় একদিকে যেমন অনির্বচনীয় ও অপরিসীম আর-এক দিকে তেমনি রূপে রেখায় অর্থে সুসীম, সংহত ও সুনির্দিষ্ট।কারণ, শিল্প হচ্ছে মানুষের সত্তার সঙ্গে বিশ্বসত্তার একান্ত পরিচয়ের সাক্ষ্য বা প্রতীক। এও বলা যেতে পারে: শিল্প নুতন পরিচয় সৃষ্টি করে এক সৃষ্টির জিনিসকে আর-এক সৃষ্টিতে উত্তীর্ণ করে দেয়।
কোনো একটি মেয়ের কথা ধরো। সংসারে সে কারও মেয়ে, কারও স্ত্রী, কারও সখী, কারও মা। প্রকৃতির মধ্যে ও প্রকৃতির চোখে সে মা নয়, মেয়ে নয়, স্ত্রী নয়, কোনো অচ্ছেদ্য সম্বন্ধেই কারও সঙ্গে বাঁধা নয় -সে নারী মাত্র। আবার ঐ মেয়েরই এমন পরিচয় পেতে পারি যে, ও হল মা, ওর কোলে ছেলে আছে বা এমন কোনো সুপরিস্ফুট লক্ষণ আছে যাতে অন্য কোনোরকম কল্পনাও করা যায় না। মেয়েটি প্রকৃতির মধ্যেও যেমন, কারও অন্তরঙ্গ অনুভূতির মধ্যেও তেমনি, নিঃসন্দিগ্ধ ও নির্দিষ্ট একটা পরিচয়ে উজ্জ্বলতা লাভ করে— আর, তখনই সে শিল্পের বিষয় হয়ে ওঠে। সংসারে তার নানা পরিচয় প্রতি মুহূর্তে একটা আর-একটাকে ঝাপসা করে দেয়, তার প্রকাশকে অনুজ্জ্বল করে এবং তাকে ভালো করে চেনা হয় না বলেই সে বোধের বিষয় ও শিল্পের বিষয় হয়ে উঠতে পারে না। . . . যে মেয়েকে রোজ দেখি তাকে দেখি নে। বিয়ের আসরে সে সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তখন দেখি সে অপূর্ব, সে অনন্য।
একখন্ড পাথরের কথাই ধরা যাক্। যখন তা পাথর ছাড়া আর-কিছু নয় তখন তা প্রাকৃতিক বস্তু মাত্র, ভূবিজ্ঞানের বা বস্তুবিজ্ঞানের এলেকাভুক্ত, চোখে দেখার বা যন্ত্রে পরীক্ষা করার বিষয়। আবার,সেই পাথরের টুকরো এমনও হতে পারে বা এমনভাবে কেউ তাকে আংশিক রচনা করতে পারে যাতে তাকে একবার মনে হয় শিব, একবার মনে হয় বানর, একবার মনে হয় জটাই বুড়ি। তখনও তা কৌতূহল জাগালো, জিজ্ঞাসা জাগালো, রস জাগালো না। কারণ, কোনো একটা পরিচয় ধরে তাকে আত্মীয় বলে জানলেম না, তাকে নাম ধরে ডাকলেম না। শিল্পীর হাতে যখন পড়ল তখন পাথর আর পাথর রইল না। শিল্পী আপনার সমস্ত হৃদয় দিয়ে অনুভব দিয়ে যা দেখলেন বা যা দেখার আরোপ করলেন, তাতে ঐ পাথর হয় শিব, নয় বানর, নয় জটাই বুড়ি, অনন্য একটা কোনো পরিচয়ে রসিকের কাছে পরিচিত হল, রসিকের অন্তরঙ্গ হল এবং শিল্পপদবাচ্য হল। তখনই তো সৃষ্টির প্রতিসৃষ্টি হল।
পুবদিকে সবুজ বনের মাথায় কাজল-কালো মেঘ আমার এত ভালো লাগছে কেন, মনকে এমন করে নাড়া দিচ্ছে? কারণ আর কিছু নয়, একই সত্তার, একই চেতনার, এক প্রান্ত হল ঐ মেঘ আর অন্য প্রান্ত হল এই আমি।
একদিকে মেঘ, আর-একদিকে আমি, তাই মেঘের সুখ আমাতে অথবা আমার দুঃখ মেঘে সঞ্চারিত হচ্ছে। একই সত্তা বিষয় ও বিষয়ী। আমার ইন্দ্রিয়গুলি দরোজা জানলা মাত্র। সেই পথে আমি ও আমার বিষয় মিলছে, মিশছে ; একই চেতনায় নানারকম দোলা লাগছে, ঢেউ জাগছে।
কুনালজাতকে আছে কামলোকের কথা -তার উপরে রূপলোক, তারও উপরে অরূপলোক। আমি বলি তারও উপরে আনন্দলোক।কামলোকে আসক্তি, তাই অন্ধতা। রূপলোকে উঠে রূপ গোচরীভূত হয়েছে। অরূপলোকে পৌঁছে প্রাণে নিখিল প্রাণের ছন্দস্পন্দ অনুভব করা গেছে। আনন্দলোকে রস। শাস্ত্রেই বলেছে : রসো বৈ সঃ।