স্থপতি বি.ভি.দোশী

স্থাপত্য ও নির্মাণ
সংলাপ
১৭ ডিসেম্বর, ২০২৩
২৩৮
স্থপতি বি.ভি.দোশী
স্থাপত্য ও নির্মাণে বিখ্যাত স্থপতি বি.ভি.দোশীর স্থপতির একটি সাক্ষাৎকার জুন ২১, ২০০৪ এ প্রকাশিত হয়েছিল, যা বাংলা ভাষায় সম্ভবত দোশীর একমাত্র সাক্ষাৎকার। এই আলোচনায় স্থাপত্য ও নির্মাণের পক্ষে অংশ নিয়েছিলেন
স্থপতি জালাল আহমেদ। পাঠকের জন্য এই বিশেষ প্রতিবেদনটি আবার তুলে ধরা হল।

8bfa23ae 56e9 41af A7fe 26553fee9a94

ছবি : স্থপতি বি.ভি.দোশী এবং স্থপতি জালাল আহমেদ

বাংলা অনুবাদ : এ. কে. এম. রাশেদুল হক

জালাাল: ধন্যবাদ জানাচ্ছি আপনার ব্যাস্ত সময়ের কিছুক্ষণ আমাদেরকে দেওয়ার জন্য। প্রথমেই আমি জানতে চাইব আপনি কেন স্থপতি হলেন, এর পিছনে কি কোন বিশেষ কারণ আছে?

দোশী: আমার জীবনে সব সময়ই নানারকম সুযোগ এসেছে। আমি পেইন্টিং করতাম, তখন আমি বিজ্ঞান কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম, একদিন চারুকলার শিক্ষক বললেন, তুমি ছবিও আঁকতে পার, অংকেও বেশ ভাল, তাই বিজ্ঞানে না গিয়ে স্থাপত্যকলায় পড়াশোনা করতে পার। তুমি মুম্বাইয়ের স্কুল অফ আর্কিটেকচারে ভর্তি হও না কেন? এবং আমি সেখানে ভর্তি হলাম, এটাই কারণ কোন নির্দিষ্ট কিছু নাই।

জালাল: আমার পরবর্তী প্রশ্ন, আপনি কর্ব্যুসিয়ের এর সাথে কিভাবে যুক্ত হলেন? আপনার স্থাপত্যচর্চায়   কর্ব্যুসিয়েরের এর কোন প্রভাব আছে কি? যদি থাকে কিভাবে?

দোশী: আমার মনে হয়, আমার সারা জীবনের স্থাপত্যচর্চায় ওঁদের এর প্রভাব রয়েছে। কিন্তু এই প্রভাব আংশিক ভাবে আমার প্রযুক্তি, স্টাইল, নির্মাণ উপকরণ ও ব্যবহারের ধরনের সাথে সম্পর্কিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটা আমি ওঁদের এর কাছ থেকে শিখেছি তা হল স্থাপত্যকলায় চিন্তার স্বাধীনতা, কর্ব্যুসিয়ের এবং লুইকা’ন এর কাজ আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি এবং এই অভিজ্ঞতা থেকে যা শিখেছি তা হল আপনি যেখানেই যান আপনাকে চিন্তার ক্ষেত্রে শুধু সহজাত ধারনার বশবর্তী হয়ে কাজ করলেই চলবে না, আপনাকে শিকড়ের সন্ধান করতে হবে এবং সেখান থেকেই বিকশিত হতে হবে। আমি যখন কর্ব্যুসিয়েরকে কাজ করতে দেখেছি আহমেদাবাদে, ভারতে অথবা প্যারিসে, আমি খুবই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে কিভাবে তিনি আবহাওয়া ও জলবায়ুকে নিয়ে প্রত্যেক ক্ষেত্রে কাজ করতেন। তিনি কাজ করতেন একেবারেই ভিন্ন ধরনে, তিনি সেখানকার মানুষকে লক্ষ্য করতেন, পশু-পাখিকে লক্ষ্য করতেন, লক্ষ্য করতেন স্থানীয় জীবন যাপন পদ্ধতিকে, বর্ষাকাল , গ্রীষ্ম, বর্ষা ইত্যাদি পারিপার্শিক বিষয়গুলো এবং এসব পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই তিনি তার স্থাপত্যের রূপরেখা তৈরী করতেন। তারপর যখন আমি তাকে সত্যিকার অর্থেই টেবিলে কাজ করতে দেখলাম আরও অবাক হলাম, তিনি কাজ করতেন যেন পুরোটাই একটা সাদা পট এবং এর মধ্যেই নিজেই কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করে তার সমাধান খুঁজতেন। এ থেকে আরেকটি যে ব্যাপার আমি শিখেছি তা হল, কাজের প্রাথমিক পটভূমি সব সময়েই খালি এবং পারিপার্শিক বিষয়াদি থেকে এবং আপনার অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে কিছু উত্তর বের করে এনে ঐ খালি পটে সন্নিবেশ করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন এক ধরনের চেতনাগত চালিকাশক্তি, এই বিষয়টি কর্ব্যুসিয়ের এবং লুইকা’নের কাজের পদ্ধতিতে বিশেষ ভাবে উপস্থিত ছিল। একই ব্যাপার আরও ব্যাপক ভাবে লক্ষ্য করেছি লুইকা’নের ক্ষেত্রে। কা’ন আহমেদাবাদে এলেন এবং আই. এ. এম. এর সেই খিলান এবং মাটির নীচে বাট্রেস (ঠেস দেয়াল) নিয়ে কাজ শুরু করলেন। এর মধ্যে আমি মান্ডু গেলাম এবং সেখানে একই রকম কিছু পুরানো বাড়ী পেলাাম এবং তাকে দেখালাম, আমি অবাক হয়েছি কিভাবে এমন মিল হল। কর্ব্যুসিয়েরের র‌্যাম্প এবং আমাদের ‘আমের’ র‌্যাম্প একই রকম। যখনই কোন সমস্যা আসে, ওরা থিওরীর মধ্যে না গিয়ে নির্ভর করতেন বাস্তবতার উপর। এভাবে তাদের কাছ থেকে আমি যে শিক্ষাটা গ্রহণ করেছি তা হল স্থাপত্যের নির্দিষ্ট কোন ধরাবাধা কোন নিয়ম নেই। মূল ব্যাপারটা হচ্ছে চেতনার চালিকাশক্তি যা আপনাকে পরিচালনা করবে এবং সত্যিকার অর্থে এগুলোই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে আমাদের মন্দির, শহর, গ্রাম, বাড়ীঘর, আর্থসামাজিক কাঠামো, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলিকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করতে। এসব বিশ্লেষণের মাধ্যমেই আমি আমার নিজস্ব একটা অভিব্যক্তি খুজে পেতে চেষ্টা করছি।

জালাল: তাদের কাজের মধ্যে আপনি ভারতীয়তা খুজে পান? তারা যখন ভারতে চন্ডীগরের মত প্রকল্প তৈরী করেন তখন এমন কোন সুনির্দিষ্ট দিক কি আপনি লক্ষ্য করেছেন যাকে আপনি বলতে পারেন যা ভারতের জন্যই প্রযোজ্য?

দোশী: আপনি যখন ঐ স্থাপনার দিকে তাকান সহজাত প্রবৃত্তির বশেই বুঝতে পারেন এ আমাদের কোন গ্রামীণ স্থাপনা নয়, আবার প্যারিস বা আমেরিকার কোন স্থাপনাও নয়। তাই প্রথম বলা যায় তারা সাধারণত: অন্যান্য ক্ষেত্রে যে ধরনের কাজ করে থাকেন এগুলো সেরকম নয়। এটা এক ধরনের ভাবানুবাদ। বলা যায় তাদের জীবনের নতুন অধ্যায়। যখন আপনি ঐ স্থাপনার দিকে লক্ষ্য করেন তখন দেখেন কর্ব্যুসিয়ের এর প্যারাসোল, আলোছায়ার খেলা, বাতাসের প্রবাহকে ব্যবহার করার প্রয়াস এবং তার ডিজাইনের নমনীয়তা, যাই হোক, আমার কাছে মনে হয় ভারতীয় স্থাপনায়ও ঐ বৈশিষ্ট্যগুলো আপনার চোখে পড়বে। ফর্মের মধ্যে প্রবাহমানতা, ভারসাম্য, স্কাই লাইন আবার উন্মুক্ত স্পেস এবং তার সাথে ফর্মের সম্পর্ক এসবই আমাদের স্থাপত্য ঐতিহ্যে রয়েছে। এখন কিভাবে এসব স্থাপনাগুলিকে স্থাপত্যধারায় ভারতীয় থেকে ভিন্ন বলব? বলা যায় এগুলি নতুন রূপ পেয়েছে, কারণ এগুলো তৈরী কনক্রীট দিয়ে, নতুন ব্যাখ্যা পেয়েছে রোদ নিবারক উপাদান ব্যবহারের কারণে যা হয়ত বারান্দা দিয়ে আগে করা হয়েছে। আমাদের বারান্দাগুলো কিন্তু একই কাজ করে পার্থক্যটা শুধু বারান্দার বাকগুলো। কাজের বেলায় একই রকম কিন্তু চেহারা আলাদা। লক্ষ্য করবেন, কার্যকারীতা একই কিন্তু প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন হওয়ায় চারপাশের আবহে ভিন্নতা এসেছে। আমি বলতে চাচ্ছি, প্রযুক্তি অন্য সবকিছু থেকে মুক্ত এবং দেখেন কা’নও ঠিক একই জিনিস করেছিলেন। কা’নের স্থাপত্যগুলো ভারতীয় স্থাপনাগুলোর খুবই কাছাকাছি। আসলে আমি এর মধ্যে ভিনদেশী কিছু খুঁজে পাইনা। এর কারণ এই নয় যে, তাদের কাজ সম্পর্কে আমি অবগত। আপনি মোঘল অথবা পর্তুগীজ স্থাপত্যগুলো লক্ষ্য করুণ, কিভাবে বলবেন সেগুলো ভারতীয়? হতে পারে সে সময়গুলোও ভিনদেশী মনে হত। কিন্তু সময়ের সাথে সকলেই ঐ নতুনত্বকে গ্রহণ করেছে। আমি বলব এখানে ভারতীয়তা কোন স্টাইলে লয়, ভারতীয়তা হচ্ছে আমাদের জলবায়ুতে, ব্যবহারিক জীবনে, সংস্কৃতিতে সে কতটা সম্পৃক্ত হচ্ছে, সেই বিচার।

জালাল: ইদানীং আমরা বিশেষ একটি ভরতীয় ধরন এর আবির্ভাব সম্পর্কে পড়ছি এবং দেখছি যাকে সমকালীন বৈশিষ্ট বলা যায়, এ সম্পর্কে কিছু বলুন।

দোশী: সমকালীন কিছু বৈশিষ্ট’ত আছেই, অনেকেই চেষ্টা করছে কিছু করতে, কেউ ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে ভারতীয় উৎস সন্ধান করছেন, কেউ গ্রামীণ বাড়ি-ঘরের ডায়াগ্রাম থেকে কিছু নেবার চেষ্টা করছেন, কেউ প্রাচীন তান্ত্রিক ডায়াগ্রাম থেকেও স্থাপত্য রচনার চেষ্টা চালাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ আছেন যারা মানুষের জীবন ধারাকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। আমাদের জনপদের নিজস্ব স্থাপত্য ধারার দিকে লক্ষ্য করুণ বাড়ি-ঘর বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণে তৈরী হয় এবং প্রত্যেকে বিভিন্ন নির্মাণ উপাদান নিয়ে তার নিজস্ব ধারায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন। তবুও সামগ্রীক ভাবে কতগুলো বিষয়ের গ্রহণযোগ্যতা সবাই মেনে নিচ্ছেন যেমন, উঠোন বা কোর্ট ইয়ার্ড, টেরেস বা বারান্দা। সিঁড়ির কথাই ধরুন, বিল্ডিংএর বিভিন্ন লেভেলে সিঁড়ি উঠছে কখনও নামছে, সিঁড়ির এই ব্যবহার কি পরিবর্তন হচ্ছে? এসব বিষয় সেই প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্য থেকে এখনও একই ভাবে আমাদের কাজে লাগছে। আমাদের গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বিকেল কিংবা সন্ধ্যা সবকিছুর সাথে এসব সম্পর্কিত। ইদানীং আমরা এগুলোকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করছি এবং এই যুগে এসব বিষয়ের উপযোগীতা নিয়ে ভাবছি, তারপর এর সাথে যুক্ত করছি নতুন মাত্রা। নতুন আকার-আকৃতি, নতুন ধরনের উপাদান এবং একটি আরেকটির সাথে মেলাচ্ছি। যখনই কেউ স্থাপত্যচর্চা করছেন তিনি বর্তমানে উপস্থিত একই সাথে হয়ত চেতনাগত ভাবে ভবিষ্যতে অথবা অতীতেও রয়েছেন। আমি মনে করি, একজন যখনই এমনভাবে চিন্তা করবেন তিনি অবশ্যই স্বতš যুক্তিসঙ্গত কোন কিছু তৈরী করে ফেলবেন। প্রতিস্থাপন হলেও শিকড় যদি গভীরে থাকে তাহলে তা কার্যকরী হবে। অন্যদিকে আজকাল প্রচুর কার্টেইন ওয়াল, নানা ধরনের কাঁচের ব্যবহার হচ্ছে, এগুলো সবই ক্ষণস্থায়ী। অনেকটা জামা কাপড়ের মত। কিছু জিনিস খুবই স্থায়ী এবং অন্যগুলো কিছুটা ক্ষণস্থায়ী। বিশ্বময় এই একই চিত্র। বর্তমানে আমরা একটা স্রোতের মাঝে রয়েছি। সবাই চাইছে উদ্ভাবন করতে, পরিবর্তন করতে এবং কিছু একটি অর্জন করতে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আমিত্বের মনোভাব। যেমন আপনি চাইছেন মিডিয়ার মাধ্যমে পরিচিতি। দুর্ভাগ্যবশত এই মিডিয়া হল এমন একটা মাধ্যম যেখানে আমরা আমাদের সহজাত ও উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত বৈশিষ্টগুলো হারিয়ে ফেলছি। কারণ এই মাধ্যম সবসময় মনোহর কিছু খুজে ফিরছে এবং তার সাথে বহির্বিশ্বের মিল খুঁজছে। এখন আমরা সমকালীন তাকেই মনে করছি যেভাবে টেলিভিশন আমাদেরকে শেখায়, আর টেলিভিশন আমাদেরকে সবসময় পশ্চিমা বিশ্বের কথা বলছে, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বইতো একমাত্র বিশ্ব নয়। পশ্চিমা বিশ্ব ছাড়াও রয়েছে আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, ইউরোপ ভারত এবং চীন। এসব স্থানেও প্রচুর কাজ হচ্ছে। সেটাই সঠিক পথ যার শিকড় গভীরে প্রথীত। যার মধ্যে থাকে আমাদের খাদ্যাভ্যাস, জীবন ধারা, চিন্তা চেতনার বহি:প্রকাশ। আমরা প্রয়োজনীয় সব প্রযুক্তি ব্যবহার করছি, এটা আমাদের একটা নতুন অভিজ্ঞতা, সমকালীন অভিজ্ঞতা। এই হল গতির সমকালীন তাৎপর্য, পরিবর্তনের এই সমকালীন ধারনা, যোগাযোগের সমকালীন প্রেক্ষিত। এসবই কিন্তু নতুন, খুব বেশী দিন হয়নি। আপনি ভারতের কুন্ডগুলিকে লক্ষ্য করবেন, মানুষের মন্ত্র উচ্চারণের পদ্ধতি লক্ষ্য করবেন, লক্ষ্য করবেন মানুষ কিভাবে পানির মধ্যদিয়ে মন্দিরে যায়। আমি মনে করি এটা একটা জীবন প্রণালী। অন্য একটা ধরনও আছে, আমাদের যোগাযোগ পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়েছে, আমাদের স্থান, অবস্থান, প্রযুক্তি প্রায় সবই নিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু,আপনি লক্ষ্য করেন ঐ পুরাতন ধারনাগুলোই কিন্তু পরিবর্তিত অবস্থায় ফিরে পাচ্ছি। সমকালীন চিন্তাধারা এসকল বিষয়গুলোকে একত্র করার চেষ্টা করছে। যখনই একটা সমন্বয় সাধিত হবে তখনই এর প্রতিষ্ঠিত রূপ পাওয়া যাবে। দর্শন এমন একটা ব্যাপার যার কোন নির্দিষ্ট মাত্রা নেই। যখনই স্থাপত্য ও জীবনদর্শনকে এক করে দেখা হবে আসলে তখনই সত্যিকার  স্থাপত্য বেরিয়ে আসবে। স্থাপত্য শুধু দৃশ্যমান বস্তুই নয়। স্থাপত্য দার্শনিক ভিত্তিতেও প্রতিষ্টিত হয়। অর্থাৎ আমাদের বুঝতে হবে আমরা কি করছি, কেন করছি, উদ্দেশ্যটা কি, উদ্দেশ্যটা কি দীর্ঘস্থায়ী না শুধু মাত্র কারও শখের বাস্তবায়ন। এই প্রশ্নগুলোর সমাধান সাধারণত আমরা খুজিনা, তবে যারা এই প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবেন তাদের কাজ যথেষ্ট ভাল।

জালাল: আপনি যাদেরকে উল্লেখ করলেন নতুন প্রজন্মের স্থপতি তারা কারা?

দোশী: প্রতিষ্ঠিত স্থপতিদের মাঝে কানবিন্দের নাম আপনারা জানেন, এখানে মানে বাংলাদেশে বলা যায়, মাজহারুল ইসলামের নাম, আমি আজ তার চারুকলা ইনষ্টিটিউট দেখেছি। আমি খুবই মুগ্ধ হয়েছি এর সারল্য, এর সংবেদনশীলতা উপলব্ধি করে এবং সর্বোপরি যে প্রযুক্তি এক্ষেত্রে ব্যবহƒত হয়েছে তাকে শিকড় বিহীন মনে হয়নি। আমার মনে হলো পারিপার্শিক পরিবেশের সাথে খুব সরল ও সাধারণ ভাবে সমন্বিত একটি স্থাপত্য কর্ম সব ক্ষেত্রেই নতুনত্বের ছোঁয়া। কনক্রিটের ব্যবহার, ইটের কাজ আছে যথেষ্ঠ, কিন্তু যে পদ্ধতিতে এসব ব্যবহƒত হয়েছে, যেভাবে স্পেসগুলি রচিত হয়েছে তা খুবই চমৎকার। লক্ষণীয় যে এখানে স্পেসগুলির কোন সীমানা দেয়া হয়নি। এই দিকটি গুরুত্বপূর্ণ, আমাদেরকে সীমাবদ্ধতা জয় করা শিখতে হবে। আমার মতে এই সীমা অতিক্রম করার চেষ্টাই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানুষকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। আমরা একটি বাড়ি তৈরী করি, কারণ আমরা আশ্রয় চাই। তার মধ্যে একটি জানালা দিই বহির্দৃশ্য দেখার জন্য। এরপর একটি দরজা তৈরীর জন্য কিছু কলাম দেই, আরও কলাম যুক্ত করে বারান্দা বানাই, একই সাথে অর্ধেক ভেতরে এবং অর্ধেক বাইরে থাকার জন্য। এবং তারপর বিভিন্ন অংশে কাঁচ লাগাই একই সাথে নিরাপদ অথচ পরিবেশের অংশ হবার জন্য। এটা মনুষ্যজাতির এক ধরনের বিজয়। কিভাবে সম্ভব? এটা একটা ধাঁধা। আমরা একান্ততা চাই, নিরাপত্তা চাই, আশ্রয় চাই, দক্ষতা ও সৌন্দর্য চাই আবার চাই পারিপার্শিকের সাথে সম্পর্ক রাখতে যতটুকু সম্ভব। তাই আমি মনে করি আমাদের বাড়িগুলোকে বদলাতে হবে। বাড়ি আমাদের শুধু শিকড় আকড়াতেই বা স্থায়ী হতেই সাহায্য করে না বরং স্থবিরতার পাশাপাশি তারল্যও থাকতে পারে। মনে করুণ একটি ডিম, একটা সম্পূর্ণ আকার কিন্তু গড়িয়ে দিলে চলতে থাকবে, যদি একটা কোনা ভাঙ্গা যায় তাহলে আবার স্থির ভাবে বসিয়ে দেয়া যায়, কিন্তু তার অবয়বে গড়ানোর সম্ভবনা রয়েই গেল। আমরা আমাদের কাজের বাইরে ও ভেতরে একই সাথে এ ধরনের সমন্বয় আনতে পারি কি না। স্থাপত্যকে আকর্ষণীয় হতে হবে আবার সূর্যের আলোর মত এর প্রভাব পারিপার্শিকের উপর বিচ্ছুরিত হবে। তখনই আমাদের স্থাপনাগুলো বিশিষ্টতা অর্জন করবে, এভাবেই আমাদের অতীতের সাথে একটা নিরন্তর যোগসুত্র স্থাপিত হবে। এটাই আমার মতে স্থাপত্যের মূল কথা। মাজহারুল ইসলামের কাজ অনেকটা এধরনেরই। নতুন প্রজন্মের প্রচুর স্থপতি রয়েছেন যাদের কাজ খুবই সুন্দর, অনেকে চেষ্টাও করেছেন নানা ভাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হল আমাদের সংস্কৃতি খুবই লাজুক, বাংলাদেশেও এবং ভারতেও। আমরা উচ্ছাস প্রবণ নই, আমরা আমাদের কাজের, চিন্তার ডকুমেন্ট রাখি না, আমরা কিভাবে একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি তার ইতিহাস এসব কিছুই রক্ষা করি না। আমাদের কাজের উদ্দেশ্য নিয়েও আমাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। আমরা যতটা না বিচারক্ষম তারচেয়ে বেশী সহজাত। কিন্তু আমরা অবশ্যই চিন্তাশীল। মনের গভীরে আমরা অনুভব করি। তাই আমাদেরকে অবশ্যই প্রকাশের ভাষা খুঁজতে হবে। যখনই আমরা এসব সংরক্ষণ করব অথবা কিছু নোট রাখব তখনই আমরা দেখব আমরা সঠিক পথে রয়েছি, বিশ্বময় এটা চলছে। আপনি দক্ষিণ,পূর্ব অথবা পশ্চিম ভারতে যেখানেই যান দেখবেন কিছু মানুষ কাজ করছেন যা সত্যিই সুন্দর।

জালাল: আপনার নিজের কাজের কথা কিছু বলুন, আপনার দর্শন, কাজের ধারা এগুলো আমরা জানতে চাই।

দোশী: আমি একই সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করি। আমি ছাত্রদের পড়াই এবং তারা আমাকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করে, প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমাকে এসব বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তা করতে হয় উত্তর বের করার জন্য। অন্যদিকে আমি ভারতের ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলো পর্যবেক্ষণ করি, অন্যগুলোও করি, মন্দিরে যাই, রাস্তা-ঘাটগুলোতে যাই, লোকজনের সাথে মিশি এবং তাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলো দেখি এবং এসব কিছুর অর্ন্তর্নিহিত সংযুক্তিগুলো লক্ষ্য করি, চিন্তা করি কেন তারা এধরনের আচার আচরণ করে চলেছে। আবার ভাবি, এতগুলো শতক ধরে কিভাবে আমরা আমাদের এসব সংস্কৃতি টিকে আছে এবং কোন সুত্রগুলি এগুলো টিকিয়ে রাখছে। আমি লক্ষ্য করেছি বেশ কিছু অন্তর্দন্দ আছে, আমাদের সংস্কৃতির গ্রহণ করার যথেষ্ট ক্ষমতা আছে এবং সেজন্য অনেক বাইরের উপাদান প্রতিনিয়ত এসে মিশে যাচ্ছে। সেখানে কোন সুনির্দিষ্ট পার্থক্য নেই। একই সময়ে আমরা পরস্পর ঘনিষ্ঠ এবং দুরবর্তী। আমরা এরকম একটি স্ববিরোধীতার জগতে বসবাস করছি এবং এই স্ববিরোধীতা টুকু উপভোগ করছি। আমরা বৈচিত্র পছন্দ করি। আমরা সবসময়ই গরীব কিন্তু কোন পরিবর্তন এর গ্রহণ যোগ্যতায় আমরা উন্মুক্ত। যখনই আমি এসব ব্যপারগুলো লক্ষ্য করি তখনই বিষয়গুলোর অন্য একটি দিক খুঁজে পাই যা আগে কখনও পাইনি। আর একটি যে ব্যাপার, আকার আকৃতি ও গড়নের ব্যাপারে আমাদের একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। যখন আমি ভারতের মসজিদগুলো লক্ষ্য করি অথবা প্রাসাদগুলো, আমার মনে হয় তাদের আর্টিকিউলেশান আমরা যেভাবে সাধারণত: চিন্তা করি সেরকম নয়। পশ্চিমা বিশ্বের আর্টিকিউলেশন বা সমন্বয় কিন্তু ভিন্ন ধরনের। ওদের যেমন ইন্টেলেক্চুয়াল আর্টিকিউলেশন রয়েছে যা থেকে তাদের শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য সব কিছুই একটা মুল কাঠামো গ্রহণ করতে পারছে, তেমনই আমাদেরও কিন্তু রয়েছে নিজস্ব সমন্বয় ধারা।

জালাল: এপ্রসঙ্গে কোন উদাহরণ কি দেয়া যায়?

দোশী: উদাহরণ স্বরূপ মসজিদগুলোকে ধরা যায়। আপনি মসজিদগুলোর সামনের দিকটা লক্ষ্য করুণ, সারিবদ্ধ কলামের দেয়ালগুলি দেখছেন, আমি প্রায় ক্ষেত্রেই দেখেছি মিনারের পরেও দেয়াল আরও অনেক দুর চলে গেছে, উর্দ্ধমুখী মিনার এসব দেয়ালের মাঝে যতি চিহ্নের কাজ করছে। আপনি লক্ষ্য করেন ফতেহপুর সিক্রীর ভবনগুলো। সেখানে আপনি অনেক ধরনের ভবন লক্ষ্য করবেন কিন্তু একটা প্যাটার্ন তৈরী করার জন্য কিছু জায়গায় দেখবেন সমন্বয় সাধন করা হয়েছে। আপনি ভারতের রাস্তা-ঘাটগুলো লক্ষ্য করুন দেখবেন যথেষ্ট বৈচিত্রময় অভিব্যক্তির উপস্থিতি সত্ত্বেও কলাম এবং কাঠামোগুলো প্রায় একই রকম। আমার মনে হয় ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে আপনাকে বিশিষ্ট হতে হবে আবার সাধারণও হতে হবে। অর্থাৎ সবসময়ই আপনাকে বিশিষ্ট হতে হবে এমন নয়, আপানাকে পড়শীর সাথে হাত মিলাতে হবে এবং একই সাথে আপনার নিজস্ব একটা পরিচয় ধরে রাখতে হবে। আপনার ভবনের দরজা বা দেয়াল স্বাভাবিক কারণেই আপনার পড়শীর দেয়ালকে সম্মান করবে। আপনি যদি ভারতীয় দেয়ালচিত্রগুলো লক্ষ্য করেন দেখবেন এর একটা মূল ফ্রেম এবং সাব ফ্রেম রয়েছে এবং অনেক সময় চিত্র ফ্রেমের বাইরে চলে যায়। তাই ব্যতিক্রম সবসময় নিয়মের অস্বীকৃতি নয় বরং স্বীকৃতি রূপে কাজ করে।

জালাল: আপনি আমাদের স্থাপত্যে যে গ্রহণ ক্ষমতার কথা বলছেন, সে কি শুধু আমাদেরই আছে ? আমরা’ত দেখছি ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত হলেও পশ্চিমা বিশ্ব যথেষ্ট উন্মুক্ত, তারাও অন্যান্য সংস্কৃতির থেকে সহজেই গ্রহণ করে।

দোশী: ইদানিং পশ্চিমা বিশ্বের যে ভবনগুলো আপনি দেখেন, সেখানে তারা চিন্তা করছে  কোন-পরিসরে একটা বস্তু (হতে পারে একটা বাড়ী) বসছে, অর্থাৎ পরিসরের নানা উপাদান ঐ বাড়ীতে কতটুকু গ্রহণ করা যায়, পারিপার্শিককে সম্মান জানিয়ে বাড়ীটি সম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারছে কি না। কিন্তু আরবান ডিজাইন নয়, ঐ বাড়ীটির ডিজাইনের না, দৃষ্টিভঙ্গির যথেষ্ট পার্থক্য আছে, বিচার্য বিষয় অবশ্য এর ব্যতিক্রম থাকতে পারে। আমরা কিন্তু এভাবে চিন্তা করিনা। আমরা বস্তুর ভেতর বস্তু কল্পনা করি অর্থাৎ ধনাত্বক এবং ঋনাত্বক স্থানের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আমাদের কাছে সব স্থানই ধনাত্বক। আমাদের বাইরের স্পেস মানে অব্যহƒত স্পেস নয়। একই রকম সক্রিয় এবং আরও বেশী কাজে লাগে। আমাদের টেরেসগুলো শুধু টেরেস নয়। এটা অনেকটা লিভিং রুম। কোন কোন ঋতুতে এটা লিভিং রুম হিসেবে ব্যবহƒত হয়। আমাদের সংযোগ পরিসরগুলো বেশী প্রভাবশালী। পশ্চিমা বিশ্বে এমন কোন সংযোগ পরিসর পাবেন না। তারা আজকাল চেষ্টা করছে যেন মানুষ ভবনের প্রধান অংশে ঢোকার আগে একটা অন্তর্বর্তী পরিসর পায়। আমি মনে করি এ বিষয়টা আমাদের সবসময়ই ছিল। আমাদের বাড়ি-ঘর নিজস্ব বৈশিষ্টকে স্পষ্ট করে দেবার পর সামগ্রীকতায় মিশে যায়, অনেকটা আমাদের সঙ্গীতের মত। বিভিন্ন ধরনের তাল লয় রয়েছে। যা আপনাকে অন্য কোথাও নিয়ে যায়, ফিরিয়ে আনে আবার নিয়ে যায়। এই আসা যাওয়াকে বাইরে থেকে দুর্বোধ্য মনে হতে পারে কিন্তু আমাদের জন্য তা গুরুত্বপূর্ণ, সোজা পথে চলার মতই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এলোমেলো এবং দৃঢ়বাধা কাঠামো দু’টোই আমাদের সমান দরকার এবং একারণেই আমরা ভিন্ন।

জালাল: আপনি বহুদিন ধরে স্থাপত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চর্চায় রয়েছেন, সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের একটু বলুন বিশ্বায়নের এই যুগে স্থাপত্য শিক্ষার চর্চার অনুকরনীয় বিষয়গুলো কি?

দোশী: এটা খুব জটিল একটা প্রসঙ্গ। বিশ্বায়ন এমন একটি ধারণা যা অতীতেও ছিল। কারণ যখন বিশ্বায়ন নিয়ে আমরা চিন্তা করি এটা কিন্তু একটা সার্বজনীন ধারণা। একটি শিশুর কাছে বিশ্ব দর্শন হচ্ছে ঘরের বাইরে যাওয়া। একটি পরিবারের কাছে ছোট গ্রাম থেকে বড় শহরে যাওয়া। আর এখন যেহেতু আমাদের টেলিভিশন রয়েছে, তাই আমরা বলছি সীমানা পরিবর্তিত হয়েছে। তাই বিশ্বায়ন হচ্ছে আপনার জানার পরিধির বাইরের কিছু সম্পর্কে সচেতনতা। আমি মনে করি এই জানার আগ্রহ আগেও ছিল, হয়ত তা কিছু সীমা বদ্ধতা মেনে চলত। বিশ্বায়ন আমাদের যা শেখাচ্ছে তা হল একটি সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন পথ রয়েছে। অসীম সুযোগ ও পথ রয়েছে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য। তাই একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আবদ্ধ থাকার ব্যাপারটি নেই। আমি মনে করি বিশ্বায়ন আপনাকে ছোট শ্রোতধারা থেকে সমুদ্রের মুখোমুখি করেছে। একটা সমুদ্রের সীমানা কি? কোন রাষ্ট্র কি সমুদ্রের অন্তর্ভূক্ত বা কোন রাষ্ট্র মহাসাগরের অধিকারী ? মহাসাগরের জলরাশি যেখানে ভূমি স্পর্শ করে সেখানেই তার সীমানা। পৃথিবীর যে অংশগুলো সমুদ্র স্পর্শ করে সেখানে প্রত্যেকটা উপকুলেরই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট আছে, এমনকি উপকুলের কাছাকাছি সমুদ্রেরও কিছু পরিবর্তন হয়। কারণ এখানে অন্যান্য অনেক বিষয় এসে যোগ হয়। কিন্তু সমুদ্র একটিই। উপকুলে পাহাড় কিংবা সমতলভূমি থাকতে পারে, গাছপালার, আবহাওয়াও পার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার কিউবার নিকটবর্তী সমুদ্র অথবা মোনাকো, বোম্বে অথবা বাংলাদেশে সমুদ্রের কিন্তু পার্থক্য নেই। সমুদ্রের তীরবর্তী ভূমন্ডলেই যত পরিবর্তন চোখে পড়ে। আমি মনে করি, আমাদেরকে প্রথমে উপলব্ধি করতে হবে যে আমরাও সারা বিশ্বের একটা প্রয়োজনীয় অংশ, পাশাপাশি বের করতে হবে আমাদের নিজেদের সীমানায় নিজেরা কতটুকু করতে পারি। আমাদেরকে নিজস্ব সম্পদ, শক্তি নিয়ে নিজস্বতা আয়ত্তে আনতে হবে। বিশ্বায়নের মূল কথা হল সব কটা জানালা খুলে দাও, এবং এই উন্মুক্ত পরিবেশে নিজের সত্তাকে খুঁজে বের কর ধাপে ধাপে। বিশ্বায়নের আরও একটা ব্যাপার হল আমরা যতই কঠোর পরিশ্রম করি ততই নিজেদেরকে বুঝতে পারি। আমরা কে, আমরা কোথায় এবং আমরা এমন কি কি করতে পারি যা আমাদের পরিপ্রেক্ষিতের প্রাসঙ্গীক, অর্থাৎ আপনি যে কোন কিছুই গ্রহণ করতে পারেন। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে, আপনি খাবার কেনার জন্য বাজারে গিয়েছেন, আপনার সামনে সব ধরনের খাবার আছে, কিন্তু আপনি কি খাবেন, সেটা হজম হবে কিনা? এসব ব্যাপারে আপনার নিজস্ব স্বাধীনতা রয়েছে। তার মানে এই নয় আপনি সবসময় ঠিক জিনিসটাই কিনতে পারবেন, আপনি ঠকতে পারেন এবং শরীর খারাপ হতে পারে। তবুও বলব ঠিক আছে, কারণ ক্ষতির চেয়ে প্রাপ্তীর সুযোগ অনেক বেশী। বিশ্বায়নে শহর কাঠামো পরিবর্তিত হচ্ছে, পরিবহণ ব্যবস্থা পরিবর্তিত হচ্ছে, ব্যবস্থাপনা পরিবর্তিত হচ্ছে, শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু মানুষের খাদ্যাভ্যাস ততটা পরিবর্তিত হয়নি। আপনি আপনার জীবন ধারা বদলাতে পারেন কিন্তু প্রকৃতি বদলাতে পারবেন না। অন্যদের সাথে আপনার সম্পর্ক তেমন বদলাচ্ছে না, আপনার সঙ্গলিপ্সতা স্বভাব বদলাচ্ছে না। আমাদের সেই সুবিধাটুকু আছে। বিশ্বায়ন আপনাকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে যখন আপনার ঘরে চার’টা টেলিভিশন আছে। কারো সাথে দেখা করারও প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমরা’ত করমর্দন করতে পছন্দ করি, একে অপরকে স্পর্শ করতে পছন্দ করি, আলিঙ্গন করতে পছন্দ করি। এই প্রবণতাও বাড়ছে। তাই  আপনি যত ছড়িয়ে পড়বেন ততই একে অপরের  নিকটবর্তী হবেন। যে প্রযুক্তি আমরা গ্রহণ করি তার সবটুকুই আমাদের ব্যবহার করতে হবে এবং তা থেকে নতুন কিছু তৈরী করতে হবে। আমি নিজেকে প্রশ্ন করি এবং বুঝতে পারি না যখন ভাবি আমাদের পূর্বসূরীদের সামনেও কোন উদাহরণ ছিলনা। তারা কিভাবে তাদের ভবনগুলো তৈরী করেছিলেন যা এখনও আদর্শ বলে মনে হচ্ছে ? এটা তখন কিভাবে হল এবং কিভাবে এখন আমরা বুঝতে পারলাম যে আমরা এরকম কিছু তৈরী করতে পারবো না ? এর অর্থ কালজয়ী কিছু তৈরীতে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রয়োজন নেই। আপনাকে নিজেকে প্রথমে সংহত করতে হবে। ধরা যাক আপনি একটা চারা লাগালেন এবং তারপর সেটাকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক ঘুরতে গেলেন, চারা গাছটি বাঁচতেও পারে আবার নাও বাঁচতে পারে। যদি এটা বেঁচে যায় তাহলে সে নিউ ইয়র্কেও গ্রহণ যোগ্য। তাই বিশ্বায়ন থেকে আমি যা বুঝি তা হল বিশ্বায়নের প্রয়োজনে মুখাবয়ব বদলানোর প্রয়োজন নেই। সবকিছু এক অভিন্ন করে ফেলার প্রয়োজন নেই। স্বতন্ত্র থেকেও বিশ্বায়ন সম্ভব।

জালাল: তাহলে আপনি বলছেন আমাদের আঞ্চলিক বৈশিষ্টগুলো প্রথমে, তারপর অন্যান্য দিকে চোখ ফেরানো?

দোশী: বিশ্বায়ন হচ্ছে অবকাঠামো। অবকাঠামো একই হতে পারে, কিন্তু আপনার রান্না আপনাকেই করতে হবে।

জালাল: এটা কি সম্ভব, এযুগে সেই কালজয়ী বৈশিষ্ট্য অর্জন করা?

দোশী: আমার মনে হয় কালজয়ী কোন কিছুর সাথে শব্দহীনতার বা নীরবতার একটা সম্পর্ক রয়েছে। কালজয়ী বৈশিষ্ট্য  কথা বলে না। কালজয়ী বৈশিষ্ট্য আপনি পাবেন আকাশ, মাটি, মানুষের সাথে গড়ে ওঠা সম্পর্কের মাঝে। এটা হতে হবে ঐ উপসর্গগুলির একান্তই নিজস্ব আর কারও নয়। উদাহরণ দিই। তাজমহল অথবা এখানকার পার্লামেন্ট ভবন। কি অবস্থা হবে যদি আগামীকালকের পৃথিবী পুরোটাই বদলে যায়? এই সংসদ ভবনটাকে কি তখন ভিন্নদেশী মনে হবে? আমার মনে হয় না। কারণ এখানে যে সঙ্গিত রচিত হয়েছে তার মূল উপাদান মানুষ এবং তার কর্মকান্ড, খোলা চত্বর এবং সূর্যের আলো, নানা ধরনের স্পেস এবং আকাশ এসব চিরন্তন উপাদানের নাটকীয় উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে। এ সবকিছুই কিন্তু স্থায়ী, মানুষ এটা জানেও। আপনি জানেন একটা বাড়ীতে সম্পূর্ণ গ্যাস বা অন্য কিছু ব্যবহার করলেও এ প্রাকৃতিক সম্পর্কগুলো কিন্তু বদলাবেনা। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিশ্বায়নে আমাদের বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ হতে হবে ব্যাপক। তাই উন্মুক্ততা হতে হবে ব্যাপক। আর কোন রকমে চালিয়ে নেবার মত বৈশিষ্ট্যগুলি কমে যেতে হবে। জনগণের উপলব্ধি দিন দিন ব্যাপক হচ্ছে অতীতের চেয়ে। আমাদের নিজেদেরকে এগিয়ে গিয়ে বলতে হবে, আপনারা আসুন, কারণ আমি নিশ্চিন্ত যে আমি আমার অবস্থানকে নষ্ট হতে দেবনা। আমি তখনই মানুষকে আমন্ত্রণ জানাবো যখন আমি নিশ্চিন্ত যে আমি কারও দাস হতে যাচ্ছি না। তাই আপনাকে আরও শক্তিশালী অথচ উদার হতে হবে।

জালাল: আপনি তাহলে মনে করেন এমন স্থাপত্য তৈরী করা সম্ভব যা তার সময়ের কথা বলবে যেমন ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলি বলতে পারছে 

দোশী: আমার মনে হয় চন্ডীগড় এসেম্বলি ভবন একটি বিশ্বজনীন স্থাপনা। কেউ কিন্তু বলছেনা এই স্থাপনা নিউ ইয়র্কেই মানাত এখানে নয়। সবাই আসছেন, দেখছেন, বলছেন এটা এখানেই সঠিক। কোন বিদেশী স্থপতি অথবা যে কেউ এখানে একটা গ্যাস টাওয়ার বানাতে পারেন কিন্তু চট করে তাকে  ভিনদেশী বলা ঠিক হবে না যদি তিনি সেটা এমন ভাবে যাতে সবাই বলে হা ঈশ্বর, আমি’ত এভাবে চিন্তাই করিনি। তাই বিশ্বায়ন আপনার কাছে হাজার হাজার ধারণার কথা বলছে এবং আপনারও অনমনীয় হবার কোন প্রয়োজন নেই, কিন্তু নিজের স্বকীয়তাকেও বিসর্জন দেয়ার প্রয়োজন নেই। এটাই আসল কথা।

আপনার মতামত দিন

কমেন্ট

Logo
Logo
© 2024 Copyrights by Sthapattya o Nirman. All Rights Reserved. Developed by Deshi Inc.