স্থপতি মাজহারুল ইসলাম

স্থাপত্য ও নির্মাণ
সংলাপ
১৫ জুলাই, ২০২৪
১০১
স্থপতি মাজহারুল ইসলাম

বাংলাদেশের যে স্থপতি সর্বপ্রথম এদেশে আধুনিক স্থাপত্য সূচনা করেন তাঁর প্রখর সৃষ্টিশীল মেধা দূরদৃষ্টি নিয়ে, তিনি হলেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। তিনি এদেশে স্থাপত্য পেশা চর্চারও পথিকৃত। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের এই সাক্ষাতকারটি 'স্থাপত্য নির্মাণ' পত্রিকার ১ম সংখ্যায় (জানুয়ারী-মার্চ, ১৯৯২) ছাপা হয়েছিল, স্থাপত্য পেশার আলোকে আলোচনার বহুলাংশ এখনও সমভাবে প্রাসঙ্গিক। সাক্ষাতকারটি সকলের জন্য বর্তমান ওয়েব ফরম্যাটে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের যে স্থপতি সর্বপ্রথম এদেশে আধুনিক স্থাপত্য সূচনা করেন তাঁর প্রখর সৃষ্টিশীল মেধা দূরদৃষ্টি নিয়ে, তিনি হলেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। তিনি এদেশে স্থাপত্য পেশা চর্চারও পথিকৃত। স্থাপত্য-শিল্পের বেশ কয়েকটি বিষয়ে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়ে থাকে, যেমন তিনি এদেশের সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি এবং স্থাপত্য প্রতিযোগিতার বিচারক, তিনি স্থপতি ইনষ্টিটিউটের প্রথম সভাপতি। তিনি এদেশের স্থাপত্য শিক্ষা, বিশেষ করে চর্চার জন্য, নবীন স্থপতিদের সম্মুখে পৃথিবীর বিখ্যাত স্থপতিদের নিয়ামক কাজের দৃষ্টান্তগুলি তুলে ধরার জন্যে এবং তার থেকে শিক্ষা নেবার জন্যে সদা সচেষ্ট ছিলেন। তিনি এদেশের কৃষ্টি, সভ্যতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিক স্থাপত্য ভাবধারা সম্বলিত নান্দনিকতা, ব্যবহারিকতা উপকরনের সার্থক সমন্বয় করতে সফলকাম হন। তিনিই এদেশে ঐতিহ্যবাহী ইটকে লাইনবন্দী, সরাসরি উন্মুক্ত, পলেস্তরাহীন করে পুরাতন রীতিকে নবতররূপে উপস্থাপনা করেন।

Images

স্থপতি মাজহারুল ইসলাম

জন্মঃ ১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর

শিক্ষা: ১৯৪২ সালে, বিজ্ঞানে স্নাতক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

১৯৪৬ সালে পুরকৌশলে স্নাতক, শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

১৯৫২ সালে স্থাপত্যে স্নাতক, অরিগন বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাষ্ট্র,

১৯৫৭ সালে ট্রপিকাল স্থাপত্য বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা, . . স্কুল লণ্ডন

১৯৬১ সালে স্থাপত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র।

 

স্থপতিদের নবীনতম প্রজন্মের চারজন, আসিয়া চৌধুরী, শাহেদুর রহমান, বিকাশ সাউদ আনসারী এবং রফিক আজম। ওঁরা সহপাঠী এবং একসাথে কাজ করেন। স্থাপত্য নির্মানের পক্ষে এই নবীন চারজন স্থপতি এদেশের প্রবীনতম স্থপতি মাজহারুল ইসলালামের সাথে একটি আলোচনায় যোগ দেন, তাঁর দীর্ঘ পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতা এবং ভিন্নধর্মী কর্মকান্ডের প্রেক্ষিতে কিছু আলোচনা।

. বর্তমানে বাংলাদেশে কিছু স্থপতি আন্তর্জাতিক স্থাপত্য ধারার প্রভাব বলয়ে থেকেও আকৃতি, কাঠামো, উপাদান এবং পরিসরের বিন্যাসে একটি দেশীয় স্থাপত্য ধারা সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছেন। চেষ্টা আমাদের স্বকীয়তা সৃষ্টিতে কতটুকু সহায়ক হবে বলে আপনি মনে করেন?

মাজহারুল ইসলাম : বাংলাদেশের স্থাপত্য ঐতিহ্য অতি প্রাচীন। আদীতে গ্রামীন সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের স্থাপত্য গড়ে উঠেছিল। পরিসর বিন্যাসে নিজস্বতা সম্বলিত বাঁশ, কাঠ, মাটি ছনের তৈরী বাড়ী ঘর এদেশীয় স্থাপত্যকে করেছে স্বকীয়। পাশাপাশি ইটের তৈরী কিছু ঘরবাড়ী, ধর্মীয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের স্থাপত্য ঐতিহ্যের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। উদাহরণ হিসাবে খৃষ্টপূর্ব ৩৫০ সালে নির্মিত মহাস্থানগড়, ৮ম-১১শ শতাব্দীতে নির্মিত ময়নামতি পাহাড়পুর বিহার ইত্যাদির কথা বলা যায়। তাছাড়াও মুঘল-পূর্ব সুলতানদের সময়ে পলেস্তরাবিহীন ইটের বহু দালানকোঠা নির্মিত হয়েছে। পরে মুঘলদের সময় ইটের তৈরী পলেস্তার করা দালানকোঠাও আমাদের ঐতিহ্যে অঙ্গীভূত হয়েছে। আগে আমাদের এখানে সামাজিক চালচিত্র ছিল পৃথিবীর অন্যান্য দেশের থেকে আলাদা। পার্থেনন কে তৈরী করেছিলেন তা আমরা জানি, ইউরোপের এবং বিভিন্ন দেশের অনেক পুরানো দালান কোঠার স্থপতিদের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের এই উপমহাদেশের কোন পুরোনো অট্টালিকা, দালান, মন্দির, মসজিদ কে ডিজাইন করেছিলেন তা জানা কঠিন ; অর্থাৎ কোন কোন কাজ এককভাবে না করে সামাজিক ভাবে করার রেওয়াজ ছিল এই অঞ্চলের জীবনের একটি সুন্দর দিক। কিন্তু বৃটিশ রাজত্বের ১৯০ বছরে হাজার বছর ধরে গড়ে উঠা সভ্যতা প্রায় ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। একদিকে উপমহাদেশের সম্পদ হরন করে তারা নিজেদের দেশ গড়ে তুলেছিল, আর একদিকে আমাদেরকে করেছে গরীব। শুধু গরীবই হইনি আমরা, আমদানিকৃত সস্তা উপাদান, চিন্তা চেতনা, ধ্যান ধারনা চাপিয়ে দিয়ে সামগ্রিকভাবে আমাদের নন্দিত চেতনাকেও সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করা হয়েছে। 

15site Plan

চারুকলা ইনিস্টিটিউট-এর প্ল্যান

আমাদের গ্রামীন সমাজে ছিল পঞ্চায়েত। সমাজকল্যান মূলক কাজকর্ম পঞ্চায়েতের মাধ্যমে হতো। জমিদাররা খাজনা আদায়ের সংগে সংগে রাস্তা, ঘাট, পুকুর নির্মান রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বৃটিশরা আমাদের সামাজিক কাঠামোকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। বৃটিশদের ১৯০ বছরের রাজত্বকালে অঞ্চলের স্থাপত্যের ধারাবাহিকা নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমান স্থাপত্য ধারার সংগে তাই ঐতিহ্যগত স্থাপত্য ধারার ১৯০ বছরের একটা ব্যবধান সৃষ্টি হয়ে রয়েছে। অবশ্য চল্লিশের দশক থেকেই আমরা স্থাপত্যে আমাদের পরিচয় সমস্যা নিয়ে সচেতন হয়েছি। পঞ্চাশ ষাটের দশকে ইউরোপ, আমেরিকায় শিক্ষাপ্রাপ্ত দেশীয় স্থপতিরাও এককভাবে এবং সমষ্টিগতভাবে চেষ্টা করেছেন নতুন ধরনের বাড়ী, ঘর, অট্টালিকা ইত্যাদি ডিজাইন করতে। সঙ্গতঃ কারনেই পূর্বে সেই প্রকারের কোন বাড়ী ঘরের অস্তিত্ব ছিল না আমাদের দেশে। যেমন, লাইব্রেরী, হাসপাতাল, সংসদ ভবন, অফিস, ইত্যাদি। কাজের ক্ষেত্রও প্রসারিত হয়েছে বিস্তৃতভাবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যে, গরুর গাড়ী এবং বিমান পাশাপাশি অবস্থান করছে। সুতরাং স্থপতিদের যথেষ্ট সচেতনভাবে কাজ করতে হচ্ছে। নির্মিত দালান হতে হবে সমসাময়ীক অর্থাৎ সময় উপযুক্ত। একদিকে বাংলাদেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি, জলবায়ু, সময়ের সঠিক প্ৰকাশ ঘটাতে হচ্ছে স্থপতিকে, আবার স্থাপত্যে সারা দুনিয়ার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কাজ করতে হচ্ছে। দিক দিয়ে চিন্তা করলে বর্তমানে বাংলাদেশের স্থাপত্য অবস্থা আশাব্যঞ্জক। কিছু কিছু কাজ আছে যা দেশীয় চাহিদাকে অনেকখানি পুরন করতে পারছে বলে মনে করি। যেমন ধরুণ, লুই আই কানের লাল বাড়ীগুলো; অথবা সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সংসদ এলাকাটি। স্থাপত্যে দেশীয় ধারা সৃষ্টির কাজ এখন অবশ্য কর্তব্য। দেশীয় ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে; দুনিয়ার যে সব ভাল কাজ হচ্ছে সেগুলো বুঝতে হবে। সর্বপরি আমাদের প্রধান কর্তব্য দাড়াচ্ছে মনে প্রাণে এবং কর্মকাণ্ডে খাঁটী বাঙালী হওয়া। তা না হতে পারলে বাংলাদেশ অথবা দুনিয়ায় স্থাপত্যে মৌলিক অবদান রাখা কঠিন হবে।

২. বাংলাদেশে আধুনিক স্থাপত্য শিক্ষা ও চর্চা উভয় ক্ষেত্রেই আপনি একজন পথিকৃত। আপনার প্রথমদিকের স্থাপত্য চিন্তা ও দর্শনের সঙ্গে বর্তমান দর্শনের মধ্যে কি কোন ব্যবধান আছে?

মাজহারুল ইসলাম : মানুষ তার অভিজ্ঞতার আলোকেই বদলায়। ভুলত্রুটি থেকে শেখে। ১৯৫২ সালে স্থাপত্যে ডিগ্রী লাভের পর থেকেই আমি চেষ্টা করেছি মনে প্রাণে বাঙালী হতে। কাজটা অত্যন্ত কঠিন। এ জন্যে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছি। ফলে আমাকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫ এর মধ্যে দুটো বাড়ী (প্রকল্প) করার পর চাকুরী জীবনের দশ বছর আমার ডিজাইন করা কোন বাড়ী গড়তে দেয়া হয়নি। একইভাবে ১৯৭০ থেকে ১৯৭৯ কোন কাজ করতে দেয়া হয়নি। এখনও কোন কাজ দেওয়া হচ্ছে না । দেখা যাবে যে ছত্রিশ বছর পেশাগত জীবনের চব্বিশটা বছরই আমাকে কর্মহীন জীবনযাপন করতে হয়েছে। ফলে কর্মহীনতা, সময়ের পরিবর্তন, অভিজ্ঞতার সংযোজন সব মিলিয়ে স্থপতি হিসাবে আমিও বদলেছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আমার চিন্তাধারায় পরিবর্তনের ছাপ ফেলেছে। এরই মধ্যে খ্যাতিমান অনেক স্থপতি যেমন পল রুডলফ, লুই কান, টাইগারম্যান, বিভি দোশী, চার্লস কোরীয়া, এদের সঙ্গে মতের আদান-প্রদান হয়েছে, বন্ধুত্ব হয়েছে, বদলেছে আমার চিন্তাধারা। ডিজাইন দর্শনে এসেছে নতুন ভাবনা। 

Muzharul Islam Bv Doshi Samsul Wares

স্থপতি বি, ভি, দোশী এবং স্থপতি শামসুল ওয়ারেসের  সংগে

প্রথমদিককার কয়েকটি কাজ বাদে আমি চেষ্টা করেছি যতদুর সম্ভব মৌলিক দেশজ উপাদান ইটকে কাজে লাগাতে। আমার মনে হয় ইটের এবং পোড়ামাটিজাত দ্রব্যের ব্যবহার বাংলাদেশের স্থাপত্যের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত, যা প্রাচীনকাল থেকে এদেশে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আর এই ব্যবহারের ক্ষেত্রে সৎ থাকার চেষ্টা করেছি, অর্থাৎ, পলেস্তরা ব্যবহার না করে ইটকে ইট হিসাবেই দেখতে চেয়েছি। সর্বপরি, যে কাজই করেছি সচেতনভাবে করেছি। সব সময়েই বাংলাদেশের কথা এবং আমার সীমিত জ্ঞানের কথা মনে রেখেছি। আমাদের সকলের এটাও মনে রাখা উচিত যে স্থাপত্যে বিংশ শতাব্দীতে যে বিপ্লব এসেছে তার থেকে আমাদের সমাজ সরে থাকতে পারবে না। আমরা একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে কিন্তু পড়ে আছি মধ্যযুগীয় ব্যবস্থায়। উত্তরণ করতেই হবে, এবং সেটা সম্ভব কেবল দেশের সকল মানুষকে নিয়ে এবং তাদের জন্যেই।
 

Mazharul Islam Jaipur Hat Industrial Housing 18

জয়পুরহাট চুনাপাথর প্রকল্প

Mazharul Islam Jaipur Hat Industrial Housing 20

জয়পুরহাট চুনাপাথর প্রকল্প

 

৩. সাধারণতঃ স্থপতিরা অভিজ্ঞ প্রবীন স্থপতিদের সাথে কাজ করে পেশাগত নৈপুন্য অর্জন করে থাকেন। বর্তমানে আমাদের দেশে এই প্রথা বিলুপ্ত প্রায়। এর ফলে কি মানসম্পন্ন স্থাপত্য সৃষ্টি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে না?

মাজহারুল ইসলাম: সারা বিশ্বেই নবীন স্থপতিরা প্রবীন স্থপতিদের কাছে কাজ শেখেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্থপতি সংস্থাগুলি অর্থাৎ স্থপতি ইনষ্টিটিউট অথবা এসোসিয়েশনগুলি এই নিয়ম মেনে চলে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নিয়ম। আমেরিকায় বোধ হয় তিন বছর, বিলেতে দুই বছর এপ্রেনটিস্সীপ লাগে। এই এপ্রেনটিস্সীপের নিশ্চয়ই সঙ্গত কারণ আছে। আমার জানামতে রুডলফ, তাঙ্গে, দোশী, কোরিয়া, সকলেই কোন না কোন স্থপতির সঙ্গে কাজ করেছেন দুই-তিন বছর। বিদেশে সকল স্থপতিকেই এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে এ দেশের বর্তমান পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জন নয়। এ দেশের স্থাপত্য চর্চার শুরুতে এ প্রথা ছিল। বর্তমানে নেই বললেই চলে। এর কারণ খুঁজতে গেলে আমাদের একটু গভীরে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। স্থাপত্য অনুশীলন মূলতঃ একই সঙ্গে একটি শিল্প এবং একটি পেশার কাজ। আবার এর একটি ব্যবসায়িক / অর্থনৈতিক দিকও আছে। এখানেই সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্বের। সমস্যা শুরু হয় তখনই যখন স্থাপত্যের শৈল্পিক মানকে ছাপিয়ে প্রাধান্য পায় কেবলই অর্থনৈতিক স্বার্থ। একজন স্থপতির কাজ হচ্ছে সামাজিক চাহিদা, অর্থনৈতিক দিক, কৃষ্টি-ঐতিহ্য এসব ব্যাপারে সচেতন থেকে শৈল্পিক মানসম্পন্ন স্থাপত্য রচনা করা। একইভাবে স্থপত্যে কাজ শেখার ব্যাপারে আগ্রহের উপরেও প্রাধান্য পাচ্ছে আর্থিক দিক। যেমন আমাদের অফিসে শিক্ষার্থী নবীনদের যে সম্মানী দেয়া সম্ভব, বাইরে তাঁরা এর থেকে দেড়গুণ অথবা দুইগুণ বেশী সম্মানী পেতে পারেন। ফলে তাঁরা আমাদের কাছে কাজ শেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এভাবে প্রবীনদের কাছে কাজ শেখার প্রথার বিলুপ্তি ঘটছে। তাছাড়া কাজ পাওয়ার ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম কানুন না থাকায় কোন কর্ম-অভিজ্ঞতা ছাড়াই নবীন স্থপতিরা অফিস খুলে বসেছেন। যার ফলে সৃষ্ট স্থাপত্যের মান নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এর মানে কিন্তু এ-নয় যে কোন নবীন স্থপতি সুন্দর এবং সুষ্ঠু কাজ করতে পারবেন না। দু'একজন প্রতিভাবান নবীন স্থপতি প্রথম থেকেই অতিসুন্দর কাজ করতে পারেন। এটা নিয়মের ব্যতিক্রম। এই কথা মনে রেখেই সকল নবীন স্থপতির জন্য আরও দুই/এক বছর প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্যেই এপ্রেনটিস্সীপ।

এ ছাড়াও আর একটা বিশেষ পরিস্থিতি বাংলাদেশের স্থাপত্য জগতকে প্রায় সম্পূর্নভাবে কব্‌জা করে ফেলেছে, যার সঙ্গে নবীনদের সোজাসুজি পেশায় ঢুকে পড়ার প্রবণতা জড়িত। আগেই বলেছি, স্থাপত্যের সঙ্গে টাকা পয়সার লেনদেন জড়িত। সভ্যজগতের পেশার নিয়ম মাফিক স্থাপত্য কাজের জন্য স্থপতি একটা ‘ফি' পান। এই ‘ফি সাধারণতঃ রাষ্ট্রের আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এবং স্থপতি কি কাজ এবং কতখানি কাজ দেবেন তাও পরিস্কারভাবে এবং বিস্তৃতভাবে আইন কানুনের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ। বাংলাদেশে কিছুই নাই। সুতরাং স্থাপত্য এখন বাংলাদেশে কিছু লোকের কাছে একটা ‘ব্যবসা'। তাই অনেক ব্যবসায়ী এখন এই ‘ব্যবসায়' লিপ্ত। তাদের বাংলাদেশী কায়দায় কাজ যোগাড় করার সবরকম পদ্ধতি করায়ত্ত। এই ব্যবসায়ীরা নবীন স্থপতিদের সহজেই টানতে পারেন। যে-সব স্থপতি পেশায় ন্যুনতম নিয়ম-কানুন এবং মান বজায় রেখে চলতে চান তাঁদের এখন কাজ পাওয়া অসম্ভব। এখন বাংলাদেশে চলছে 'হরির লুট' সৎ স্থাপত্য চিন্তা বর্তমানে দারুণ কঠিন।

Images (1)

বি. সি. এস. আই. আর ভবন 

Images (2)

নিপা ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

৪. এই সমস্যার সমাধান কিভাবে হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

মাজহারুল ইসলাম : স্থাপত্য সম্পর্কিত যে কোন সমস্যার সমাধান করতে হলে এই পেশাকে কতগুলি সৎ নিয়ম কানুনের মধ্যে আনতে হবে। এ ধরনের নিয়ম কানুন সারা বিশ্বের সকল সভ্য দেশেই আছে। সমাজতান্ত্রিক এবং ধনতান্ত্রিক উভয় সমাজেই। উভয় সমাজেই স্থাপত্য পেশা সম্পর্কিত নিয়মনীতির একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে স্থাপত্য পেশা এ ধরনের কোন নিয়ম-কানুনের মধ্যে পড়ে না। আমাদের দেশে স্থাপত্য পেশায় নিয়ম কানুনের অভাবের সঙ্গে সঙ্গে সততারও অভাব দেখা দিয়েছে। এদেশের স্থপতিদের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগন্য, অথচ নিজেদের মধ্যে দ্বন্দের কারনে আমরা সমষ্টিগতভাবে স্থাপত্য পেশাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছিনা। এক্ষেত্রে ইনষ্টিটিউটের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। স্থাপত্য পেশায় এখন দরকার সার্বিকভাবে আইনের নিয়ন্ত্রণ। ডিজাইন কি কি হবে, অথবা, একজন স্থপতি তাঁর ক্লায়েন্টকে ন্যুনতম কি পরিমান কাজ দেবেন, ইত্যাদি বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা নির্মানের প্রয়োজন রয়েছে। যদি আমাদের দেশে এ ধরনের নিয়মকানুন থাকতো, তবে অভিজ্ঞ স্থপতিদের কাছে কাজ শেখার প্রথাটা স্থাপত্য শিক্ষার একটা অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত হত। কর্ম-অভিজ্ঞতার লাভটাও একটা নিয়মের মধ্যে দিয়ে এগুতো। সম্মানি প্রদানেও একটা সুনির্দিষ্ট মান রক্ষা করা যেত।


 

আপনার মতামত দিন

কমেন্ট

Logo
Logo
© 2024 Copyrights by Sthapattya o Nirman. All Rights Reserved. Developed by Deshi Inc.