প্রকল্পের নাম: অ্যাপটেক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক প্রকল্পের অবস্থান: কাশিমপুর, গাজীপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ আর্কিটেকচারাল কনসাল্টেন্ট ফার্ম: স্থাপতিক ক্লায়েন্ট: বিগ বস কর্পোরেশন মোট জমির পরিমাণ: ৪২৭৮৩.৩৭ বর্গমিটার মোট নির্মিত এলাকা: ৮৬৬৩৫ বর্গমিটার প্রকল্প আরম্ভ: ২০১৪ প্রকল্প সমাপ্তি: ২০২১ ব্যয়: ২৩,২৮,৩১৫,৬২৫ টাকা প্রধান স্থপতি: স্থপতি মোঃ শরীফ উদ্দিন আহমেদ ও স্থপতি তৌহিদ ইমাম সহকারী স্থপতি: স্থপতি রাইসা সাদিয়া, স্থপতি সাদেকা বদিউজ্জামান স্ট্রাকচারাল কনসাল্টেন্ট: স্পেস ডিজাইন কনসোর্টিয়াম ইলেকট্রিক্যাল ইন্জিনিয়ার: ইন্জিনিয়ার মোঃ রফিকুল ইসলাম লেখা: স্থপতি হাজেরা এশা ফটোগ্রাফি: দ্য বিগ পিকস, প্রিসলি গোমেজ, আরিফুল ইসলাম সুহাস, এহসানুল আলম, মামুনুর রশীদ চৌধুরী পুরস্কার ও প্রকাশনা: দুটি লিড প্লাটিনাম সার্টিফাইড অ্যাওয়ার্ড, কনটেক্সটবিডিতে প্রকাশিত প্রতিবেদন |
বিশ্বব্যাপী তৈরিপোষাক শিল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বানানো পোশাকের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তৈরি পোষাকশিল্পের এই অগ্রগতি আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। একইসাথে, এইসব তৈরি পোষাকশিল্পের কারখানায় প্রচুর কাজের সুযোগ তৈরি হওয়ায় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
একটি আদর্শ শিল্প-কারখানার উদাহরণ হিসেবে ‘অ্যাপটেক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ প্রকল্পটি নকশা করা এবং বাংলাদেশের পরিচয়কে তুলে ধরবে এমন একটি শিল্প-কারখানা স্থাপন করাই ছিল এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। |
স্থাপত্যের ধারণা (কনসেপ্ট): বাংলাদেশে তৈরি পোষাকশিল্পের (রেডিমেড গার্মেন্টস) – এর মানসম্মত পণ্যের চাহিদার কারণে কারখানাগুলোর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিশ্বব্যাপী পোষাকশিল্পের খাতে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ স্লোগানটি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। আমাদের দেশে পরিবেশবান্ধব শিল্প-কারখানা তৈরি করা এখন সময়ের দাবী। একটি পরিবেশ-বান্ধব শিল্প-কারখানা তৈরির জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন পড়ে, যেমন- জলবায়ুর প্রতি সহনশীল স্থাপনা তৈরি, স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করা যা আশেপাশের পরিবেশের সাথে মিশে যায় এবং ক্ষতির মাত্রা কমায়, যথেষ্ট পরিমাণে সবুজ পরিবেশ অন্তর্ভুক্ত করা ইত্যাদি। এসকল উদ্দেশ্য সফল করাই ছিল এ প্রকল্পের মূল প্রেরণা। |
সাইট এবং কনটেক্সট বিশ্লেষণ: বিভিন্ন স্বনামধন্য তৈরি পোষাক রপ্তানিকারকদের কারখানা এবং শিল্প পার্কের আশ্রয়স্থল গাজীপুর। কাঁচামাল এবং যাতায়াতের বহুমুখী পরিবহণ ব্যবস্থা ব্যবস্থা থাকার ফলে ব্যবসা স্থাপনের জন্য একটি কার্যকর স্থান হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এটি বাংলাদেশের শিল্পকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। অ্যাপটেক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কটি গাজীপুরের কাশিমপুরে অবস্থিত। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে এটি ৩৩ কি.মি. দূরে অবস্থিত। সাইটের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে একটি গার্মেন্টস এবং সোয়েটার প্রস্তুতকারক কারখানা রয়েছে এবং দক্ষিন-পশ্চিম পাশে ‘অ্যাপটেক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক স্টাফ কোয়ার্টার’ রয়েছে। এছাড়া, সাইটের চারদিকে প্রচুর খোলা জায়গা রয়েছে এবং সাইটের কাছাকাছি খুব একটা ঘনবসতি নেই, যা একটি শিল্প-কারখানা তৈরির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ বলা যায়। সাইটের পুরো এলাকা ১০.৫৭ একর (৪২৭৮৩.৩৭বর্গ মিটার)। সাইটটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত, তাই আমাদের দেশের জলবায়ু অনুসারে একটি আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি কাঠামো উত্তর-দক্ষিণমুখী করার পরিকল্পনা করা সম্ভব। |
ছবি: লোকেশন ম্যাপ
ছবি: পাখির চোখে অ্যাপটেক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক |
|
নকশা বিবেচনা: একটি শিল্প-কারখানার জন্য ন্যূনতম ফুটপ্রিন্ট রেখে খোলা জায়গার পরিমাণ যথাসম্ভব বেশি রেখে কাঠামো নির্মাণ করা এবং সাইট এরিয়াটির মাইক্রোক্লাইমেট উন্নত করা ছিল এ প্রকল্পের ডিজাইনের মূল লক্ষ্য। শিল্প কারখানাগুলোতে বিভিন্ন ধরণের জটিল ফাংশন থাকার কারণে এর নকশায় প্রচুর ভবন ডিজাইনের প্রয়োজন হয়, ফলে খোলা জায়গা বা সবুজের পরিমাণ কমে যায়। ফলে একটি অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়। এই প্রকল্পে নকশার মূল বিবেচনার একটি ছিল প্রতিটি আলাদা ফাংশনের জন্য আলাদা স্পেস প্রদানের মাধ্যমে কিভাবে গ্রাউন্ড কভারেজ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। নির্মাণ কাঠামোগুলো আয়তনে বড় হলেও, ডিজাইন পদ্ধতিতে সবুজের পরিমাণকে প্রাধান্য দিয়ে ভবনের সংখ্যা যথাসম্ভব কম রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। একইসাথে, আরামদায়ক পরিবেশ তৈরির জন্য নকশায় বিভিন্ন জায়গায় সবুজ সার্ফেস অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পার্কটিতে প্রতি শিফটে ১০,০০০ জন কাজে নিযুক্ত থাকেন। এ কারণে, শিল্প-কারখানার বিশাল কাজের চক্রটি ঠিকভাবে চলমান রাখার জন্য হরাইজন্টাল এবং ভার্টিক্যাল সার্কুলেশন ঠিক রাখাও ছিল এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। |
মাস্টারপ্ল্যান: এ প্রকল্পে, বিশাল শ্রমিক দলের জন্য সাইটের প্রবেশ্মুখে একটি প্রিপারেশন স্পেস নকশা করা হয়। প্রকল্পটিতে বিল্ডিংগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নকশা করা হয়েছে, যেন দর্শনার্থীরা পুরো এলাকাটি সানন্দে ঘুরে দেখতে পারেন। অ্যাপটেক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে জোনিং-এর পরিকল্পনা বেশ কিছু বিষয়ের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। যেমন: উচ্চ-ভলিউমযুক্ত ট্রাফিকের তত্ত্বাবধান করা, শিল্প-কারখানার ফাংশনগুলোর জটিলতা পরিহার করা এবং আগুনের ঝুঁকি এড়ানো – এ সকল দিক বিবেচনা করে এ পার্কে সর্বমোট ১০টি বিল্ডিং নকশা করা হয়। গ্রাউন্ড কভারেজ কমিয়ে আনার জন্য বিল্ডিংগুলোর ফ্লোর সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়। |
ছবি: বাবল ডায়াগ্রাম |
ছবি: ফ্লো চার্ট |
আনুষঙ্গিক বিল্ডিংগুলো প্রবেশপথের দক্ষিণে নকশা করা হয়েছে। সাইটের মাঝখানে সেলাই এবং ফিনিশিং বিল্ডিং একে অপরের মুখোমুখি নকশা করা হয়েছে। ডাইনিং এবং কিচেন ভবনটি পশ্চিম পার্শ্বের দেয়ালের সাথে এবং একটি পাটের বয়লারের সাথে কোণাকুণিভাবে নকশা করা হয়েছে। ওয়াশিং প্ল্যান্ট, ওয়াশিং স্টোর, ইটিপি এবং ইউটিলিটি বিল্ডিং পার্কের উত্তরদিকে অবস্থিত। আরেকটি পাটের বয়লার উত্তর সীমানা প্রাচীরের কাছে ওয়াশিং প্ল্যান্ট বিল্ডিং-এর পাশে নকশা করা হয়েছে। রেস্ট হাউসটির গোপনীয়তার জন্য পার্কের পূর্ব দিকে একটি জলাশয় দ্বারা এটিকে পৃথক করা হয়েছে। |
১. সেলাই-এর বিল্ডিং: নমুনা নির্বাচন, আনুষঙ্গিক দোকান, কাঁচামাল গো-ডাউন, সেলাই ওয়ার্কস্টেশন। ২. ফিনিশিং বিল্ডিং: ওয়ার্কস্টেশন ফিনিশিং, ফিনিশিং গো-ডাউন, মনিটরিং জোন। ৩. ডাইনিং এবং কিচেন বিল্ডিং: ডাইনিং এরিয়া, রান্নাঘর, প্যান্ট্রি, স্টোর ৪. ওয়াশিং প্ল্যান্ট বিল্ডিং: নমুনা নির্বাচন এবং পরীক্ষাগার এলাকা, ফাইনিং অফিস, ট্যাগিং, পরিমাপ পরীক্ষা, লোহা, লেবেলিং, ইত্যাদি ৫. ওয়াশিং স্টোর এবং ইটিপি: এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান, ওয়াটার ট্যাঙ্ক। ৬. ইউটিলিটি বিল্ডিং: জেনারেটর, সাবস্টেশন, কম্প্রেসার, বয়লার এলাকা, জল সরবরাহ ট্যাঙ্ক ৭. পাটের বয়লার: ২ টি ৮. রেস্ট হাউস: ১৬টি গেস্ট রুম, মিটিং রুম, কমিউনিটি স্পেস। ৯. আনুষঙ্গিক বিল্ডিং: হেলথ কেয়ার ইউনিট, চাইল্ড কেয়ার ইউনিট, সিকিউরিটি অ্যান্ড কন্ট্রোল ইউনিট, ইন্ডাস্ট্রির অফিস ইত্যাদি। |
ছবি: কনসেপচুয়াল স্কেচ |
ছবি: মাস্টারপ্ল্যান |
ছবি: সার্কুলেশন ম্যাপ |
ফ্যাসাদ ট্রিটমেন্ট: বিল্ডিংগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য এবং আউটলুক অনেকটাই ‘জাতীয় সংসদ ভবন’ দ্বারা অনুপ্রাণিত। দক্ষিণ এবং পশ্চিম ফ্যাসাদে ভার্টিক্যাল ল্যুভর ব্যবহার করা হয়েছে। পশ্চিম ফ্যাসাদের ল্যুভরগুলো এঙ্গুলার করে রাখা হয়েছে, যাতে সরাসরি সূর্যের আলো প্রবেশ না করে এবং প্রাকৃতিক আলো-বাতাস প্রবেশের মাধ্যমে একটি আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করে। এ এঙ্গুলার ল্যুভরগুলোর কারণে বিশাল আয়তনের সেলাই এবং ফিনিশিং বিল্ডিংয়ের আয়তন কম মনে হয়। |
ছবি: গ্রাউন্ড ফ্লোর প্ল্যান (সেলাই এবং ফিনিশিং বিল্ডিং) |
অগ্নি-নিরোধক ব্যবস্থা: আরএমজি (রেডিমেড গার্মেন্টস) শিল্পে আগুনের ঝুঁকি হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। ঝুঁকি এড়াতে এ প্রকল্পে অগ্নি-নিরোধক ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেলাই এবং ফিনিশিং-এর বিল্ডিংগুলো আয়তনে সবচেয়ে বড় বিল্ডিং এবং সবচেয়ে জটিল ফাংশনগুলো পরিচালনা করে। সেলাই এবং ফিনিশিং-এর বিল্ডিংয়ের সকল আগুনের সিঁড়ি (Fire stair) এবং লিফটগুলি মূল বিল্ডিং ফুটপ্রিন্ট থেকে আলাদা। ফায়ার কোরগুলো ৩ মিটার ব্রীজ দ্বারা সংযুক্ত করা হয়েছে, যেন বিশাল ওপেনিংগুলোর মধ্য দিয়ে বায়ু (পজিটিভ) চলাচল করতে পারে। |
|
ছবি: জানালা ডিটেইল (১) |
ছবি: জানালা ডিটেইল (২) |
অন্যান্য সুবিধাসমূহ: শিল্পের উৎপাদন এবং আয়তনের দিক হতে অ্যাপটেক হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পোশাক শিল্প-কারখানাগুলোর মধ্যে একটি। প্রকল্পের শুরু থেকেই ক্লায়েন্ট চেয়েছে একটি সাপোর্টিভ সিস্টেমের মাধ্যমে প্রগতিশীল উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরি করা। এ কারণে, স্থপতিরা একটি আইকনিক নকশা তৈরি করার সাথে সাথে সেখানকার কর্মীদের জন্য একটি ইতিবাচক এবং সাপোর্টিভ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার দিকেও মনোনিবেশ করেন। এছাড়াও, প্রকল্পটিতে কর্মীদের জন্য যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা (স্বাস্থ্য ও মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা, একটি চাইল্ড কেয়ার ইউনিট, শ্রমিক কল্যাণ সংস্থা – Worker Welfare) ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বর্তমানে ১০ হাজার কর্মী এখানে মর্যাদা এবং গর্বের সাথে কাজ করছে। |
ছবি: সেলাই বিল্ডিং-এর প্ল্যান |
২. রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং: জরুরী অবস্থার জন্য নির্মিত জলাধারে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করা হয়। রেস্ট হাউসের সামনে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং পুকুরটি পরিবেশকে শীতল করে। একইসাথে পুকুরটির মাধ্যমে শিল্প এলাকা এবং আবাসিক এলাকা পৃথক করা হয়।
৩. নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত উপাদান: এ পার্কের গ্রাউন্ড কভারেজ মোট সাইট এরিয়ার মাত্র ৪১.৩৬%। প্রকল্পের নির্মাণকাজে টেকসই উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে, যা একইসাথে অপারেটিং খরচ কমায় এবং রক্ষণাবেক্ষণেও সুবিধা হয়। স্থানীয় ইট এবং ফেয়ার-ফেসড কংক্রিট হলো প্রকল্পের প্রধান উপকরণ। কনক্রিট কলাম-বিম স্ট্রাকচার ব্যবহার করা হয় এ প্রকল্পে, যা সহজে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় এবং নির্মাণ কাজের জন্য সাশ্রয়ী। |
শিল্প-কারখানার চিরাচরিত গঠন হতে একটু ভিন্নভাবে, শুধুমাত্র একটি কারখানা হিসেবে চিন্তা না করে একটি পার্ক হিসেবে এ প্রকল্পটি নির্মাণ করা হয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষের কাছে এটি একটি উপভোগ্য স্থান হতে পারে। আমাদের দেশের শিল্প-কারখানাগুলোর জন্য এ প্রকল্পটি নিঃসন্দেহে একটি অন্যতম উদাহরণ। |
সম্পাদনায় : স্থপতি ফাইজা ফাইরুজ |