প্রকল্পের নাম: মায়ের আঁচল (অবকাশ যাপনের বাড়ি) অবস্থান: ৩৬, শহীদ গোলাম কিবরিয়া, তাজু সড়ক, উত্তর শাওতা, মানিকগঞ্জ, ঢাকা ক্লায়েন্ট: মিসেস সাজেদা খানম মোট নির্মিত এলাকা: 12,285 বর্গ ফুট প্রকল্প সমাপ্তি: 2022 প্রধান স্থপতি: স্থপতি আফসানা লুকমান, স্থপতি খালিদ আহমেদ খান সহযোগী স্থপতি: স্থপতি খায়রুল আনাম অপু স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার: ইএসআই (ESI) ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার: জাহিদ হাসান ফটোগ্রাফার: আসিফ সালমান |
|
|
‘মায়ের আঁচল’- প্রকল্পের নাম হতেই খানিকটা আঁচ করা যায় বাড়ি তৈরির মূল ধারনাটি। এ প্রকল্পটি কেবলমাত্র বসবাসের উপযোগী একটি ঘরই না, এটি একটি আবেগমাখা যাত্রা, অতীত স্মৃতির সাথে স্থাপত্যের মেলবন্ধন।
ছয় ভাইয়ের পরিবার, যাদের শিকড় রয়েছে ৩৫ বছর আগে তাদের মায়ের তৈরি পুরনো বাড়িতে, কিছুটা গ্রামীণ আবহ ধরে রেখে সেটির সম্প্রসারণই হলো ‘মায়ের আঁচল’ প্রকল্প। |
|
স্থাপত্যের ধারণা (কনসেপ্ট): পুরনো বাড়িটি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান এবং উৎসবের অসংখ্য স্মৃতির সাক্ষী ছিল। বাড়িটির বারান্দা, গাছের ছায়ায় বসার জায়গাগুলোতে পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়ে আড্ডা-গল্পে মশগুল থাকত। এই বিষয়টিই নতুন বাড়িটির পরিকল্পনায় একটি মুখ্য ভূমিকা হিসেবে কাজ করেছে। প্রকল্পটির মূল ভাবনা ছিল - এটি হবে এমন এক আশ্রয়, যা পরিবারের সকল সদস্যকে একত্রে ধরে রাখবে, ঠিক যেমন একটি গাছের শিকড় চারপাশের মাটি আঁকড়ে ধরে রাখে। ডিজাইনের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল, পুরনো বাড়িটির আবহ ধরে রেখে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা, যা চারপাশের প্রকৃতির সাথে মিশে যাবে। |
|
সাইট এবং কনটেক্সট বিশ্লেষণ: এই প্রকল্পটি মানিকগঞ্জ জেলার কেন্দ্রীয় শহরের কাছে উত্তর শাওতার শহরতলিতে অবস্থিত একটি অবকাশ যাপনের বাড়ি (Vacation house)। ঢাকা-আরিচা হাইওয়ে হয়ে শহীদ রফিক সড়ক দিয়ে তাজু সড়ক হতে প্রকল্পের সাইটে প্রবেশ করা হয়। সাইটের পূর্ব পাশে একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং বাকি তিন পাশে কিছু বসতবাড়ি রয়েছে। এছাড়াও, সাইটের চারদিকে প্রচুর গাছপালা রয়েছে এবং সাইটের কাছাকাছি খুব একটা ঘনবসতি নেই। |
নকশা বিবেচনা: বাড়িটির স্পেসগুলোকে একটি কেন্দ্রীয় উঠোনের চারদিকে সাজিয়ে ফর্মাল, সেমি-ফর্মাল এবং প্রাইভেট স্পেসগুলোর ডিজাইনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। উঠোনের চারপাশে এ স্পেসগুলো এমনভাবে ডিজাইনের চিন্তা করা হয়েছে, যেন বারান্দা এবং করিডোরগুলোর মধ্যে অবাধ সংযোগ থাকে, একইসাথে প্রতিটি স্পেসের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তাও বজায় থাকে।
|
মাস্টারপ্ল্যান: প্রকল্পটির সাইটের পশ্চিম পার্শ্বে পুরনো বাড়িটি রয়েছে। এর সাথেই কিছু টিনের ছাদযুক্ত কুটির রয়েছে, যা চারপাশের গ্রামীণ পরিবেশের সাথে সহজেই মিশে যায়। সাইটের পূর্ব পাশে নতুন বাড়িটি ডিজাইন করা হয়েছে। বিভিন্ন স্পেসগুলো নতুন এবং পুরনো ফর্মগুলোর মাঝে একটি দৃশ্যত সংযোগ তৈরি করে – আউটডোর হতে ইনডোর, ইনডোর হতে সেমি-আউটডোর এবং সেমি-আউটডোর হতে খোলা টেরাসের দিকে নিয়ে যায়, যা এরপর সবুজ বাগানের মাধ্যমে পুরনো কোর্টইয়ার্ডের সাথে মিশে যায়। |
গ্রাউন্ড ফ্লোর প্ল্যান |
|
নতুন বাড়িটিতে একটি ইন্টার্নাল কোর্ট রয়েছে। এর দু’পাশে করিডোর, একপাশে একটি ওপেন প্লাজা রয়েছে। প্লাজার একপাশে লিভিং রুম এবং অপরপাশে ফ্যামিলি লিভিং রুম রয়েছে। ফ্যামিলি লিভিং রুমের একপাশে রয়েছে রান্নাঘর এবং আরেকপাশে রয়েছে একটি বড় বারান্দা (সেমি-আউটডোর স্পেস)। নিচতলায় এবং দোতলায় ২টি করে বেডরুম ও ১টি করে মাস্টার বেডরুম রয়েছে। দোতলায় আরও রয়েছে একটি ওপেন প্যাভিলিয়ন, একটি ওপেন টেরাস, একটি ছোট ফ্যামিলি লিভিং। নিচতলায় সেমি-আউটডোরে বসার জায়গা, ওপেন প্লাজা হতে বড় বড় সিঁড়ির মাধ্যমে বাইরের ল্যান্ডস্কেপের সংযোগস্থল, ওপেন টেরাস এবং ওপেন প্যাভিলিয়নগুলো পরিবারের সদস্যদের একত্রিত হওয়ার জায়গা, যা পুরনো বাড়িটির সামনের উঠোনের আবহ ধরে রাখে। উঁচু ছাদের কাঠামোটি একজন মায়ের প্রসারিত বাহু তার সন্তানদের আলিঙ্গনের একটি কাল্পনিক চিত্র স্থাপন করে। |
|
ভবনে ব্যবহৃত উপাদানসমূহ: ভবনটি একটি আরসিসি ফ্রেম কাঠামো দিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে, যার কলামগুলি বিচ্ছিন্ন ফুটিং (isolated footing)-এর উপর স্থাপিত। পিচ-রুফগুলি এমএস হোলো বক্স ট্রাস (MS hollow box truss) এবং পার্লিন (purlin) দিয়ে তৈরি করা হয়েছে যাতে মাটির ছাদের টাইলগুলি উপরে ধরে রাখা যায়। বেশিরভাগ কংক্রিটের সার্ফেসে কোনও ফিনিশিং উপাদান প্রয়োগ ছাড়াই একটি অ্যাস-কাস্ট লুক রাখা হয়েছে। ভবনের অধিকাংশ দেয়ালই কোনও প্লাস্টার ছাড়াই উন্মুক্ত ইটের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি। |
ড্রাইভওয়েতে ব্যবহৃত সিরামিক পেভার ব্লক ছাড়া বেশিরভাগ মেঝে স্থানীয়ভাবে তৈরি ম্যাট-ফিনিশড সিরামিক টাইলস দিয়ে তৈরি। স্লাইডিং, ফোল্ডিং এবং কেসমেন্ট জানালাগুলি আকার অনুযায়ী বিভিন্ন পুরুত্বের টেম্পার্ড গ্লাস ইনফিল সহ অ্যালুমিনিয়াম প্রোফাইল দিয়ে তৈরি। ভবনের ভেতরের দরজাগুলো প্লেইন ফ্লাশ দরজা এবং বাইরের পরিবেশের সংস্পর্শে থাকা সমস্ত দরজা সেগুন কাঠ দিয়ে তৈরি। এ প্রকল্পটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে করে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস অবাধে চলাচল করতে পারে। পিচ-রুফের এক্সটেনশন, কোর্টের চারপাশের করিডোরগুলো সরাসরি সূর্যের তাপ এবং ভারী বৃষ্টিপাত হতে ভেতরের পরিবেশকে রক্ষা করে। |
আসবাবপত্রের নকশা: এ প্রকল্পে আসবাবপত্রের ডিজাইন ছিল মূল ডিজাইনের একটি মুখ্য উপাদান। প্রতিটি আসবাবপত্র বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। এসব আসবাবপত্রের ডিজাইনগুলোতে অনুপ্রেরনা নেয়া হয়েছে বাড়ির পুরনো ফার্নিচার থেকে, যা পরিবারের সদস্যরা তাদের জীবনের বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করেছিল। মসৃণ ডাইনিং টেবিল এবং বিশ্রামের চেয়ারগুলি তৈরি করা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী নিম্ন-উচ্চতার টুলের ডিজাইন হতে অনুপ্রেরণা নিয়ে। |
‘মায়ের আঁচল’ প্রকল্পটি সমসাময়িক বাংলাদেশী স্থাপত্যের একটি উদাহরণ, একইসাথে এ প্রকল্প পরিবারের ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধ রক্ষার্থে স্থাপত্যের ভূমিকারও একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে। |
প্রতিবেদক: স্থপতি ফাইজা ফাইরুজ |