প্রকল্পের নাম: দুসাই রিসোর্ট এবং স্পা
প্রকল্পের অবস্থান: মৌলভিবাজার, সিলেট
ক্লায়েন্ট : নাসের রহমান
মোট নির্মিত এলাকা : ১১১০৩.৪২ বর্গমিটার
প্রকল্পের আরম্ভ : ২০১০
প্রকল্পের সমাপ্তি : ২০১৩
ব্যয় : ২৫.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার
স্থপতিবৃন্দ: ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ লিমিটেড
মোঃ ইশতিয়াক জহির, মোঃ ইকবাল হাবিব, নাবিলা আফতাব, নাবিলা আলি
স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার : তোফাজ্জল হোসেন, অচিন্ত কুমার সাহা
আলোকচিত্রশিল্পী: হাসান সাইফুদ্দিন চন্দন, আহসানুল হক রুবেল, ডিজিটা ইন্টারেক্টিভ লিঃ
প্রকল্পটি ২০১৬ সালে ২৫তম জে.কে. সিমেন্ট “বছরের শ্রেষ্ঠ স্থপতি” পুরষ্কার (এ ওয়াই এ),ভারত প্রশংসাসূচক পুরষ্কার (বিদেশী স্থাপত্য বিভাগ), আন্তর্জাতিক নকশা পুরষ্কার (আই.ডি.এ) হতে স্বর্ণ পদক (ভিন্ন স্থাপত্য বিভাগ) এবং মার্কিন স্থপতি পুরষ্কার হতে (এ.এ.পি) রৌপ্য পদক (আতিথেয়তা বিভাগ) প্রাপ্ত ।
[প্রকল্প তথ্য “ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ লিমিটেড” থেকে সংগৃহীত]
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চা বাগানের নির্মল সবুজ পাহাড়ে অবস্থিত, “দুসাই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা” বাংলাদেশে গন্তব্য রিসোর্ট ধারার পথিকৃৎ। পাহাড়ের ঢাল ধরে নির্মিত রিসোর্টটি একটি ঐতিহ্যবাহী “খাসিয়া” গ্রামের সদৃশ। সেই সাথে এখানে পাহাড়ের সবুজের সাথে আকাশের নীল মিলে এক অনন্য চিত্রপটের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ সাধারণত খুবই সমতল দেশ। শুধুমাত্র উত্তর-পূর্বে এবং দক্ষিণ-পূর্বে কিছু পাহাড়ি অঞ্চল বিদ্যমান। প্রচলিত নির্মাণ খাত পাহাড়ে নির্মাণের সাথে খুব একটা পরিচিত নয়। তাই পাহাড়ের বাসিন্দারা সাধারণত খুব রক্ষণশীল পন্থা অনুসরণ করে । বাংলাদেশের দেশীয় স্থাপত্যে উঠান এবং ক্লাস্টার দেখা যায়। উঠানের চারপাশে পৃথক পৃথকভাবে ঘর তৈরি করা হয় যা ফলস্বরূপ ক্লাস্টার গঠন করে। সিলেটের খাসিয়াঁ জনগোষ্ঠীদের হাউজিং লিনিয়ার ক্লাস্টার প্যাটার্নের। আয়াতাকার ঘরগুলো লিনিয়ার সারকুলার স্পেস অর্থাৎ উঠান বরাবর মুখোমুখি থাকে। খাসিয়াদের বাড়ির দৈর্ঘ্য সাধারণত বড় স্কেলের হয় এবং একে বলা হয় ‘ইংট্রেপ’(ingtrep)। তারা সমতল ভূমি থেকে প্রায় ২৫০ ফুট উঁচু-নিচু পাহাড়ি টিলার উপর মাচার ওপর ঘরগুলো (তিনটি ফাংশন – খোলা প্ল্যাটফর্ম, বারান্দা ও ভেতরের অংশ ) সরল রেকটিলিনিয়ারের মতো এবং খোলা প্ল্যাটফর্মটি মই দিয়ে সংযোগ করা হয়। দুসাই রিসোর্টের সামগ্রিক পরিকল্পনায় এই নীতি অনুসরণ করে ডিজাইন করা হয়। রিসোর্টের বিভিন্ন ফাংশন উঠানগুলোর চারপাশে গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে ক্লাস্টার গঠন করে এবং ক্লাস্টারগুলোর মধ্যে সংযোগ এমন একটি পথের মাধ্যমে তৈরি করা হয় যা প্রাকৃতিক রূপ অনুসরণ করে। |
ছবি : খাসিয়া ঘরের চিরাচরিত বিন্যাস |
জলবায়ুগত কারণে বর্ষাকালে উচ্চ বৃষ্টিপাত এবং আকস্মিক বন্যা এই এলাকার বৈশিষ্ট। বৃষ্টির পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং ঝড়ো হাওয়ার মাঝে টিকে থাকার জন্য ভবনে চালা ছাদ ব্যবহার করা হয়। প্রাকৃতিক ঢালকে অক্ষুণ্ণ রাখার উদ্দেশ্যে, ভবনসমূহকে মাটিতে গাঁথা কংক্রিটের ফ্রেমের উপরে বসিয়ে ঢালের প্রান্ত হতে বর্ধিত করে দেয়া হয়। ভিলার আশেপাশের বিদ্যমান বৃহদাকার গাছগুলিকে না কেটে নকশা করা হয়, যেন বিদ্যমান বনজ প্রতিবেশ অক্ষত থাকে। সাইটে নকশার রৈখিক বিন্যাস অতিথিদের উৎসাহিত করে সমগ্র সাইট ঘুরে ঘুরে অনুভব করার। সাইটে বিন্যস্ত পরিষেবাসমূহ নিভৃত এবং অর্ধ-নিভৃত স্থানসমূহের মধ্যবর্তী সংযোগ হিসেবে কাজ করে।সর্বোপরি প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য হল অতিথিদের প্রকৃতির মধ্যে বসবাসের পূর্ণাঙ্গ অনুভূতি দেয়া। ফলে, রিসোর্টের নকশা কৃত্রিম কাঠামো থেকে নৈসর্গিক নান্দনিকতাকে প্রাধান্য দেয়। |
ছবি : ধারণাগত অঙ্কন |
ছবি : দুসাই রিসোর্ট এবং স্পা-এর মাস্টারপ্ল্যান |
ছবি : অনুদৈর্ঘ্য বরাবর ছেদচিত্র |
ছবি : চা-উপত্যকার রেস্টুরেন্টের এলিভেশন | পাহাড়ের ঢাল ধরে নির্মিত রিসোর্টটিতে রয়েছে শয়ন ঘর, খাবার ঘর, সুইমিং পুল, স্পা, সম্মেলন কক্ষ এবং অভ্যন্তরীন ও বহিরাঙ্গন খেলাধূলার সুবিধা। সাইটটি তিনটি অগভীর পাহাড় এবং উপত্যকা নিয়ে গঠিত। সমস্ত অতিথি কক্ষগুলি চলাচলের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য পাহাড়ের ঢালে স্থাপন করা হয়েছে । অন্যান্য সুবিধা উপত্যকার দিকে স্থাপন করা হয়। |
ছবি : চা-উপত্যকা রেস্টুরেন্টের প্ল্যান |
ছবি : চা-উপত্যকা রেস্টুরেন্টের ডিটেইল ছেদচিত্র |
যানবাহন চলাচল সার্বজনীন, উন্মুক্ত এলাকায় শেষ হয় এবং অতিথি এলাকার দিকে পায়ে বা বৈদ্যুতিক গাড়ির মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয়। অভ্যন্তরীণ রাস্তা এবং হাঁটার পথগুলি কমপ্লেক্সটিকে ঘিরে একটি চক্রাকার পথ স্থাপন করা হয়েছে, যার ফলে দর্শনার্থীরা পুরো এলাকাটির চারিদিক ঘুরে দেখতে পারেন। অতিথি আবাসস্থলে একটি প্রধান হোটেল অংশ এবং একটি একক বাংলো রয়েছে। দুই ধরনের বাংলো আছে: দক্ষিণমুখী পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত অর্ধ-নিভৃত পরিবেশে পরিবারের জন্য কটেজ এবং আরও নিভৃত জায়গায় দম্পতিদের জন্য বিলাসবহুল কটেজ। ভিলা এবং রেস্তোরাঁর সব উপরের তলাগুলিতে বাঁশ ও খড়ের চালের নিচে উন্মুক্ত কাঠামোর ছাদ তৈরী করা হয়েছে। কিছু উন্মুক্ত স্থানে কাঠ এবং কাঠের ভিনিয়ারের ফিনিশসম্বলিত সিলিং এবং অনাবৃত ছাদের কাঠামো রয়েছে। রেলিঙের হাতল এবং দরজা, স্থানীয়ভাবে লব্ধ আখরোটের রঙের মজবুত কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। সমস্ত ভবনের বহিরঙ্গন পৃষ্ঠ প্রাকৃতিকভাবে ফিনিশ দেয়া হয়, যাতে ভবনসমূহ আশেপাশের সবুজ নিসর্গের সাথে সহজে মিশে যেতে পারে। ভবনসমূহে ২৪-৪০ ডিগ্রীর সুউচ্চ ঢালবিশিষ্ট খড় এবং হস্তনির্মিত পোঁড়ামাটির টালির ছাদ ব্যবহার করা হয়েছে যেন স্থানীয় ঝড়বৃষ্টির সাথে লড়ে টিকে থাকতে পারে। |
ছবি : অভ্যর্থনা কক্ষ : ঢালু, মাটির টালির ছাদ এবং কাঠের ট্রাস ফ্রেমিং সহ খোলা, সবুজে ঘেরা প্যাভিলিয়নের কাঠামো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়। |
ছবি : উপত্যকা রেস্টুরেন্ট - এটি প্রাকৃতিক কনট্যুর-এর সাথে মিলিয়ে বাঁকানো একটি স্ট্রাকচার, যার ছাদে কম্পোজিট কাঠ এবং ধাতুর মেটালের কাঠামো রয়েছে যার সাথে খড় মিশ্রিত রয়েছে। |
ছবি : উপত্যকা রেস্টুরেন্ট - ওপরে ঝোলানো খড়ের ছাদ, কাঠের ফ্রেমের মতো জালি একত্রে একটি অন্যরকম চেহারা তৈরি করে। এখানেও প্রাকৃতিকভাবে বায়ুচলাচল হয়। |
ছবি : উপত্যকা রেস্টুরেন্টের ইন্টেরিয়র - খড়ের ছাদ, কাঠ ও ধাতব কম্পোজিট ট্রাস, কাঠের ফ্রেমের কাজ সবই এখানে দৃশ্যমান। অভ্যন্তরীণ সজ্জাকে ছিমছাম রাখা হয়েছে। |
ছবি : সুইমিং পুল: এটি একটি প্রাকৃতিক ডোবায় স্থাপন করা হয়েছে। এটি ঘন গাছপালা দ্বারা বেষ্টিত, যার ফলে প্রয়োজনীয় গোপনীয়তা রক্ষিত হয়। | রিসোর্টিতে রয়েছে ৪টি স্যুট ভিলা, ৪০জন অতিথির জন্য দুটি করে শয়নকক্ষ স্যুটসম্বলিত ডুপ্লেক্স ও ট্রিপ্লেক্স ভিলা এবং ৫টি বিলাসবহুল ভিলা, ৪৮জন অতিথির জন্য ২৪টি কক্ষ, (প্রতিটি ভিলায় ৪টি স্বতন্ত্র অতিথি কক্ষ)। প্রত্যেকটিতেই আছে বারান্দা যেখান থেকে উপভোগ করতে পারবেন নয়নাভিরাম প্রকৃতি। প্রত্যেকটি রুমেই রয়েছে এলসিডি টিভি এবং শীতাতপ ব্যবস্থা। এর উত্তর দিকে রয়েছে বড় সুইমিং পুল, যার চারপাশের দৃশ্য সৌন্দর্যের সংজ্ঞাকে হারিয়ে দেবে । আবার দক্ষিণ দিকে রয়েছে আরেকটি পুল এবং পর্যটকদের জন্য ১০টি নৌকা ভিড়ানোর জায়গা। দেখলে মনে হবে এ যেন সবুজের মাঝখানে এক টুকরো নীল সাগর। পুরো রিসোর্টটির মাঝ দিয়ে এত সুন্দর ভাবে এই পুলগুলো তৈরী করা হয়েছে সারাদিন এখানে বসেই কাছের মানুষের সাথে গল্প করে কাটিয়ে দেয়া যাবে । |
ছবি : মূল হোটেলের প্ল্যান |
ছবি : মূল হোটেলর ছেদচিত্র |
ছবি : বিশাল ছায়াযুক্ত গাছের মধ্যে একটি ট্রেইল খড়ের দোতলা বাংলো পর্যন্ত নিয়ে যায় | রিসোর্টটি দেশীয় কাঠের তৈরী চা-বাগানের বাংলো এবং প্রচলিত কংক্রিট ফ্রেম কাঠামোর একটি মিশ্র নির্মাণব্যবস্থা প্রদর্শন করে। স্থানীয় দেশী কাঠের জোড়ের কৌশলগুলিকে সমসাময়িক ধাতব জোড়ের ব্যবস্থার সাথে একত্রিত করে কাঠামোগুলির নকশা করা হয়। ফলাফলস্বরূপ নকশাকৃত কাঠামোটির মূল অংশ হল ধাতব প্লেট, বোল্ট ও নাট দিয়ে যুক্ত মসৃণ এবং হালকা কাঠের ট্রাস। মাটিতে নোঙর করা সরু, কংক্রিটের ফ্রেমিং কাঠামোটিকে মাটির উপরে তুলে ধরে। ছাদের ট্রাস কাঠামোটির আকৃতি নির্ধারন করে, যা পরে স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য হালকা ছন এবং পোঁড়ামাটির টালি দ্বারা আবৃত হয়। ভবনটিতে প্রবেশের জন্য রয়েছে স্বতন্ত্র, উন্মুক্ত সিঁড়ি। স্থানীয় প্রযুক্তি, কারিগরী এবং নির্মাণ সামগ্রী প্রকল্পটিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকল্পটিতে দেশীয় নির্মাণ কৌশলের সাথে স্থানীয়ভাবে উপলব্ধ নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। রিসোর্টের ভবনগুলোর বাইরের দেয়ালে ফেয়ার-ফেস সিমেন্ট প্লাস্টার এবং ভেতরের দেয়ালে প্রচলিত সিমেন্ট মর্টার প্লাস্টার দেয়া হয়েছে। কেবলমাত্র ভিলার কাঠের মেঝে ব্যতীত, সমস্ত মেঝে ম্যাট ফিনিশড টালির তৈরী। শুকনো জিপসাম সম্বলিত কিছু অংশ বাদে, সকল ভবনের ছাদে সিমেন্ট প্লাস্টার করে রং দিয়ে ফিনিশিং দেয়া হয়। |
সম্পাদনায় : স্থপতি নিশি সাইমুন নির্ণয় উপদেষ্টা লিমিটেড, পান্থপথ |