এই থিসিস প্রকল্পে একটি ধারণা ও প্রোগ্রাম প্রস্তাব করা হয়েছে যা একটি নতুন ধরণের নকশা পদ্ধতির ভিত্তিতে তৈরি। প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য হলো—বেদে সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জীবিকার পদ্ধতিগুলো তুলে ধরা, এবং সেইসঙ্গে স্থাপত্যের মাধ্যমে এমন সমাধান প্রস্তাব করা যা তাদের সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা, পরিবেশবান্ধব জীবনধারা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকে সমর্থন করে। |
|
বেদে সম্প্রদায়বেদে হল একটি জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। বাংলাদেশজুড়ে প্রায় ১৭ লক্ষ বেদে বাস করেন। এর মধ্যে শেরপুর জেলার দক্ষিণ দেপলাই এলাকায় প্রায় ২০০টি পরিবারের প্রায় ৯০০ জন সদস্য বসবাস করেন। স্থানীয় সর্দারের ভাষ্যমতে, এ অঞ্চলে নিবন্ধিত ভোটারের সংখ্যা ৪৫০ জন। |
|
জীবনধারা ও পেশা বেদে সম্প্রদায়ের মানুষেরা সাধারণত বছরজুড়ে ১০ মাস ঘরছাড়া, যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত। ঈদ ও বিয়ের মতো উৎসব উপলক্ষে তারা বছরে মাত্র ২ মাস নিজ নিজ স্থায়ী ঠিকানায় ফিরে আসেন।তাদের প্রধান পেশাগুলোর মধ্যে রয়েছে—
যাযাবর জীবনধারার মধ্যেও তারা স্থানীয় সমাজে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন, তবে নিজস্ব ঐতিহ্যও ধরে রাখার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। |
|
জনসংখ্যা ও শিক্ষা পরিস্থিতি এই অঞ্চলে প্রায় ৪০০ শিশু রয়েছে যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে।তবে শিক্ষার হার অত্যন্ত কম; মাত্র ১৫ জন শিশু স্কুল বা মাদ্রাসায় যায়।শিক্ষার এমন ঘাটতির কারণে দারিদ্র্য চক্র থেকে তারা বের হতে পারছে না, সামাজিক অগ্রগতিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত এক দশকে শিক্ষা ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে বেদে সম্প্রদায় তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশায় সংকটে পড়েছে।অনেকে পেশা পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন, কিন্তু শিক্ষার অভাবে ভালো চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন না। ফলে অনেকে ভিক্ষাবৃত্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।তারা এখনও নিজেদের পরিচয় ধরে রাখতে চেষ্টা করছে এবং যাযাবর জীবন থেকে স্থানীয় জীবনে রূপান্তরের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং বিনোদন—এই মৌলিক চাহিদাগুলোর ব্যাপারে তারা এখনও গুরুতর সংকটে রয়েছে। |
অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ বেদে পল্লী প্রধান সড়ক থেকে অনেক দূরে অবস্থিত, যার ফলে চলাচল ও যোগাযোগে সমস্যা হয়।প্রশস্ত ও উন্নত সড়ক না থাকায় তারা নিকটবর্তী শহর ও প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বিচ্ছিন্ন। মূল চাহিদা ও সমস্যা শিক্ষা: শিশুদের জন্য শিক্ষার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। স্বাস্থ্যসেবা: পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা না থাকায় তারা নানা রোগ ও স্বাস্থ্য সংকটে ভোগে। |
বিনোদন: জীবিকা বিনোদনের সাথে সম্পৃক্ত হলেও তাদের কোনো সুষ্ঠু বিনোদন বা সাংস্কৃতিক স্থান নেই। |
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহ · উন্নত সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত করতে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন। · শিশুরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে পারে—এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরিকাঠামো স্থাপন জরুরি। · স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। · সামাজিক মিলনমেলা, সংস্কৃতি চর্চা ও বিনোদনের জন্য উপযুক্ত স্থান তৈরি করতে হবে। |
স্থাপত্যিক সহনশীলতা প্রকল্পের নকশায় এমন স্থাপনাগুলো তৈরি করা হবে, যা বেদে সম্প্রদায়ের জীবনের পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে পারে এবং দীর্ঘস্থায়ীভাবে টিকে থাকতে পারে। স্থানীয় উপকরণ ও কৌশল ব্যবহার করে এই স্থাপত্য জলাবদ্ধতা, ঋতু পরিবর্তন ও অন্যান্য পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম হবে। |
প্রকল্পের উদ্দেশ্যসমূহ ● স্থাপত্যিক সহনশীলতা ও সামাজিক সংহতি মূলস্রোতের সমাজ এবং বেদে সম্প্রদায়ের মধ্যে ভৌগোলিক এবং সামাজিক দূরত্ব কমিয়ে আনতে স্থাপত্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম হবে। নকশা এমনভাবে করা হবে যাতে বেদে জীবনধারার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে সামাজিক একীকরণ সহজ হয়। ● স্থাপত্যের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ বেদে জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের উপাদান ব্যবহার করে এমন ডিজাইন তৈরি করা হবে যা পরিবেশবান্ধব এবং আধুনিক নির্মাণ পদ্ধতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এতে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করা হবে, যাতে পরিবেশের ওপর প্রভাব কম হয়। ● সহনশীল, শিক্ষাবান্ধব সম্প্রদায় গঠন এই কমিউনিটি হবে এমন একটি স্থান যেখানে শিক্ষা, বিকাশ এবং স্থিতিশীলতার প্রতিটি সুযোগ থাকবে। এখানে শিশুদের বেড়ে ওঠা, বড়দের জীবিকানির্ভরতা এবং সামগ্রিক সংস্কৃতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। স্থাপত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে নিজের জায়গার ওপর গর্ব অনুভব করাবে এবং আত্মনির্ভরশীল হতে উৎসাহিত করবে। |
|
কটেজ এবং রেস্টুরেন্ট প্ল্যান |
|
|
|
|
|
●শেখা ও নিজেকে প্রকাশের জন্য বহুমুখী প্ল্যাটফর্ম এখানে এমন স্থাপত্যিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হবে যেখানে মানুষ নিজের দক্ষতা প্রকাশ করতে পারবে, জ্ঞান বিনিময় করতে পারবে এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবে। নকশায় থাকবে নমনীয়, বহুমুখী জায়গা—যেখানে শিক্ষা, বিনোদন ও সামাজিক কার্যক্রম একত্রে পরিচালিত হতে পারে। ● টেকসই অবকাঠামো ও সহনশীল নকশা এখানে যেসব অবকাঠামো তৈরি হবে তা শুধু কার্যকরই নয়, বরং পরিবেশগত প্রতিকূলতার (যেমন বন্যা, ঝড় বা তাপমাত্রার ওঠানামা) সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। এ ধরনের নকশা কমিউনিটির জন্য দীর্ঘমেয়াদে নিরাপদ ও ব্যবহারযোগ্য পরিসর নিশ্চিত করবে। |
|
সর্বোপরি, দক্ষিণ দেপলাইয়ে বসবাসরত বেদে সম্প্রদায়ের সমস্যাগুলো বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের বেদে জনগণের সামগ্রিক বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে।শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের সমন্বিত একটি সমাধানই পারে তাদের ক্ষমতায়ন করতে এবং তাদের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে স্থিতিশীল ও পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যিক সমাধান তৈরি হবে, যা বেদে সম্প্রদায়ের জন্য একটি সম্ভাবনার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে,যেখানে তারা নিজস্ব সংস্কৃতি ধরে রেখেই আধুনিক সমাজে একীভূত হয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে। |
|
|
জুরি মন্তব্য "এই কাজটি একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিকভাবে সংবেদনশীল, সাংস্কৃতিকভাবে প্রোথিত এবং প্রসঙ্গভিত্তিক বুদ্ধিদীপ্ত নকশা প্রতিক্রিয়া উপস্থাপন করে । গবেষণার ভিত্তি দৃঢ় এবং নকশার উদ্দেশ্য প্রশংসনীয়ভাবে সাংস্কৃতিক সহানুভূতি ও স্থিতিস্থাপকতাকে কেন্দ্র করে গঠিত।" · বেদের যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী আবাসনের দিকে সমাজ-সাংস্কৃতিক রূপান্তর সুনিপুণভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই রূপান্তরিত পরিচয়কে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে অভিযোজ্য ও স্থিতিস্থাপক পরিকাঠামো নকশার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা সময়োপযোগী ও অত্যাবশ্যক। · এই প্রকল্পে স্থাপত্যকে প্রতিনিধিত্ব, সমাজ গঠন এবং সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার মাধ্যম হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে—যা একাডেমিক নকশা কাজে প্রায়শই উপেক্ষিত একটি দৃষ্টিকোণ। · শিক্ষা, পারফরম্যান্স ও নিরাময়ের জন্য বহুমুখী স্থান তৈরির ওপর যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা বেদে জীবনধারার সাথে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং বিশেষভাবে প্রশংসার দাবি রাখে। |
ধারণাগত কাঠামো দৃঢ় হলেও স্থাপনাগত গল্প বলা আরও বিকশিত করা যেতে পারে। ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক স্থানিক অনুশীলনের সংমিশ্রণে ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা কেমন হতে পারে, তা দৃশ্যমানভাবে উপস্থাপন করা গুরুত্বপূর্ণ। যাযাবর থেকে স্থায়ী বসতিতে রূপান্তরের যেসব প্রাকটিস জাতিগত বা আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে হয়েছে, সেই সম্পর্কিত উদাহরণ যুক্ত করলে প্রস্তাবিত ধরনটির গভীরতা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। বেদের ঐতিহ্য আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে উপকরণ, অলংকরণ অথবা অংশগ্রহণমূলক নকশা পদ্ধতির ব্যবহার বিবেচনা করা যেতে পারে—যা প্রকল্পের স্বতন্ত্রতা ও বাস্তবতার মাত্রা আরও শক্তিশালী করবে। -ড. মোঃ নওরোজ ফাতেমী, অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, স্থাপত্য বিভাগ, ইউএপি |
"এই থিসিসটি একটি চিন্তাশীল ও নৈতিকভাবে পরিচালিত প্রচেষ্টা, যা একটি দুর্বল জনগোষ্ঠীকে সংস্কৃতি ভিত্তিক ও জলবায়ু সহনশীল নকশার মাধ্যমে ক্ষমতায়নের আন্তরিক উদ্যোগ প্রতিফলিত করে। উদ্দেশ্যের স্বচ্ছতা স্পষ্ট এবং সংবেদনশীলতা প্রশংসনীয়।" · এই প্রকল্পটি কেবল আনুষ্ঠানিক ‘ঐতিহ্য উপস্থাপন’ থেকে সরে এসে এমন এক স্থিতিস্থাপক ও কার্যকর স্থাপত্য প্রস্তাব করে, যা বাস্তব প্রয়োজন—শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সংযোগ এবং বিনোদন—পরিপূর্ণভাবে মেটাতে পারে। · জীবিকানির্ভর স্থান যেমন পারফর্ম্যান্স বা উৎপাদনের প্ল্যাটফর্ম—এই উপাদানগুলো প্রকল্পে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এগুলো কেবল অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা নয়, বরং সম্প্রদায়ের মর্যাদা বজায় রাখতেও ভূমিকা রাখে। · স্থানীয় উপকরণ এবং বন্যা-সহনশীল নির্মাণ নীতি ব্যবহার করা হয়েছে বাস্তবভিত্তিকভাবে, যা এই নিম্নভূমি অঞ্চলের জন্য পরিবেশগত দিক থেকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পর্যায়ক্রমিক উন্নয়ন কৌশল আরও গভীরভাবে অন্বেষণ করা যেতে পারে: শহরের প্রান্তে বেদে সম্প্রদায়ের সংযুক্তি যত বাড়বে, প্রকল্পের গঠন ও পরিসর কীভাবে পরিবর্তিত হতে পারে? একটি টাইমলাইন বা ধাপে ধাপে নির্মাণের যুক্তি উপস্থাপন করা যেতে পারে। প্রধান সড়ক থেকে দূরত্বজনিত সংযোগ সমস্যার একটি শক্তিশালী স্থাপনাগত সমাধান প্রয়োজন। প্রস্তাবটি কি পানিভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বা মোবাইল সেবা কেন্দ্রের মতো মাইক্রো-ইনফ্রাস্ট্রাকচার চালু করতে পারে? |
অবশেষে, স্থাপত্যের মাধ্যমে তরুণদের সম্পৃক্ততা বা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করা গেলে এটি একটি আত্মনির্ভর উন্নয়ন মডেলে পরিণত হতে পারে। এই প্রকল্পে নকশা, প্রতিনিধিত্ব ও বাস্তবতাবোধের এক বিরল ভারসাম্য পরিলক্ষিত হয়—যা দেখায় স্থাপত্য কীভাবে সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং আধুনিক ক্ষমতায়নের মধ্যে একটি সেতু হতে পারে। -স্থপতি মাহতাব হুসেইন, mw3 Design + Partners |
প্রতিবেদক: স্থপতি ফাইজা ফাইরুজ |