মধুবনী চিত্রকলা (বা মিথিলা চিত্রকলা) ভারতীয় চিত্রকলার একটি শৈলী যা ভারতীয় উপমহাদেশের মিথিলা অঞ্চলে চর্চা করা হয়। এ অঞ্চলের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মহিলারা ঐতিহ্যগতভাবে মধুবনী চিত্র তৈরি করে আসছেন।
স্থপতি কাজী আনিসউদ্দিন ইকবাল রাফু হিন্দু ধর্মানুযায়ী রাম ছিলেন একজন অবতার, অর্থাৎ নর দেবতা। যে সে দেবতা নন, স্বয়ং নারায়ণ, আর মর্তে তার সহধর্মিণী ছিলেন সীতা। রাম অযোধ্যার যুবরাজ থাকা অবস্থায় জনক রাজার কন্যা সীতার পাণি গ্রহন করেন। বর্তমান ভারত ও নেপালের কিছুটা অংশ জুড়ে ছিল সেকালের মিথিলা রাজ্য, রাজা জনক ছিলেন তার রাজা। রাম ও সীতার বিয়ে উপলক্ষে রাজা জনক চারিদিকে সাজ-সজ্জার জন্য শিল্পীদের নির্দেশ দিলেন। আর শিল্পীরা ঘরের দেয়াল, মেঝেতে রং বেরঙের ছবি এঁকে ভরে তুলল। সেই হিসেবে কেউ কেউ এই মিথিলা চিত্রকলার শুরুটা রাম-রাজত্বের সমসাময়িক বলে দাবী করতে পারেন। |
তবে সকলেই বুঝেন যে, একটি চিত্ররীতি একদিনে গড়ে উঠে না, বহু মানুষের বহু যুগের চর্চায় একটা লোক শিল্পধারার সৃষ্টি হয়। ভারতের ‘মিথিলা’ অর্থাৎ বিহার এবং নেপালে উৎসব বা পালা-পার্বনে গৃহ সজ্জার জন্য একটি লোক চিত্রকলা বহুকাল ধরে প্রচলিত আছে। মিথিলার অন্য নাম মধুবন, তাই একে ‘মধুবনী চিত্র বা ‘মিথিলা চিত্র বলা হয়। গ্রামাঞ্চলে মাটির বাড়ি রক্ষনাবেক্ষণের জন্য কিছুকাল পর পর মাটির দেয়াল বা মেঝে গোবর মাটির গোলা দিয়ে লেপা হয়। বৃষ্টির পানিতে ক্ষতিগ্রস্থ দেয়ালগুলি এরকম মেরামতে নতুন হয়ে ওঠে। এসব নতুন দেয়ালে উজ্জ্বল রঙে ছবি আঁকলে খুবই সুন্দর হয়, সকলের জন্যই একটা আনন্দের উৎস হয়। এসব ছবির বিষয়বস্তু প্রথম দিকে কি থাকত সেটা জানা সম্ভব না। নতুন করে মাটি লেপার জন্য পুরানো চিত্র মুছে যেত। মাটির দেয়াল যেমন অস্থায়ী, তার উপরে আঁকা ছবিও তেমনি অস্থায়ী। |
ছবি : মাটির দেয়ালে মধুবনী পেইন্টিং |
ছবি : মধুবনী মহাবিদ্যা |
১৯৩৪ সালে ভারত-নেপাল সীমান্তে একটি ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়, সেই সময়ে ঐ অঞ্চলের বৃটিশ অফিসার উইলিয়াম আর্চার ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা দেখতে এসে ভাঙা দেয়ালে মধুবনী চিত্রকলার সন্ধান পান, এসব দেয়াল চিত্র দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে অনেক ছবি তুলেছিলেন। তার ঐ ছবিগুলি পরে প্রদর্শীত হয় এবং মধুবনী চিত্রমালা ভারতবর্ষের লোকশিল্পের একটি পৃথক ধারা হিসাবে পরিচিতি পায়। ভারতে জন্ম নেওয়া ধর্মগুলি শিল্পকলার অনুকুলে। প্রাচীনকালে প্রচলিত সবক’টি শিল্প মাধ্যমই ভারতবর্ষে চর্চা হয়েছে, ধর্মের কোন বাঁধা ছিল না। তবে সময়ের সাথে সাথে এসব চর্চার নিয়ম-কানুন তৈরী হয়েছে। যেমন, ভাস্কর্য বা প্রতিমা গড়তে গেলে কিছু হিসাব, তাল বা মাত্রা মেনে চলতে হয়, এসব শাস্ত্রীয় শিক্ষা গুরুর কাছে শিক্ষানবিশি না করলে আয়ত্ব করা দুরূহ। গান-বাজনা, নৃত্য-কলারও ওরকম ধ্রুপদ শিক্ষার পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু নৌকা বেয়ে চলা মাঝির কন্ঠে ভাটিয়ালী গান বা বাউলের নৃত্য-গান ওসব নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলে না। উৎসবের দিনে সমগ্র গ্রাম যখন মেতে উঠে তখন সাজ-সজ্জার জন্য এত শাস্ত্রজ্ঞ শিল্পী কোথায় পাওয়া যাবে ? সেজন্য লোক শিল্পীরা উৎসাহী নারী-পুরুষদের ন্যুনতম প্রশিক্ষনের মাধ্যমে বিভিন্ন শিল্প ধারার সহযোগী শিল্পী তৈরী করতেন। অনুশীলনের মধ্যদিয়ে এসব স্বল্প শিক্ষিত হাত ক্রমশ দক্ষ হয়ে লোকশিল্পের এক একটা ঘরানার জন্ম দিয়েছে। শাস্ত্রীয় নিয়ম-কানুনের খুঁটিনাটি না জানায় এই শিল্প রচনায় অনেক স্বাধীনতা ছিল। ধর্মমূখী সমাজে ধর্মীয় গল্প-কাহিনীর বেশী চাহিদা, তাই ছবিতে অন্যকোন অনুষঙ্গ ঢুকে পড়লেও তা ওসব গল্পের সহযোগী হিসেবেই স্থান পেত। এরকম শিল্প যখন কিছুটা সফলতা পায় তখন পুরোহিত শ্রেনী এর মধ্যে কিছু দিক নির্দেশনা দিয়ে তাকে পথে রাখতেন। গ্রামের সার্বজনীন উৎসবের চেয়ে মন্দিরের পূজার সংখ্যা অনেক বেশী, তাই মন্দিরের দেয়া গাইড লাইন/নির্দেশনা মেনে চলাই শিল্পীদের জন্য শ্রেয়। |
মধুবনী চিত্রশৈলী অজানা পুরানো কাল থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অনুসৃত বা চর্চা করা হচ্ছে। এ অঞ্চলে এই শিল্পধারাটি গৃহসজ্জার অন্যতম পন্থা। বাড়ির মেয়েরাই ঘরের দেয়ালে আল্পনার মত করে এই ছবি আঁকেন, পৌরানিক কাহিনীর পাশাপাশি তাঁদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, কল্পনা ও সৌন্দর্য অনুভূতি নানাভাবে ছবিতে স্থান পেয়ে যায়। প্রথমদিকে মধুবনী চিত্র আঁকায় কয়েকটি ঘরানা সৃষ্টি হয়েছিল, শিল্পীদের ধ্যান-ধারণার, মত-পথের পার্থক্য থেকেই এসব ধারার উৎপত্তি। সংক্ষেপে ৫টি নামে তাদের অভিহিত করা হয়, |
ছবি : তান্ত্রিক মধুবনী চিত্র |
ছবি : কোহবার মধুবনী চিত্র |
ছবি : ভরনী মধুবনী চিত্র |
ছবি : গোড়না মধুবনী চিত্র |
ছবি : কাচনী মধুবনী চিত্র |
মধুবনী ছবি হিন্দু দেব-দেবীদের উপাখ্যানের উপর রচনা করা হয়, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী যারা উপস্থিত তারা হলেন রাম-সীতা, কৃষ্ণ, লক্ষী, শিব, দূর্গা, সরস্বতি। এ ছাড়াও রামায়ন কাহিনী থেকে বেছে নেয়া নানা পার্শ্ব চরিত্রও চিত্রিত হন, যেমন দেব-দেবীর সঙ্গী-সাথীরা বা চন্দ্র-সূর্য, ময়ূর, গরুড় এরাও ছবিগুলিতে যথেষ্ট দৃশ্যমান। ছবির প্রকাশভঙ্গী যথেষ্ট সহজ সরল। ছবির সীমানা হিসাবে ফ্রেমের মত ডিজাইন করা হয় অর্থাৎ ফ্রেমও ছবির অংশ। ফ্রেমের ভিতরে বিষয়বস্তু প্রধান ও সহযোগী লাইনের সমন্বয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়। মূল ছবিতে সমান্তরাল দুটি রেখা ব্যবহার করা জরুরী, এই রেখাচিত্রের একটা দার্শনিক মতবাদ রয়েছে। এই গতিময় রেখা দুটি জগতে দুই বিপরীতের পার্থক্য বজায় রেখেও একই পথ যাত্রার রূপক। প্রকৃতিতে সকল ক্ষেত্রেই বিপ্রতীপ কিছু একটা রয়েছে, যেমন, আলো-অন্ধকার, টক-মিষ্টি, সুন্দর-অসুন্দর বা উগ্র-শান্ত ইত্যাদি। মধুবনী চিত্রধারায় প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করার নিয়ম, আদিতে সাদা-কালোর সাথে কমলা, সবুজ এবং লাল রং হত, তারপর গোলাপী, বেগুনী, এবং নীল যোগ হয়েছিল। রঙের উপাদান চালের গুড়া, তেতুল এবং আরও নানা রকম ফল ও ফলের বিচী, ফুলের রেনু, প্রাকৃতিক নীল, চন্দন কাঠ, বিভিন্ন ফুল ও গাছের পাতা, গাছের ছাল-বাকল, কচি ডাল ও লতা। রং তৈরীর জন্য ফুল ছেঁড়া হয় না, ঝরে পড়া ফুল ব্যবহার করা হয়। অতীতে শিল্পীরা নিজ হাতে পরম যত্নে রং তৈরী করতেন, কিন্তু এখন বাজারে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরী করা রং সুলভ এমনকি কিছু কিছু প্রাকৃতিক রং তৈরী অবস্থায় বাজারে পাওয়া যায়। |
ছবি : মধুবনী চিত্র, বিষ্ণু |
মধুবনী চিত্রকলা ছিল গৃহসজ্জার শৈলী, দেয়ালে আঁকা, কিন্তু মাটির ঘর বর্তমানে কমে আসছে, ইটের গাঁথুনীর উপর আস্তর করা দেয়াল, অনেক বেশী টেকসই। ঘরের মেঝেও এখন অনেক ভিন্ন উপাদানে তৈরী হয়। চালের গুড়া বা অন্যকোন ক্ষনস্থায়ী রঙের বদলে সকলে স্থায়ী রং চায়, বিষয়বস্তুতেও দেব-দেবীর বদলে সমসাময়িক চিন্তার প্রভাব পড়েছে। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে মাধ্যমে, অর্থাৎ মধুবনী এখন শুধুমাত্র দেয়াল চিত্র নয়, নানা ধরনের তুলট কাগজে, বিভিন্ন ধরনের কাপড়ে, বোর্ডের উপরেও এই চিত্র তৈরী হচ্ছে। শহুরে র্আটিস্টরা এবং ড্রেস ডিজাইনাররা বাজারের চাহিদা মাফিক ডিজাইন করে পাঠান, মধুবনী চিত্র আঁকিয়েরা কাগজে বা কাপড়ে সেইমত আঁকেন। কিছু শিল্পী আজকাল ঘরের দেয়াল বা ঠাকুর ঘরের দেয়ালে মধুবনী আঁকছেন, এখন আর আগের সীমিত রং নয়, সকল মাধ্যমের জন্য বাজারে যেসব রং পাওয়া যায় সেগুলোই ব্যবহৃত হয়। এতবেশী বাজারমুখী হওয়ায় মূলধারা থেকে বিচ্যুতি হচ্ছে অনেক বেশী, ফলে ভারতের অন্যান্য লোক চিত্রের সাথে গুলিয়ে ফেলা খুবই সম্ভব। মধুবনী চিত্র চেনার সহজ উপায় হল সেই ‘দুইরেখা। |
ছবি : কৃষ্ণ ও রাধা মধুবনী চিত্রকর্ম (পদ্মশ্রী সীতা দেবী) |
ছবি : রাম-সীতার বিবাহ চিত্রিত কাগজে উদ্ভিজ্জ রং (জগদাম্বা দেবী, পদ্মশ্রী) |
বিহারের মধুবন ছেড়ে এই শিল্প এখন নাগরিক হবার সংগ্রামে নেমে পড়েছে, এই শিল্পের মূলসুর যাতে বজায় রাখা যায় তার জন্য কিছু শিল্পী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন, কিছু কর্মক্ষেত্র, স্টুডিও এমনকি প্রদর্শনী কেন্দ্র তৈরী হয়েছে। বেশ কয়েকজন মধুবনী শিল্পী ভারতের জাতীয় পুরস্কার পদ্মভূষণ, চন্দ্রভূষণ ইত্যাদি দ্বারা সম্মানীত হয়েছেন। এছাড়াও মধুবনী শিল্প ক্রমশ আন্তর্জাতিক পরিসরে আরও বেশী আলোচিত হচ্ছে। জাপানে একটি যাদুঘরে কয়েক হাজার মধুবনী চিত্র সংগৃহীত রয়েছে। |
সহকারি সম্পাদনায় : স্থপতি ফাইজা ফাইরুজ নির্ণয় উপদেষ্টা লিমিটেড, পান্থপথ |