বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান, ১৯০১ সালে জন্ম। পরিবারটি বাল্টিক দ্বীপ ওসেল (বর্তমানে সারিমা) থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় অভিবাসী হিসেবে এসেছে। লুইসের বাবার নাম লিওপোল্ড, অল্প বয়সে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন। লুই-এর মা বার্থার সাথে পরিচয় ঐ সৈনিক জীবনেই। বংশধারা অনুযায়ী লুই-এর পরিবারে স্লোভাক, জার্মান, স্ক্যানডেনেভিয়া এবং পারসীক সংস্কৃতির মিশ্রন। ব্যক্তি জীবনে লিওপোল্ড স্টেইন্ড গ্লাসের (Stained Glass) দক্ষ কারুশিল্পী ছিলেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এসে তার এই কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। ইমিগ্রান্ট হিসাবে একটি অপরিচিত পরিবেশে তা সহজও ছিল না, ফলে তিনি নানা ধরনের কাজেই জীবিকার পথ খুঁজেছেন। কখনও গৃহ নির্মাণ কন্ট্রাকটর, কখনও মুদী দোকান, কখনও আবার গ্লাসের কাজ, শেষ পযর্ন্ত একটা মেয়েদের পোষাকের লেইস বুনানোর কারখানায় লেইসের ড্রইং করার কাজে নিয়োজিত হয়ে একটা স্থিতাবস্থায় আসেন। লিওপোল্ডের এই অস্থিরতার পাশাপাশি বার্থা ছিলেন অবিচল, সংসারের প্রয়োজনে একটা মিষ্টির দোকানে চাকুরী করতেন, কিন্তু বাড়ীতে ইউরোপীয় সংস্কৃতির উচ্চমার্গের আবহ রক্ষায় নিরলস চেষ্টা করতেন। বার্থা হার্প বাজাতেন, বাবা লিওপোল্ড ড্রইং করতেন, ছবি আঁকা এবং সঙ্গীত এদুটি বিষয়ে সন্তানদের দক্ষতা ছিল অবধারিত। লুই-এর বোন সারা এবং ভাই অস্কার সকলেরই শিল্প প্রতিভা ছিল, সারা পেইন্টিং করত, সুন্দর চেহারার অস্কার মিউজিসিয়ান এবং অভিনেতা। লুই মনে করতেন, তার চেয়েও অস্কারের প্রতিভা বেশী, ঠিকমত সুযোগ পেলে অনেক বিখ্যাত হতে পারত।
অস্কার অল্প বয়সে বিয়ে করে সংসার চালাতে ব্যবসায়ী বনে যান, কিন্তু ছবি আঁকা, গান লেখা বা সঙ্গীতের চর্চা ছাড়েননি, পরবর্তীকালে ক্যালিফোর্নিয়া রেডিওতে বিজ্ঞাপনের জন্য সঙ্গীত সৃষ্টিতে বেশ সুনামও হয়েছিল। লুইও চমৎকার পিয়ানো বাজাতেন, পড়াশোনার পাশাপাশি অতিরিক্ত হাতখরচাটা আসত পিয়ানো বাজানো থেকে। তার যৌবনে তখন নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগ, চলচ্চিত্রের আবহ তৈরীর জন্য তিনি পর্দার অন্তরালে পিয়ানো বাজাতেন, সিনেমার বিরতির সময়টুকুতে তার কার্টুনও দেখাতেন। লুই এর প্রতিভা নিয়ে তার পরিবারে কোন সংশয় ছিল না, তার বোন নিজের পড়াশোনা বন্ধ করে পরিবারের জন্য উপার্জনের কাজে লেগে গিয়েছিল এই আশায় একদিন লুই অনেক বড় কিছু হবে, তাকে যেতে হবে অনেকদূর, তুচ্ছ সংসারের ঝামেলায় তাকে আটকে রাখা উচিত হবে না।
লিওপোল্ড চাইতেন ছেলে বড় শিল্পী হবে, বার্থা ভাবতেন সঙ্গীত সষ্ট্রা হবে তার ছেলে, তবে বাবা-মায়ের এই চাওয়ার মধ্যে কোন জবরদস্তি ছিল না বরং উভয়দিকেই লুই তাদের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েছেন। ছোটকালে মুখ-হাত পুড়ে যাওয়ায় স্কুলের ছেলেরা তাকে পোড়ামুখো বলে ক্ষ্যাপাত, ফলে স্কুলে সকলের সাথে সহজভাবে মিশতে পারতনা লুই, এমনকি ক্লাসেও খুব মনযোগী ছাত্র হতে পারেনি, ১*১ যদি ১ হয় তবে ২*২ এর ফল ২ হবে না কেন এমন সব প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে বেড়াত বেচারা লুই। কা’ন পরে জানিয়েছেন, তার ছবি আঁকার দক্ষতাই হয়ত তাকে স্কুলের গন্ডি পেরুতে সাহায্য করেছে।
অল্প বয়সেই ছবি আঁকায় লুই এতই দক্ষ হয়ে উঠেছিল যে, তার যখন ১২ বছর বয়স তখন ফিলাডেলফিয়ার চিড়িয়াখানায় বয়স্ক লোকদের পশু-পাখীর ছবি স্কেচ করা শেখাত বালক লুই, পাড়াপ্রতিবেশীদের দোকানের সাইনবোর্ড আঁকার জন্যও ডাক পড়ত। দস্যিপনায়ও কম যেতনা, লাফিয়ে ঝাপিয়ে নিজের শক্তিকে নিজেই পরখ করত। ওর বাবাও ছিলেন অমন, কিল মেরে কাঠবাদাম বা আপেল দুইভাগ করতেন। লিওপোল্ড এবং বার্থা ইহুদী হলেও ধর্মীয় গোঁড়ামী এড়িয়ে চলতেন, বিশ্বাসের নির্যাসটুকু বুকের মধ্যে রেখে চলতেন, বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতার আতিশয্য ছিল না মোটেও, যদিও তৎকালীন ইহুদী পরিবারগুলিতে বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। ওদের পারস্পারিক সম্পর্কও যেমন ছিল নিবিড় তেমন শ্রদ্ধাপূর্ণ। সংসারেও বাহ্যিকতার চেয়ে আত্মার শুদ্ধি, বিবেকের অনুশাসন, প্রাধান্য পেত। ফলে তিনটি ছেলে-মেয়ের মধ্যেই অতীন্দ্রিয় কিছু অর্জন করার জন্য ত্যাগ ও সংগ্রামের মানসিক ভিত্তি তৈরী হয়েছিল। ভিতরে ভিতরে এমন দৃঢ় মনোভাবের আলগা বহিপ্রকাশ ছিল না, বরং পরিবারের মধ্যে রসবোধ ও কৌতুক প্রিয়তা, গভীর জীবন চেতনার সাথে বাস্তবতার সংঘাতকে অনেকটা মসৃণ রাখতো। বার্থাকে পরিচিত মহলে একজন বুদ্ধিমতি মহিলা হিসেবে গণ্য করা হত, তা শুধুমাত্র বাস্তবতার উর্ধ্বে উঠে সকল বিষয়ে দার্শনিক ব্যাখ্যা দেবার ক্ষমতার জন্য নয়, তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্যও ছিল, প্রচলিত ছিল যে বার্থার বাবা কিছু রোগ সারাবার গোপন ঔষধ জানতেন। লুই এর নানী’ত ইহুদী স¤প্রদায়ের ছোটখাট নেত্রীই ছিলেন, বার্থাও সেই উত্তরাধীকার পেয়েছিলেন, নিজেদের সমস্যা সমাধানে সদুপদেশের আশায় অনেকেই বার্থার কাছে আসতেন।
লুই কা’নের পরিবারের এই সম্মান জনক অবস্থান নিঃসন্দেহে শৈশব থেকেই তার উচুঁ মানসিকতা তৈরীতে সাহায্য করেছে। তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন, নিজের মনের কাছে জিজ্ঞাসা করে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নেবার বিষয়টি (Intuition) তিনি তার পরিবার থেকে পেয়েছেন। কর্মক্ষেত্রে আমরা নিঃশব্দতার (Silence) অবগাহনে পরানের গহীন ভিতর থেকে তার আলোর পরিসর সৃষ্টির রহস্যময় স্থাপত্য আমরা বারবার অনুধাবন করব।