স্থপতি লুইস ইসাডোর কা’ন

স্থাপত্য ও নির্মাণ
ব্যক্তিত্ব
১৭ ডিসেম্বর, ২০২৩
২১৯
স্থপতি লুইস ইসাডোর কা’ন

স্থপতি লুই.আই.কা’ন বিশ্ব আধুনিক স্থাপত্যে একজন অগ্রনায়ক। পেনসেলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যে অধ্যাপনা করেছেন বহুকাল। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় সেখান থেকে খুব দূরে নয়।

কাজী আনিস উদ্দিন ইকবাল

স্থপতি লুই. আই. কা’ন বাংলাদেশে কোন অপরিচিত নাম নয়, আমাদের দেশের সংসদ ভবনের স্থপতি তিনি, এই তথ্যটি স্কুল পড়ুয়ারাও জানে। বিশ্ববিখ্যাত এই স্থপতির অন্যতম কীর্তি চোখের সামনে থাকায় আমাদের স্থপতি এবং প্রকৌশলীদের অনেকেই যথেষ্ট উৎসাহের সাথে তার সম্মন্ধে গভীর জ্ঞান লাভ করেছেন। শুধু আমাদের দেশেই নয়, স্থাপত্যের চেতনাগত বিষয়গুলো নিয়ে যারা মাথা ঘামায়, সারা বিশ্বের অনেক বিখ্যাত স্থপতি, শিল্পী, শিল্প সমালোচকরা এখনও কা’নের সৃষ্টি ও দর্শন নিয়ে নানাবিধ চর্চা করে চলেছেন এবং তার কাজের অন্তর্ণিহিত সুরগুলো নতুনভাবে আবিষ্কার করছেন। তাক লাগানো নির্মাণ প্রযুক্তির এই চরম উৎকর্ষতার যুগেও ঐতিহ্যকে ধারন করে আধুনিকতার যাত্রার কা’নের সেই পথ নির্দেশ অনেকেই নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে চাচ্ছেন।

শৈশবে গরম পানিতে ঝলসে যাওয়া শিশুটির ভবিষ্যৎ নিয়েও পারিবারিক নৈরাশ্যে মা কিন্তু ভেসে যাননি, তিনি বিশ্বাস করতেন তার এই সন্তানই একদিন বড় কিছু হবে। মায়ের এই আবেগের মূর্ত সফলতার প্রতীক বিকৃত মুখশ্রী নিয়েই বিশ্ব স্থাপত্যের অন্যতম দার্শনিক আমাদের স্থপতি লুই. আই. কা’ন।

3f85de62 531f 4a2b 86bb 46441b2f2244
20a7319f 80a9 4a1a Abc1 A456671ebd45
9932e454 B0e3 41f8 A9ee Ed86a6da681c

বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান, ১৯০১ সালে জন্ম। পরিবারটি বাল্টিক দ্বীপ ওসেল (বর্তমানে সারিমা) থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় অভিবাসী হিসেবে এসেছে। লুইসের বাবার নাম লিওপোল্ড, অল্প বয়সে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন। লুই-এর মা বার্থার সাথে পরিচয় ঐ সৈনিক জীবনেই। বংশধারা অনুযায়ী লুই-এর পরিবারে স্লোভাক, জার্মান, স্ক্যানডেনেভিয়া এবং পারসীক সংস্কৃতির মিশ্রন। ব্যক্তি জীবনে লিওপোল্ড স্টেইন্ড গ্লাসের (Stained Glass) দক্ষ কারুশিল্পী ছিলেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এসে তার এই কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। ইমিগ্রান্ট হিসাবে একটি অপরিচিত পরিবেশে তা সহজও ছিল না, ফলে তিনি নানা ধরনের কাজেই জীবিকার পথ খুঁজেছেন। কখনও গৃহ নির্মাণ কন্ট্রাকটর, কখনও মুদী দোকান, কখনও আবার গ্লাসের কাজ, শেষ পযর্ন্ত একটা মেয়েদের পোষাকের লেইস বুনানোর কারখানায় লেইসের ড্রইং করার কাজে নিয়োজিত হয়ে একটা স্থিতাবস্থায় আসেন। লিওপোল্ডের এই অস্থিরতার পাশাপাশি বার্থা ছিলেন অবিচল, সংসারের প্রয়োজনে একটা মিষ্টির দোকানে চাকুরী করতেন, কিন্তু বাড়ীতে ইউরোপীয় সংস্কৃতির উচ্চমার্গের আবহ রক্ষায় নিরলস চেষ্টা করতেন। বার্থা হার্প বাজাতেন, বাবা লিওপোল্ড ড্রইং করতেন, ছবি আঁকা এবং সঙ্গীত এদুটি বিষয়ে সন্তানদের দক্ষতা ছিল অবধারিত। লুই-এর বোন সারা এবং ভাই অস্কার সকলেরই শিল্প প্রতিভা ছিল, সারা পেইন্টিং করত, সুন্দর চেহারার অস্কার মিউজিসিয়ান এবং অভিনেতা। লুই মনে করতেন, তার চেয়েও অস্কারের প্রতিভা বেশী, ঠিকমত সুযোগ পেলে অনেক বিখ্যাত হতে পারত।

অস্কার অল্প বয়সে বিয়ে করে সংসার চালাতে ব্যবসায়ী বনে যান, কিন্তু ছবি আঁকা, গান লেখা বা সঙ্গীতের চর্চা ছাড়েননি, পরবর্তীকালে ক্যালিফোর্নিয়া রেডিওতে বিজ্ঞাপনের জন্য সঙ্গীত সৃষ্টিতে বেশ সুনামও হয়েছিল। লুইও চমৎকার পিয়ানো বাজাতেন, পড়াশোনার পাশাপাশি অতিরিক্ত হাতখরচাটা আসত পিয়ানো বাজানো থেকে। তার যৌবনে তখন নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগ, চলচ্চিত্রের আবহ তৈরীর জন্য তিনি পর্দার অন্তরালে পিয়ানো বাজাতেন, সিনেমার বিরতির সময়টুকুতে তার কার্টুনও দেখাতেন। লুই এর প্রতিভা নিয়ে তার পরিবারে কোন সংশয় ছিল না, তার বোন নিজের পড়াশোনা বন্ধ করে পরিবারের জন্য উপার্জনের কাজে লেগে গিয়েছিল এই আশায় একদিন লুই অনেক বড় কিছু হবে, তাকে যেতে হবে অনেকদূর, তুচ্ছ সংসারের ঝামেলায় তাকে আটকে রাখা উচিত হবে না।

লিওপোল্ড চাইতেন ছেলে বড় শিল্পী হবে, বার্থা ভাবতেন সঙ্গীত সষ্ট্রা হবে তার ছেলে, তবে বাবা-মায়ের এই চাওয়ার মধ্যে কোন জবরদস্তি ছিল না বরং উভয়দিকেই লুই তাদের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েছেন। ছোটকালে মুখ-হাত পুড়ে যাওয়ায় স্কুলের ছেলেরা তাকে পোড়ামুখো বলে ক্ষ্যাপাত, ফলে স্কুলে সকলের সাথে সহজভাবে মিশতে পারতনা লুই, এমনকি ক্লাসেও খুব মনযোগী ছাত্র হতে পারেনি, ১*১ যদি ১ হয় তবে ২*২ এর ফল ২ হবে না কেন এমন সব প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে বেড়াত বেচারা লুই। কা’ন পরে জানিয়েছেন, তার ছবি আঁকার দক্ষতাই হয়ত তাকে স্কুলের গন্ডি পেরুতে সাহায্য করেছে।

অল্প বয়সেই ছবি আঁকায় লুই এতই দক্ষ হয়ে উঠেছিল যে, তার যখন ১২ বছর বয়স তখন ফিলাডেলফিয়ার চিড়িয়াখানায় বয়স্ক লোকদের পশু-পাখীর ছবি স্কেচ করা শেখাত বালক লুই, পাড়াপ্রতিবেশীদের দোকানের সাইনবোর্ড আঁকার জন্যও ডাক পড়ত। দস্যিপনায়ও কম যেতনা, লাফিয়ে ঝাপিয়ে নিজের শক্তিকে নিজেই পরখ করত। ওর বাবাও ছিলেন অমন, কিল মেরে কাঠবাদাম বা আপেল দুইভাগ করতেন। লিওপোল্ড এবং বার্থা ইহুদী হলেও ধর্মীয় গোঁড়ামী এড়িয়ে চলতেন, বিশ্বাসের নির্যাসটুকু বুকের মধ্যে রেখে চলতেন, বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতার আতিশয্য ছিল না মোটেও, যদিও তৎকালীন ইহুদী পরিবারগুলিতে বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। ওদের পারস্পারিক সম্পর্কও যেমন ছিল নিবিড় তেমন শ্রদ্ধাপূর্ণ। সংসারেও বাহ্যিকতার চেয়ে আত্মার শুদ্ধি, বিবেকের অনুশাসন, প্রাধান্য পেত। ফলে তিনটি ছেলে-মেয়ের মধ্যেই অতীন্দ্রিয় কিছু অর্জন করার জন্য ত্যাগ ও সংগ্রামের মানসিক ভিত্তি তৈরী হয়েছিল। ভিতরে ভিতরে এমন দৃঢ় মনোভাবের আলগা বহিপ্রকাশ ছিল না, বরং পরিবারের মধ্যে রসবোধ ও কৌতুক প্রিয়তা, গভীর জীবন চেতনার সাথে বাস্তবতার সংঘাতকে অনেকটা মসৃণ রাখতো। বার্থাকে পরিচিত মহলে একজন বুদ্ধিমতি মহিলা হিসেবে গণ্য করা হত, তা শুধুমাত্র বাস্তবতার উর্ধ্বে উঠে সকল বিষয়ে দার্শনিক ব্যাখ্যা দেবার ক্ষমতার জন্য নয়, তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্যও ছিল, প্রচলিত ছিল যে বার্থার বাবা কিছু রোগ সারাবার গোপন ঔষধ জানতেন। লুই এর নানী’ত ইহুদী স¤প্রদায়ের ছোটখাট নেত্রীই ছিলেন, বার্থাও সেই উত্তরাধীকার পেয়েছিলেন, নিজেদের সমস্যা সমাধানে সদুপদেশের আশায় অনেকেই বার্থার কাছে আসতেন।

লুই কা’নের পরিবারের এই সম্মান জনক অবস্থান নিঃসন্দেহে শৈশব থেকেই তার উচুঁ মানসিকতা তৈরীতে সাহায্য করেছে। তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন, নিজের মনের কাছে জিজ্ঞাসা করে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নেবার বিষয়টি (Intuition) তিনি তার পরিবার থেকে পেয়েছেন। কর্মক্ষেত্রে আমরা নিঃশব্দতার (Silence) অবগাহনে পরানের গহীন ভিতর থেকে তার আলোর পরিসর সৃষ্টির রহস্যময় স্থাপত্য আমরা বারবার অনুধাবন করব।

F1ade849 8b79 4fe1 A596 Ab5de06ecc84
F26ff7f9 9e83 450a Ab0f 79f21ddab06b
34ed122f 172b 4fa1 B105 89b6f74c5c1c
হাই স্কুল শেষে ১৯২০ সালে লুই কা’ন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় স্থাপত্য শিক্ষার জন্য ভর্তি হবেন । সে সময়ে এই প্রতিষ্ঠানটি Beaux Arts এর সবচেয়ে নামী শিক্ষালয়, স্থাপত্যে পুরানো আমলের কালোত্তীর্ণ যেসব ধারা (Order) সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলির যৌক্তিকতাও সময়ের পরিবর্তনে ফুরিয়ে যায়নি। এই পদ্ধতিতে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলির ড্রইং, নির্মাণ কৌশল এবং প্রতিটি ডিটেইলের কার্যকারিতা শেখানো হত। ডিজাইনের সময়ে স্থপতি প্রথমেই একটা ধারাকে অনুসরন করতেন, কার্যকারীতাভেদে ভবনের বিভিন্ন স্পেসের আয়োজন করা হত ঐ ধারার কাঠামোর মধ্যেই। স্থপতিরা তাদের সৃষ্টিশীলতা চর্চা করত ডিটেইলিং এবং অলংকরনে । ড্রইং এ দক্ষ লুই কানের কাছে একাজ খুবই আকর্ষণীয় হয়ে উঠল। নিজের কাজ শেষ করে অন্যদের ড্রইংও করে দিতেন তিনি ( কিছু পারিতোষিকও পেতেন)। এই মতধারার মূল দর্শন যদি স্থাপত্য শিল্পে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার বিষয়টি হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে লুই কা’নের কাজে তার সুরটি সব সময়ই বেজেছে।Df17a95c E7d6 4b0e A4a0 91541996533d
779d838a 399a 4f7f Be0a 73b44f7b6315F574d2f5 B1da 43ae A469 7d7b36583057

১৯২৪ সালে যখন কা’ন একজন গ্রাজুয়েট হিসাবে বের হলেন, তখন তিনি পুরোদস্তুর ঐ Beaux Art ধারারই একজন। অথচ সেই সময়ে চারিদিকে আধুনিক স্থাপত্য ধারার জয়জয়কার। পুরাতন ধ্যান ধারনা, দীর্ঘদিনের প্রচলিত নিয়ম-রীতি ঝেড়ে ফেলে নতুনকে প্রতিষ্ঠার পালা। নতুনের আবাহনে জার্মান স্থপতি ওয়াল্টার গ্রোপিয়াস এবং মিইজ ভ্যানডার রো একদিকে আধুনিক স্থাপত্যকে কলকারখানায় উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্বায়নের ডাক দিচ্ছেন, অন্যদিকে লী কর্বুসিয়ের আধুনিক যুগের মানুষের জন্য ইম্প্রেশনিস্ট ধারার শিল্প সঞ্চিত সত্যনিষ্ঠ স্থাপত্যধারা সৃষ্টির প্রবক্তা।

আধুনিক প্রায়োগিক ডিজাইনে নতুন চিন্তাধারায় বিশেষ অবদান রাখল জার্মানীর বাহাউস। ওয়াল্টার গ্রোপিয়াস এবং শেষ দিকে মিইজ ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের মুল ব্যক্তিত্ব। বাহাউস চিন্তাধারার সাথে কা’নের পরিচয় ঘটল ১৯২৮ সালে অস্কার স্তোনোরভের মাধ্যমে, এই স্তোনোরভ পরে তার ব্যবসায়ীক পার্টনার হয়েছিলেন। ঐ বছর লুই কা’ন ইউরোপ ভ্রমণ করেন এবং এসব নতুন তত্বের সাথে প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত হন। যতই আধুনিক স্থাপত্য ধারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করছিল, ততই স্থপতিরা সেই দিকে ঝুকে পড়ছিল। অলংকার বর্জিত হওযায় নির্মাতারাও খুব খুশী, তবে কিছু লোক তখনও তাদের বনেদীআনা বজায় রাখতে আগ্রহী ছিলেন এবং তাদের সাথে ছিলেন কিছু জেদী স্থপতি।

১৯৩০ সালে ২৯ বছর বয়সে ইসথার ভার্জিনিয়া নামে একটি ইহুদী মেয়েকে বিয়ে করেন। ১৯৪০ সালে এই পরিবারে সু আ’ন নামে একটি মেয়ের জন্ম হয়। ইসথারদের পরিবারও ইমিগ্রান্ট তবে কা’ন পরিবারেরও আগে তারা যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন। চলনে-বলনে ওরা ছিলেন পুরোদস্তুর আমেরিকান, ফ্রাংক লয়েড রাইটের মত রমনী মোহন তিনি ছিলেন না, কিন্তু শুধু ইসথারেই মগ্ন ছিলেন না, তার বিখ্যাত স্থপতি সহকর্মী আনা গ্রিসওল্ড টিং এর গর্ভে ১৯৫৪ সালে আরেকটি মেয়ে আলেক্সান্দ্রা টিং জন্ম নেয়।

76e14051 6887 4def 861e 0ce530550d12
07a2c086 C28f 4802 A62e 58bd712d09b4
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় আর্ট গ্যালারীর সিড়ির নিচের ভাগবলে রাখা উচিত অনেকেই কা’নের কিছু কাজে আনা টিং এর প্রভাব লক্ষ্য করেছেন, কন্যা আলেক্সান্দ্রা টিং লুই কা’নের দর্শনের উপর বিশ্লেষণ ধর্মী বই লিখেছেন। ১৯৫৯ সালে হ্যারিয়েট প্যাটিসন নামে এক ল্যান্ডস্কেপ স্থপতির সাথে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আনা টিং এর সাথে ডিজাইন নিয়ে মতবিরোধের ফাকেই কা’ন এই মহিলার কাছে তার দর্শন এবং চিন্তাধারা বজায় রাখার অনুপ্রেরণা পান। ১৯৬৩ সালে তিনি একটি পুত্র সন্তানের জনক হন, ছেলের নাম নাথানিয়েল। আত্মমগ্ন কা’নের জীবনে তার স্ত্রী বা বান্ধবীরা খুব বড় ধরনের প্রভাব রেখে ছিলেন বলে মনে হয় না, তবে আনা টিং নিজেও বড় মাপের মানুষ ছিলেন, তিনি নিজেও স্থপতি হিসাবে যথেষ্ট সুনাম পেয়েছিলেন, কা’নের সাথে সহকর্মী হিসাবে কাজ করার সময়ে কা’নের ডিজাইনে রুক্ষ সততার বদলে কিছুটা পেলবতা এনে থাকবেন হয়ত। তবে তাদের মধ্যে ভাঙনও হয়েছিল, যখন টিং কা’নের স্থাপত্য দর্শনকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে নেবার চেষ্টা করেছিলেন। কা’নের নিজের মতের দৃঢ়তা এবং স্বকীয়তা বজায় রাখার শৈশব লালিত মনোভাব তাকে জীবনের দিক নিদের্শনায় সহায়তা করেছে।
১৯৩১ সালে স্থপতি জর্জ হাউই এর সাথে কা’নের পরিচয় হল, হাউই তখন লী কর্ব্যুসিয়েরের মন্ত্রে দীক্ষিত আধুনিক স্থাপত্য ধারায় যুক্তরাষ্ট্রে স্থাপত্য চর্চা শুরু করেছেন। ওদের একে অপরকে বুঝতে দেরী হল না, ৪০ এর দশকে হাউই, স্তোনোরভ এবং কা’ন একসাথে কাজও করেছেন। আধুনিক স্থাপত্য ধারাকে কা’ন প্রবল আগ্রহে গ্রহন করলেন, নির্মাণ পদ্ধতির সারল্য, কাঠামো পদ্ধতি এবং নির্মাণ উপাদানের প্রতি সততা এবং বাহুল্য বর্জিত, সরাসরি উপস্থাপনার জন্য। কিন্তু মনের মধ্যে খুত খুতানি রয়েই গেল, পুরানো যত কিছু আছে, মানুষের যত নির্মাণ ঐতিহ্য সবই কি মূল্যহীন, সবই অনর্থক?লাইব্রেরির অন্তপরিসরকে আলোর উপযোগী করতে ছাদের বিশেষ নকশা
93103845 455e 420e B3f8 Fb7f88d215b0

১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সাল পযর্ন্ত কা’নের ডিজাইনে আধুনিক ধারার কাঠামো পদ্ধতি ও নির্মাণ উপাদানের প্রতি সততাই বেশী ফুটে উঠেছে, তখনও তার নিজস্ব দর্শন গড়ে ওঠেনি। গ্রীক, রোমান, মিশরীয় সভ্যতার অনেক ভবনই তার কাছে অসাধারণ মনে হয়, ঐ সময়ের প্রয়োজনে ভবনগুলোতে যে মাহাত্ব্য (Monumetality অর্থে) আরোপিত হত তার প্রতি তার নিজের অন্তরের টান রয়েছে, রোমানদের ইটের গাথুঁনী তার কাছে কবিতার অক্ষরের মত। এমন সব অনবদ্য সৃষ্টিকে এক কথায় নাকচ করে দেয়া যায় না। একটি স্থাপনা তার নিজস্ব গুরুত্ব নিয়েই একটা জমির উপর বসে, তার ফর্ম তার প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্বের সাথে সমন্বয় করেই নির্ধারিত হয়। সকল ভবনের চেহারা একই হতে পারে না। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে নির্মাণ ক্ষেত্রে যে উৎকর্ষতা সৃষ্টি হয়েছে তাকেও সমভাবে বরণ করে নেয়া দরকার। যেকোন ফর্ম তৈরীর ক্ষেত্রে কনক্রিটের আশ্চর্য নমনীয়তা (Plasticity) এবং জমে যাওয়ার পরে তার রুক্ষ দৃঢ়তা তাকে ভীষণ আকর্ষণ করেছিল। এই নির্মাণ উপাদানটির মধ্যে তিনি একটি অপ্রকাশিত তেজ অনুভব করেছিলেন। ইটের ক্ষেত্রে তিনি লক্ষ্য করলেন, সারা দুনিয়াতেই ইটের বাড়ী আছে, ইটের গাঁথুনি এবং ইট নির্মিত কাঠামোতে নানা বৈচিত্র রয়েছে। মানব সভ্যতার ঐতিহ্যের প্রতিটি পরতে পরতে ইটের গাঁথুনির ধারাবাহিকতায় তিনি নিজের সৃষ্টিকেও মিলিয়ে দিতে চাইলেন, আমরা তার পরবর্তী কালের স্থাপত্য কর্মে দেখব যখন যেমন প্রয়োজন ইটের নির্মাণ প্রযুক্তি তিনি সভ্যতার ঐতিহ্য থেকে টেনে নিয়ে কাজে লাগিয়েছেন। এইখানে তিনি আন্তর্জাতিক, প্রযুক্তি কোন দেশের গন্ডীতে আবদ্ধ থাকতে পারেনা, যার যেমন প্রয়োজন, প্রযুক্তির থলেতে হাত ঢুকিয়ে নিয়ে নিতে হবে। ইটের গাঁথুনির ক্ষেত্রে রোমানদের বৈচিত্রময় চর্চাকে তিনি খুবই আগ্রহের সাথে অনুশীলন করেছিলেন, হয়ত এক্ষেত্রে তার বিভিন্ন ডিজাইনের সেই প্রভাব কিছুটা অনুভূত হতে পারে। ১৯৫২ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যালবট হ্যামলিন একটা বই লিখলেন ‘বিংশ শতাব্দীতে স্থাপত্যে ফর্ম এবং ব্যবহারীক উপযোগীতা’, বইটিতে তিনি সেই Beaux Arts এর মূল সূত্র তুলে সমকালীন পরিপ্রেক্ষিতে তাদের প্রাসঙ্গিকতা যে যথেষ্টই উপযোগী তা ব্যাখ্যা করলেন, হ্যামলিন তিনটি মূল বিষয় চিহ্নিত করেছেন, প্রথমটি হল, ভবনটি কি কাজে ব্যবহৃত হবে। এরপরে ভবনের স্থায়ীত্ব, এই স্থায়িত্ব কথাটি দুইটি অর্থেই প্রয়োগ হবে, ভবনটির কাঠামোর স্থায়িত্ব এবং ভবনটি দেখেও যেন ভরসা হয় যে, হ্যাঁ বেশ জবরদস্ত ইমারত বটে। তৃতীয় বিষয়টি হল, সৌন্দর্য, যে কোন মহৎ স্থাপত্য দৃষ্টি নন্দন হতেই হবে। আধুনিক স্থাপত্য কি এই তিনটির কোন একটি বিষয়কে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে পারে? হ্যামলিন পুরানো কালের ভবনের ডিজাইনে যে শৃংখলা অনুসৃত হত তা যুগের প্রয়োজনে ছাড় দিয়েছেন। এই কথাগুলো কা’নেরও মনের কথা, কিন্তু আধুনিক স্থাপত্য ধারার মধ্য দিয়ে এদের স্বীকৃতি কিভাবে দেয়া যায়?

গ্রীক বা রোমান স্থাপত্যে ভবনের ফর্মগুলি একটা অর্ডারের আওতায় নিয়মমাফিক বড় বা ছোট হয়ে বসে যেত, নির্মাণ পদ্ধতিও যুগ যুগ ধরে প্রায় একই। আধুনিক স্থাপত্য এই ছকে বাধা সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেছে, নির্মাণ পদ্ধতি আমূল বদলে গেছে।

উনিটেরিয়ান চার্চের ছাদ
C84f3293 Bc76 4612 8a0d 6977423ac0d4
কা’ন ফর্মকে নতুনভাবে অনুধাবন করতে চাইলেন, ‘বাড়ী বলতে আমরা কি বুঝি? এর একটা বাহ্যরূপ আছে, আরেকটা চেতনাগত রূপ আছে, ঐ চেতনাগত রূপের মধ্যে কিন্তু কোন আকার বা মাপ-জোক নাই, ঐ চেতনার মধ্যে কতগুলি মানুষের কিছু প্রয়োজনের কথা আসছে। যখন ডিজাইন করা শুরু হয় তখনই চেতনাটি মূর্ত হতে থাকে, আকার পেতে থাকে। স্থপতিদের মধ্যে উপলব্ধির তারতম্য থাকে, সেটা নির্ভর করে তিনি কতটা গভীরভাবে ঐ মানুষগুলোকে বুঝতে পারছেন। তাহলে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সম্মন্ধে স্থপতির যে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠে তা থেকেই তিনি যদি সৃষ্টি করেন, প্রত্যেক ফর্মই হতে পারে অনন্য। বাস্তবে কি তাই হচ্ছে? স্থপতির চেতনাটি সম্পূর্ণ শুদ্ধ নয়। তার শিক্ষা-দীক্ষা, ছোটকাল থেকে যে পারিবারিক পরিবেশে তিনি গড়ে উঠেছেন, নিজের চলার পথের অভিজ্ঞতা, এসব নিশ্চয়ই তার চেতনার ভিত্তিমূলে জমে আছে। তাই ফর্মহীন চেতনার আতিশয্যে হারিয়ে যাওয়া কা’নের পক্ষে সম্ভব হয়নি, তার ডিজাইনে নতুন ধারার নির্মাণ শৈলীর সাহায্য নিয়ে পরিবর্তিত ছক আত্মপ্রকাশ করেছে। আকার আকৃতি নতুন, নির্মাণ শৈলী আধুনিক, নির্মাণ উপাদান নতুন কিন্তু নতুন হলেও শৃংখলা আছে, মানুষের মনে স্থায়ীত্বের বাসনায় ভবনের মনুমেন্টালিটির প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। তাহলে কা’ন মৌলিক কি করেছেন, মৌলিকত্ব তার স্থাপত্য সংগীত সৃষ্টিতে, স্পেসের ছন্দ, বড়-ছোট-বড়, আলো আধাঁরী, প্যাটার্ণ, আকার ও আকৃতির মধ্যে দ্বন্দ এবং সামগ্রিক ঐক্য, এসব মিলিয়ে কা’নের সংগীত। শৈশবে সংগীত বা স্থাপত্য এই দুইয়ের মাঝে স্থাপত্যকে বেছে নিয়েছিলেন, পরিণত বয়সে নিজেকে একজন সংগীত স্রষ্টা হিসাবেই মনে হয় দেখতে পেয়েছেন, যদিও পিয়ানো নয় তার সঙ্গীত লিপিবদ্ধ হয়েছে ইটে আর কনক্রিটে।Fe4182c2 7d0c 499c A237 6fde40bd6289
আলোকিত সিড়ি পথ

লুই কা’নের বিখ্যাত সব কাজই পরিণত বয়সের, বিভিন্ন মতের সূদীর্ঘ অনুশীলনে তিনি নিজস্বতা হারাননি, বরং নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। শিক্ষকতা করতে এসেই হয়ত সমগ্র পটভূমিকে একত্রে গাঁথবার সুযোগ হয়েছে। কাজ করেছেন বিখ্যাত সব স্থপতিদের সাথে ফলে নামডাক ছড়িয়ে পড়তে দেরী হয়নি। লেখালেখি, সেমিনার, গবেষণা এবং শিক্ষকতা যেমন তার দার্শনিক মনোভাবকে পরিপুষ্ট করেছে, তেমনি কর্মক্ষেত্রে তার সৃজনশীলতা, স্বকীয়তা একনিষ্ঠতা তাকে মহান স্থপতি হিসাবে পরিচিত এনে দিয়েছে। বাংলাদেশের শেরেবাংলা নগর ও সংসদ ভবন তার পরিণত বয়সের কাজ, সংসদ ভবনের সমাপ্তি তিনি দেখে যেতে পারেননি। সংসদ ভবনের পাশাপাশি একই সময়ে তিনি ভারতের আহমেদাবাদে ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট নামে একটি প্রকল্প ডিজাইন করেছিলেন। এদুটো কাজই আয়তনের দিক থেকে সম্ভবত তার সবচেয়ে বড় নির্মিত প্রকল্প। ১৯৭৪ সালে ভারত থেকে ফেরার পথে নিউইয়র্কের একটি রেল স্টেশনে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি হঠাৎ মারা যান। কয়েকদিন পরে সকলে জানতে পারে এই মহান স্থপতির মহা প্রস্থানের শোকবার্তা।

কা’নের স্থাপত্য ভাষায় প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব, লুই কা’নের ডিজাইন করা অধিকাংশ বিল্ডিংই শেষ পর্যন্ত নির্মিত হয়নি, তবুও কিছুটা ধারণা দেবার জন্য তার কয়েকটি প্রকল্প সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরছি।

ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়, আর্ট গ্যালারী (১৯৫১-৫৩)

যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট রাজ্যের নিউ হ্যাভেনে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯২৮ সালে গথিক ভাব ধারায় নির্মিত একটি আর্ট গ্যালারীর বাড়তি সংযোজন হিসাবে এই প্রকল্পটি গৃহিত হয়। কর্তৃপক্ষ অনেক যাচাই-এর পর লুই কা’নকে এর ডিজাইনার মনোনীত করেন। তখন কা’ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেন পাশাপাশি নিজের ডিজাইন ফার্মও চালাচ্ছেন। স্থপতি আনা টিং ছিলেন তার সহযোগী। কা’নের পরিণত বয়সের এই কাজটি কা’নকে নতুন ধ্যান-ধারনার প্রবক্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ভবনের ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তাই তার আকার-আকৃতি নির্ণয়ের মূল নিয়ামক এই আধুনিক চিন্তাধারার থেকে কিছুটা সরে এসে স্থাপত্যে সেবক এবং সেবিত স্পেসের ধারনার বাস্তব প্রয়োগের সূত্রপাত সম্ভবত এই ভবনেই ঘটেছে।

435f2cb4 4e7c 4507 8073 66db4b80e427
E570ccb4 9592 4b82 866b 538f13f93eba
917ca7f2 0951 4610 9ea6 2e28617060bd
গ্যালারীর জন্য একটা বিশাল একক স্পেস, তার মধ্যে প্রদর্শনীগুলো অস্থায়ী এবং বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে সাজানোর সুবিধা থাকতে হবে এমন একটা চাহিদা কা’নের সামনে রাখা হয়েছিল। কা’ন ভবনটির বহিরাবরণে মিইজ গ্রোপিয়াসের মত প্রচুর কাঁচ ব্যবহার করলেও ভিতরে একটি স্পষ্ট সেবক স্পেস তৈরী করলেন। ত্রিকোণাকৃতির ওয়াফ্ল ছাদের নীচে তৈরী হল বড় বড় হল, ছাদটি নিয়মিত কলামের উপরে বসানো। ওয়াফ্লের ভিতর দিয়ে ফুটা করে পাইপ সহ অন্যান্য সকল সার্ভিস লাইন নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ত্রিকোণ খোপগুলির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা থাকায় ছাদটি একটি অনবদ্য পরিপ্রেক্ষিত তৈরী করেছে। আগের যুগে যে কোন বড় ইমারতে ভারবহন করার জন্য পুরু দেয়াল অথবা ভারী কলাম থাকত, নির্মাণ প্রযুক্তির আধুনিকায়নের ফলে অনেক বড় কনক্রিটের ছাদ ও সরু কলামের উপর দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ভারবাহী দেয়ালের প্রয়োজন লোপ পাচ্ছে। এই আর্ট গ্যালারীর বিশাল ছাদ মূলত কলামের উপরে থাকায় কা’ন ভারী দেয়ালের বদলে কাঁচের দেয়াল ব্যবহার করেছেন। ফলে ভবনটির একটা হালকা আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে ছাদটির পুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে (পুরু দেয়ালের বদলে পুরু ছাদ) ছাদের মধ্যদিয়ে সার্ভিস লাইনগুলো নিয়ে গিয়ে ছাদের পুরুত্বের যথার্থতা প্রমান করেছেন। এখানেও একপ্রকার সেবক ও সেবিত স্পেস কাজ করছে।829bdd07 1f35 457d Af60 3fb1efead7d7
4a4d227d 1f09 4ba8 Aa46 99903e452ef5Dd9d3ac7 D009 47dd Ac88 Ce16527dc5aa

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট (১৯৬২-১৯৭৪)
আহমেদাবাদ, গুজরাট, ভারত

 

যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে লুই কা’নের বিখ্যাত এবং বড় প্রকল্পের একটি আহমেদাবাদের এই প্রকল্পটি। প্রকল্পটি ডিজাইনের জন্য প্রথমে ভারতের বিখ্যাত স্থপতি বি.ভি.দোশীকে আহবান করা হলেও পরে দোশীর পরামর্শে লুই কা’নকে এই কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়। ঐ সময়ে লী কর্ব্যুসিয়েরের ভাবশিষ্য দোশী গুরুর ডিজাইন করা একটি মিউজিয়ামের নির্মাণ তদারকিতে ব্যস্ত ছিলেন। তাই কা’নকে মূল স্থপতি নির্বাচিত করা হল এবং দোশীর ডিজাইন ফার্ম হল এই প্রকল্পের স্থানীয় সহযোগী। দীর্ঘ সময় ধরে ৬৩ একর জমির উপর নির্মিত প্রকল্পটির সমাপ্তি কা’ন দেখে যেতে পারেননি। তার জীবদ্দশায় কয়েকটি ভবনের নির্মাণ শেষ হয়েছিল। এই প্রকল্প তদারকী করে বাড়ী ফেরার পথেই কা’ন মারা গিয়েছিলেন।

Dbdbf3e2 0a0a 4c25 Aef4 D4b522b2f8b7
4cf7bdf9 8f4d 4ded A767 642425189036শিক্ষার্থী ডরমিটরী 1
মূল শহরের অনেকটা বাইরে একটা সমতল জায়গা এই প্রকল্পের জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল। এটি একটি পরিপূর্ণ আবাসিক শিক্ষাকেন্দ্র, উচ্চতর ব্যবস্থাপনা শিক্ষা দেওয়া হয়। শহর থেকে বাইরে হওয়ায় এই প্রকল্পটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হয়েছে। মূল শিক্ষাভবন এবং ফ্যাকালটি ছাড়াও ডরমিটরী, হোস্টেল, শিক্ষকদের এবং অন্যান্য কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা। ভবন ডিজাইনের পাশাপাশি লুই কা’ন শহর ডিজাইনেও কত অগ্রসর ছিলেন তার সাক্ষ্য বহন করছে ভারতের এই প্রকল্পটি। সাইট প্লান দেখলেই বুঝা যায় ভবনগুলির অবস্থান তাদের প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্বের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছে, যেমন মূল প্রবেশ পথের নিকটেই শিক্ষা ভবনগুলি এবং কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা একদম পিছনের দিকে। বিল্ডিং-এর আকার-আকৃতিগুলিও একই ভাবে গুরুত্বের বিচারে পরিবর্তীত হয়েছে। এই ভবনটি এই কাজের জন্য, তাই ভবনটির চেহারায় সেটি প্রকাশিত করার চেয়ে বরং শহরের আমেজকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। একটা ডরমিটারি একটা শিক্ষা ভবন থেকে চেহারাগত বৈশিষ্টে আলাদা নয় কিন্তু আকৃতিতে ডরমিটারি হয়ত ছোট। একটি প্রকল্পের মধ্যেই প্রতিটি বাড়ী নানা ধরনের হলে বিশৃংখল মনে হ’ত। পোড়া ইটে তৈরী (প্লাস্টার করা হয়নি) ভবনগুলির মধ্যে একটা সাযুজ্য এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে। ভারতে ইটের ব্যবহারে বৈচিত্রময় ঐতিহ্য আছে, এখানে ইট ব্যবহার হলেও নির্মাণ কৌশলে যে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে তা প্রতিটি প্রচ্ছদে প্রকাশিত। আন্তভবন বহিস্থ স্পেসগুলির মধে ছন্দময়তা এবং কা’নের নিস্তব্ধতার অন্বেষণের চিহ্ন হিসাবে জলাধার রাখা হয়েছে। জলাধারটি মূল ভবনের সাথে সেবক এলাকাটির একটি বাস্তব বিভেদ তৈরী করেছে। আমাদের শেরেবাংলা নগরে কা’নের ডিজাইন করা বিভিন্ন ইটের ভবনের সাথে অনেক কিছুই বাহ্যত মিলে যায়। অবশ্য কানের পরিণত বয়সের বেশীরভাগ কাজেই বস্তুর প্রাথমিক জ্যামিতিক আকার যেমন বর্গ আয়ত ক্ষেত্র, বৃত্ত, ত্রিকোণ, এগুলি বারবার ফিরে এসেছে। প্রাথমিক আকৃতিগুলো পরস্পরের সাথে ত্রিমাত্রিক আত্মীয়তা পাতিয়ে স্পেসের একটা শৃংখলা সৃষ্টি হয়েছে যা কা’নের দৃষ্টিতে ব্যবস্থাপনা বিষয়টিরও সার কথা। অবশ্য ব্যবস্থাপনার বহুমাত্রিকতা মনে রেখেই কা’ন এই প্রকল্প ডিজাইন করেছেন বললে হয়ত বাড়িয়ে বলা হবে। ডিজাইন স্টাডি পর্যায়ে তার স্কেচ বা মডেলগুলো দেখলে বুঝা যায় তার ডিজাইনে তার নিজস্ব দর্শনই প্রবল এবং এই দর্শনই তার পরিণত বয়সের প্রায় সকল ভবনে প্রতিফলিত হয়েছে। আহমেদাবাদের এই বিশাল প্রকল্পটিও তার ব্যাতিক্রম নয়।আলোকিত করিডোর
1d0bfe70 A392 4fa5 B5c2 5a1b80c5c2af

শেরে বাংলা নগর ও সংসদ ভবন (১৯৬২)
ঢাকা

পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী হিসাবে ঢাকায় একটি প্রশাসনিক শহর গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক আইযুব সরকার। এদেশে গণতন্ত্র বিকাশের উদ্দেশ্যে নয়, দেশের মানুষকে তাক লাগানো উন্নয়ন কর্মকান্ড দেখানোটাই মূখ্য। তাই তারা বিশ্বখ্যাত স্থপতিদের দিয়ে এই কাজ করাতে চাইলেন। লী কর্বুসিয়ের এবং আলভার আলটো ব্যস্ততার অজুহাতে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন কিন্তু কা’ন আগ্রহে গ্রহন করেন। এসব বিখ্যাত স্থপতিদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের বিখ্যাত স্থপতি মাজহারুল ইসলাম অবদান রেখেছিলেন।

2605526a A8f1 4ef6 89b4 A2d310e88f07

লুই কা’ন অবশ্য পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদেও প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ সহ একটা বড় প্রকল্প ডিজাইন করেছিলেন। জমি যতটা বরাদ্দ ছিল, কা’ন তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী চেয়ে বসলেন, মঞ্জুরও হল, প্রকল্পে কি কি থাকবে তা সঠিকভাবে এখানে কেউ জানে না, ফলে কা’ন পেয়ে গেলেন সীমাহীন সুযোগ এবং তিনি তা কাজে লাগালেন। যদিও শেরে বাংলা নগরের জন্য কা’নের প্রস্তাবিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভবন আজও নির্মিত হয়নি, হয়ত বা হবেও না, তবে যতটুকু হয়েছে সেটুকুর জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্থাপত্য ম্যাপে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। কা’নের এই অনবদ্য সৃষ্টি (স্থানীয় নির্মাণ দক্ষতা যথাযথ না হওয়া সত্ত্বেও) খুব সম্ভব তার মহত্বম কাজ এবং এই উপমহাদেশে তাজমহলের পরে সবচেয়ে নন্দিত স্থাপত্য কির্তী।

প্রথম পর্যায়ে ২০০ একর জমিতে সংসদভবন, সংসদ সদস্যদের আবাসিক ভবন, প্রেসিডেন্টের ও স্পীকারের বাসভবন ইত্যাদি এবং পরবর্তী পর্যায়ে আরও ৮০০ একর দেয়া হয় হাসপাতাল, সচিবালয়, উচ্চ পদস্থ, মধ্য পর্যায়, ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আবাসিক কোয়ার্টার এবং আরও অন্যান্য বেশ কিছু সংশ্লিষ্ট অফিস ভবন তৈরীর জন্য। কা’ন সংসদকে উচ্চ পর্যায়ের মানুষের সম্মেলনের স্থান হিসাবে চিহ্নিত করলেন। এই মানুষদের চিন্তা উচ্চমার্গে, সূক্ষ্ম বিষয়গুলি তারা বুঝবেন। তারা মিলে জাতির ভবিষ্যত নির্ধারণ করবেন, একটা অতি পবিত্র দায়িত্ব তাদের কাঁধে। তাদের জন্য চাই গভীর চিন্তা করার মত শান্ত পরিবেশ, সংসদ ভবনে তারা যখন ঢুকবেন মনের মধ্যে যেন আপনা-আপনি একটা পবিত্রতা চলে আসে, তাই প্রবেশ পথেই থাকবে প্রার্থনার জায়গা।

9e933781 6486 43f4 87dc 9937fdbb895f
7e9c32b5 5a48 4b68 Ace2 7addceec2665প্রাকৃতিক আলোয় আলোকিত করার জন্য সভাকক্ষের ছাদের বিষেশ ডিজাইন

ভবনটি জাতির সম্মানের প্রতীক তাই তাকে দৃঢ় এবং বিশাল হতে হবে, দেখলে সম্মানে মাথা নীচু হয়ে যাবে। কা’নের এমন চিন্তার অন্তস্থলে ধর্মীয় আত্মত্যাগের রেশ রয়েছে এবং তার জীবনের নিজস্ব পটভূমি ও জীবন বোধ হয়ত এমন আদর্শ পরিস্থিতি কল্পনা করতে সাহায্য করেছে। আমাদের বাস্তবতার সাথে তার কোন মিল নেই, কিন্তু কা’ন তার সৃষ্টির মূলভাব এরচেয়ে কম কিছু ধরলে আমরা নিশ্চয়ই সহজে মেনে নিতাম না।শেরেবাংলা নগরের ভবনগুলোর পরিচয় সকলেই জানেন বা জানতে দেরী হবে না। তবে কি ধরনের চিন্তা থেকে এই অভূতপূর্ব কীর্তি রচিত হয়েছে তা জানানো মনে হয় বেশী দরকার।

সংসদ ভবনে ৩০০ সংসদ সদস্যের সম্মেলন কক্ষটি কেন্দ্রে রেখে চারদিকে ঘুরে আসার জন্য একটা পথ রয়েছে। পথের বাইরের দিকে অন্যান্য কক্ষ, অর্থাৎ মূল সম্মেলন কক্ষ থেকে অন্যান্য সকল কার্যক্রমই গৌন এবং সরিয়ে দেয়া হয়েছে। পথটি একটা গলির মত, দুপাশেই ভবন, ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে পথ দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কয়েকটি ব্রীজ দিয়ে দুটি সারিকে বিভিন্ন স্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। স্থপতির সেবীত এবং সেবক স্পেসের বিভাজনের দর্শন এখানে পরিস্ফুট।

A044c17b F4f4 4273 84a2 Aaca928b5365
De356576 Fe72 497c 9184 224f43f87f20

অনেকেই সমালোচনা করেন ‘আমাদের মত গরীব দেশে কেন এমন একটি ব্যয় বহুল ভবন নির্মাণ করা হল’ এমন মন্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা এখন আর নেই। তবে ভবনটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে (দর্শনীর বিনিময়ে হলেও) রক্ষণা বেক্ষণ খরচ উঠে আসতে দেরি হবে না। একজন কবি বা শিল্পীর কাছে তার সৃষ্টির মাধ্যমে অমর হওয়ার আকাংখা এতই প্রবল যে তার বিপরীত অন্য কোন আকর্ষণই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ষাটোর্ধ্ব বয়সে যখন লুই কা’ন এমন অবারিত সুযোগ পেলেন তখন তিনি তার পূর্ণ সদব্যবহার করেছেন, তিনি কালোত্তীর্ণ একটা প্রকল্প তৈরী করে গেছেন, তার জানার ইচ্ছা থাকার কথা নয় যে ক্লায়েন্ট ধনী না গরীব। যদি গরীবই হত তাহলে সংসদ ভবন বানানোর খায়েশ কেন? তবে একথাও মনে রাখতে হবে, স্থপতি অযথা খরচ বাড়িয়ে দিয়েছেন তা নয় বরং অলংকারহীন রুক্ষ কনক্রিটের মাঝে সামান্য কিছু মার্বেল পাথরের টুকরো দিয়ে কতগুলো লাইন টেনে দিয়েছেন। কিন্তু দেখুন এই সাদামাটা চেহারায় যে ভবনটি আমাদের সামনে দাঁড়ানো তার সামনে দুনিয়ার তাবৎ অলংকৃত ভবনও ম্রিয়মান হয়ে পড়ে। এই মাহাত্ব্য স্থপতি সৃষ্টি করেছেন ভবনটির দৃঢ়তা দিয়ে। পরিবেশের প্রেক্ষিতে বিশালতার আমেজ (Monumentality) তৈরীর মাধ্যমে, আর ভবনের অভূতপূর্ব ফর্ম বা আকৃতি দিয়ে। তার সৃষ্ট ফর্ম বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের। তার এই স্থাপত্য শুধুমাত্র বাঙালীর নয়, সমগ্র মানব জাতির। আমরা তা ধারণ করে আছি মাত্র।

সংসদ ভবনের উচ্চতাকে, তার মাহাত্ব্যকে দ্বিগুণ করা হয়েছে কৃত্রিম জলাধারে স্থির পানিতে প্রতিফলনের মাধ্যমে। প্রতিফলন কোন বাস্তব বস্তু নয়, ছায়া, সংসদ ভবন জাতীর আশা আকাংখার প্রতীক। তার বাস্তব উচ্চতা থেকেও তাকে জনমনে বহুগুণে বিস্তারিত হতে হয়। সংসদ সদস্যদের জন্য আবাসিক বাড়ীগুলি গলার মালার মত গ্রন্থীত সেই মালার লকেট যেন সংসদ ভবন। আকাশ থেকে না দেখলে ভবনগুলির এই মালা সদৃশ বিন্যাস বোঝার কথা নয়, তাই স্থপতি ঐ কৃত্রিম জলাধারটির আকার দিয়ে বিন্যাসটিকে সর্বজনের বোঝার মত সহজ করে দিয়েছেন।

অলংকৃত দেয়াল

লাল ইট ব্যবহার করেছেন, আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে ইট ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু তার নির্মাণ পদ্ধতি আধুনিক, ইটের আকার আন্তর্জাতিক। আমরা ইটকে আস্তর দিয়ে ঢেকে দিতে অভ্যস্ত, তিনি উন্মুক্ত রেখেছেন। নির্মাণ পদ্ধতির, নির্মাণ উপাদনের প্রতি সততা বজায় রেখেছেন। লাল ইট, কনক্রিট এদের রঙে বৈপরীত্য প্রকট কিন্তু তিনি তাদের একটি ছন্দে গেঁথেছেন অপূর্ব শৈলীতে।

এই প্রকল্পের প্রতিটি ভবন তার ব্যবহারিক দিক থেকে সফল একথা বলা যাবে না, সব চেয়ে দামী স্যুট পরলেও গা কুট কুট করতে পারে, আমরা সে সমস্যা প্রকাশ করিনা বরং মূল্যবান স্যুটের কথা প্রচার করে নিজেকে গৌরাবান্বিত করতে চাই। এক্ষেত্রেও আমাদের বিষয়টা তেমন ভাবেই দেখা দরকার, হোক না অসুবিধা কিন্তু আমরা একটা বিশ্ব বিখ্যাত শিল্প কর্মের মালিক।

097c2ddc 8e06 41f7 Bad3 9183a9918c1e
C7cc6382 B0b1 47aa 8307 4b39013be2dd

সল্ক ইনস্টিটিউট (১৯৫৯-৬৫)
লা জোলা, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

 

সল্ক ইনস্টিটিউট মূলত: উচ্চ পর্যায়ের জৈব গবেষণার (Biological research) একটি প্রতিষ্ঠান। এর কর্ণধার জোনাথন সল্ক ছিলেন দার্শনিক প্রকৃতির মানুষ। তিনি প্রতিষ্ঠানটির জন্য একটা নতুন গবেষণা কেন্দ্র নির্মাণের জন্য উচ্চ মননশীল একজন স্থপতি খুঁজছিলেন। তার এক বন্ধুর মাধ্যমে লুই কা’নের সাথে পরিচয় হল এবং জোনাথন ক্রমশ কা’নের চিন্তার গভীরতা বুঝতে পারলেন। ডিজাইনের কাজটা কা’নকে দেয়া হল। অনেকগুলি জায়গা দেখার পর কা’ন প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে ক্যালিফোর্নিয়ার লা জোলার এই পাহাড়ী জায়গাটা নির্বাচন করলেন। সল্ক কা’নকে প্রকল্পের মূল চাহিদাগুলো বুঝিয়ে দিয়ে বাকি সব সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা দিলেন। গবেষণার জন্য, কত জায়গা থাকবে, গবেষকরা কোথায় থাকবেন, কেমন হবে তার পরিবেশ সবই কা’নের সিদ্ধান্ত।

5ff2c992 6577 496a B2fd 863ba27efc70

B7e31d42 0367 4881 8f63 0881819ba2d6

কা’ন এই ডিজাইন করতে গিয়ে অনেকভাবেই মাস্টার প্লান সাজিয়েছেন এবং তার পরে সিদ্ধান্ত বদল করেছেন। শেষ অবধী দেখা গেল ১৯৬৫ সালেও সম্পূর্ণ প্রকল্প নির্মিত হয়নি, টাকাও আর নেই। তবুও যতটুকু হয়েছে সেটুকুর জন্যই যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপত্যের ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে রইলেন।

নির্মাণ বা ব্যবহারিক সাফল্য সল্ক ইনস্টিটিউটের মূল প্রতিপাদ্য নয়। এর উপস্থাপনা এমন ভাবে করা হয়েছে যে, যারা এখানে আসবেন কাজ করবেন তারা জানবে, অনুভব করবেন যে, তারা সাধারণ পর্যায়ে আর নেই। দুটি পাশাপাশি ভবনের মাঝ খানের উঠোনটিতে দাঁড়ালে দিগন্তে হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি চলে আসে। জন’কোলাহল নেই। সামনে সুনীল আকাশ, উঠোনের মাঝখান দিয়ে একটা জলের ধারা নেমে আসছে, সবমিলিয়ে আত্ম বিস্মৃত হবার পালা। ভবনের গবেষকদের কক্ষগুলি থেকেও যে নৈসর্গীক দৃশ্য চোখে আসে তা শুধু চোখকে তৃপ্তী দেয় না, মনকে আপনভোলা করে তোলে।

981a5fe3 A31a 4b60 8cb6 85114446c162443bce4e 183b 4320 Ae31 Aefded40f319
6fe2ac94 7d87 4e20 873a 88977f9c9d49B103cd60 Bacd 4cd5 96d6 2447fd08766e

সল্ক ইনস্টিটিউটের ডিজাইনের সময়ে কা’ন বিজ্ঞানী বা গবেষকদের মানব কল্যানের জন্য বা জীবনের খুটিনাটি থেকে সরে থেকে আত্ম নিয়োগের প্রবনতার বিষয়টিকে গভীর মনোযোগের সাথে বিশ্লেষণ করেছেন। যারা এখানে কাজ করবেন তাদের চাই একাকীত্ব। ভাবতে হবে, গবেষণাগারে পর্যবেক্ষণের ফলে যা পাওয়াগেল তার হিসাব মিলাতে হবে। এর জন্য চাই নিস্তব্ধতা। খোলা আকাশের নীচে এক মহাজাগতিক নিস্তব্ধ পরিবেশ, মাঝখানের উঠোনটা এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে যেন এখানে সময় থমকে দাঁড়িয়েছে একটা রহস্য উদঘাটনের আশায়। উঠোনের দুপাশ কনক্রিটের দালানগুলোর উচ্চতা খোলা পরিসরটিকে বস্তু এবং ভাব জগতের মধ্যে একটা চমৎকার ভারসাম্য এনে দিয়েছে। কা’নের অন্তরে যে আধ্যাত্মিক মনটি বিরাজ করত, সেটি এখানে অনেকটাই প্রকাশিত।

এই প্রকল্পের মাস্টার প্লান থেকে শুরু করে প্রতি স্তরেই সেবিত ও সেবক স্পেসের বিভাজন রয়েছে, বিশাল ল্যাবরেটরিগুলোতে নানা ধরনের সার্ভিস পাইপ থাকে, সেগুলি লুকানোর জন্য একটা ছাদ এবং পরবর্তী ফ্লোরের মাঝখানে একটি স্বল্প উচ্চতার স্পেস তৈরী করা হয়েছে, এটি সার্ভিস ফ্লোর, মানুষ ঢুকে মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতে পারবে। এই সার্ভিস ফ্লোর ধারনাটি তার বিভিন্ন কাজেই খুজে পাওয়া য়ায়। মূখ্য পরিসর ল্যাবরেটরী এবং এই সার্ভিস ফ্লোরটি তার সেবক। ইমারত কাঠামোর আকৃতির মধ্যে আছে প্রতিসাম্য, আবার ভিতরে উন্মুক্ত ও আলোময়, আধা উন্মুক্ত এবং বদ্ধ এমনি নানা স্পেসের ছন্দবদ্ধ বিন্যাস। কা’নের নিঃশব্দতা এবং আলোর সমন্বয়ে ভিতর বাহিরকে একত্রে গাঁথার এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ মালা বলে শিল্পনুরাগীরা মত দিয়েছেন।

C846a3b7 90eb 49e2 Ae1e 3b252aec4b83
A270e01f 7e3f 47e8 812e 60125269547d

কিম্বেল আর্ট মিউজিয়াম (১৯৬৬-১৯৭২)
ফোর্ট ওয়ার্থ, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র

কে কিম্বেল এবং তার স্ত্রী তাদের সংগ্রহে থাকা বিপুল শিল্পকর্মের ভান্ডার সকলের জন্য উন্মুক্ত প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে একটা মিউজিয়াম বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। সেই উদ্দেশ্যে প্রথমেই ‘কিম্বেল ফাউন্ডেশন’ নামে একটা সংগঠনও তৈরী করে ফেললেন। ১৯৬৫ সালে রিচার্ড ব্রাউন মিউজিয়ামের পরিচালক নিযুক্ত হলেন। তিনি লুই কা’নকে এই মিউজিয়ামের ডিজাইনের দায়িত্ব দেন। সাড়ে নয় একর জমিটি পার্কের পাশে এবং এর কাছেই তখন বিখ্যাত স্থপতি ফিলিপ জনসনের ডিজাইন করা ‘আমন কার্টার মিউজিয়াম’ ইতিমধ্যে খ্যাতি লাভ করেছে।

কা’ন প্রায় ৩ বছর লাগিয়ে শিল্পকর্মের প্রদর্শনীর এই নতুন ফর্মের প্রকল্পটি ডিজাইন করলেন। এই দীর্ঘ সময় তিনি অলস ভাবনায় পড়ে ছিলেন না। বেশ কয়েকটি ডিজাইনের খসড়া করে শেষ পর্যন্ত এই সারিবদ্ধ ভল্ট ছাদের ভবনটিকে বাস্তবে রূপদান করেন। ফোর্ট ওয়ার্থের এই এলাকার অদূরেই সে সময়ে একটা শষ্যের সাইলো বা গুদাম ছিল, তার দেয়ালগুলো খাড়া কাঠের গুড়ির মত, দেয়ালের এই আকৃতিটিকে তিনি ছাদে রূপান্তরিত করলেন।

পর পর ৬ টি দীর্ঘ ভল্ট দিয়ে এই বিশাল ভবনটিকে ঢাকা হয়েছে, মাঝ বরাবর ঢোকার মুখে বেশ খানিকটা প্রতিসাম্য বজায় রেখেই কেটে দেয়া হয়েছে। ঐতিহ্যগত ভাবেই দেখা যায় যেখানে ভল্টের মত (অর্ধেক ড্রামের মত) ছাদ দেয়া হয় সাধারণত প্রবেশমুখ হয় এক প্রান্ত থেকে। এতে ভল্টের গভীরতা খুব ভালভাবে বোঝানো যায়, এক্ষেত্রে ঘটেছে তার উল্টোটা। বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে এটা কোন গীর্জা নয়, শিল্প কর্মের মিউজিয়াম, ছাদ থেকে তাই আলো নেয়া হয়েছে ছাদের মাঝ বরাবর ফাঁকা রেখে।

194cbe29 805b 4a4a 8129 Cd1c0e5ee9f997d9d4ac Ec37 4f9e Bd77 A123a791d390
আলো ভল্টের মধ্যে দিয়ে আসায় সমগ্র ভল্টটি আলোকিত হয়ে নানা কৌণিক দিকে প্রতিফলিত হয়েছে। ভল্টের মাঝের ফাঁকাটিকে অদৃশ্য রাখার জন্য অনেক স্থানেই ওর নীচেই প্রতিফলন সিলিং ব্যবহার করা হয়েছে। ভল্টগুলি যথেষ্ট উচু এবং চওড়া, নীচে কিন্তু দেয়াল নেই কলামের উপর সেগুলি বসানো। ফলে প্রদর্শনী দেখতে আসা মানুষ ছবির উপরেই সম্পূর্ণ মনোযোগ দেন। মাথার উপরে ছাদের কথা কিছুক্ষণের মধ্যে ভুলেই যান। প্রদর্শনীর আয়োজকদেরও হয়েছে খুব সুবিধা, দেয়াল না থাকায় তারা ইচ্ছামত প্রদর্শনী সাজাতে পারে।41ed8d50 99d3 4c45 949f 10dd05589c24

এই ভবনটিতে কা’ন তার নিস্তব্দতার প্রতীক পানি এনেছেন, কিন্তু একেবারে নিশ্চুপ নয়, পানিকে ধাপে ধাপে প্রবাহিত করে একটা কুলকুল ধ্বনির আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে। জায়গাটা একটা পার্কের মধ্যে। কোলাহল নেই বললেই চলে, সামনের দুটি ভল্ট খোলা, পোর্চের মত, তার উচ্চতা মনে করিয়ে দেবে দর্শককে যে তিনি একটি মহৎ কিছুর মধ্যে ঢুকছেন আবার এমন নয় যে তিনি এর বিশালত্বের কাছে হারিয়ে যাবেন।

কা’নের এই মিউজিয়ামটিকে খুবই সহজ সরল মনে হলেও, অনেক ঋদ্ধ ব্যক্তিত্ব একে তার অন্যতম মহৎ কির্তী বলেই চিহ্নিত করেছেন।

944839a5 2332 4d9c 8442 51af491b847e
Ef87b998 1093 46c1 A7f9 D1b3881d54ee

 

আপনার মতামত দিন

কমেন্ট

Logo
Logo
© 2024 Copyrights by Sthapattya o Nirman. All Rights Reserved. Developed by Deshi Inc.