ভারতবর্ষের মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশ গড়, উত্তর প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র প্রদেশ, বিহার এবং উড়িষ্যা, এই বিশাল এলাকা জুড়েই গোন্ড সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা ছড়িয়ে আছে। তারা সমগ্র ভারতে বিভিন্ন প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক স্রোতে নিজেদের বিলীন করে দেয়নি, স্বাতন্ত্র বজায় রাখতে চেয়েছে। সেজন্যই বৃটিশ আমলে তাদের একটা তপশিলি সম্প্রদায় হিসাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। গোন্ডরা নিজেদের 'কইতুর বা কই বলে', তাদের নিজস্ব কথ্য ভাষা আছে এবং এই ভাষাই তাদের নৃগোষ্ঠির পরিচয় বহন করে। অর্থাৎ বাঙালীদের মত তারাও ভাষা ভিত্তিক একটি জাতি, তবে সংখ্যায় কম, ২০০১ সালে অনুমিত জনসংখ্যা এক কোটি দশ লক্ষ। এদের ভাষার নাম গোন্ডি; তেলেগু ভাষার সাথে খুব মিল। এই জনগোষ্ঠির নাম 'গোন্ড' কেন বা কিভাবে হল, তার নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই, তবে প্রাচীন দ্রাবিড় ভাষায় পাহাড়কে বলা হয় 'কোন্ড'। মুঘল রাজদরবারের নথিপত্রে এদেরকে 'গোন্ড' জনগোষ্ঠি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তারা ওদেরকে পাহাড়ী সম্প্রদায় হিসাবে গন্য করে ওই নামে অভিহিত করেছেন। বিভিন্ন পাহাড়ি গোষ্ঠি দক্ষিণ ভারতীয় দ্রাবিড় ভাষা-সংস্কৃতির প্রভাবে একত্র হয়ে এই গোন্ডি ভাষার উৎপত্তি ঘটিয়েছে বলে ইতিহাসের গবেষকরা মনে করেন। ‘মুন্ডা’ নামে আরেকটি জনগোষ্ঠির সাথেও এদের সংশ্রব তারা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। |
ছবি: ভারতবর্ষের মানচিত্র |
ছবি: গোন্ড উপজাতি (ছবিসূত্র:Wordpress.com) |
মুঘলদের সময়ে গোন্ডরা গোন্ডয়ানা রাজ্যের অধিপতি ছিল, মধ্য প্রদেশের পূর্ব থেকে উড়িষ্যার পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই রাজ্য। তারা স্বাধীন ছিল, পরবর্তীকালে মুঘলদের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে করদ রাজ্যে পরিনত হয়। আনুমানিক ১২০০ খৃষ্টাব্দে তারা ‘চন্দ’ নামে প্রথম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে তবে এ চন্দ রাজাদের পূর্বসূরীদের ইতিহাস আরও পুরানো, নবম শতকেও তাদের কথা বিভিন্ন গবষেণাতথ্যে মিলেছে।
সাধারনত: আদিবাসীদের সংস্কৃতি এবং জীবন যাপন রাজকীয় নয়, অথচ এই গোন্ড সম্প্রদায় এক সময়ে গোন্ডয়ানা নামে বড় একটা রাজ্য শাসন করেছে, ভূপালে সেই ঐশ্বর্যপূর্ণকালের সাক্ষী হিসাবে আজও কিছু নমুনা দৃশ্যমান। ক্রমশ পতনের কালে গোন্ড রাজারা মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে মুসলমান হয়ে জায়গীর লাভ করেছিলেন। ১৭৪০ এর পর থেকে মারাঠাদের একের পর এক আক্রমনে তারা রাজ্যপাট গুটিয়ে পাহাড়ের জঙ্গলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যারা তখনও বনবাসী হয়নি তারা মারাঠা অধিকৃত করদাতা বাসিন্দা হয়ে ক্রমশ এক ক্ষয়িষ্ণু জনগোষ্ঠি হয়ে পড়ে। তাদের খালি জায়গা জমি মারাঠা দখলদাররা দ্রুতই পূরণ করে ফেলে। বৃটিশ শাসনামলে তাদেরকে চোর-ডাকাত শ্রেনীর অসভ্য মানুষ হিসাবে গণ্য করা হত।
ঔপনিবেশিক শাসনে বন সংরক্ষণ আইনের আওতায় গোন্ড এবং ওদের মত অন্যান্য বনবাসীদের বসবাস ও খাদ্য সংগ্রহে বিধি-নিষেধ আরোপিত হয়। ফলে ১৯১০ সালে আদিবাসী বিদ্রোহ শুরু হয়। |
ছবি: গোন্ড উপজাতির হারেলি উৎসব (ছবিসূত্র: People's Archive of Rural India) |
ছবি: গোন্ড উপজাতির মান্দ্রি নৃত্য (ছবিসূত্র: Rural Reporter) |
বৃটিশ সহযোগী রাজ্য হায়দ্রাবাদের নিজামের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গোন্ড নেতা কোসারাম ভীম। বিখ্যাত স্লোগান 'জাল, জঙ্গল, জমি'র অধিকার নিয়ে বিদ্রোহের এক পর্যায়ে বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতাকামী একটি জন-বিদ্রোহ হিসাবে দাঁড়িয়ে যায়। গোন্ড শিক্ষিত শ্রেনীর মানুষেরা ২০ শতকের প্রথম পর্বে গোন্ড মহাসভা গঠন করে তাদের সংস্কৃতিতে বহিরাগতদের প্রভাব বা সংমিশ্রণ ঠেকানোর উদ্যোগ নেয়, এর লেজ ধরেই গোন্ডদের রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে এবং স্বতন্ত্র রাজ্য দাবি করে, যদিও তাদের সে দাবি ব্রিটিশ বা পরবর্তীতে ভারত সরকারের কাছে খুব একটা পাত্তা না পেয়ে সময়ের সাথে সাথে শুকিয়ে গেছে। গোন্ডদের সমাজে নিজস্ব নিয়ম-কানুন আছে, নিজেদের আলাদা ধর্মাচারণ আছে, আচার অনুষ্ঠানও রয়েছে। কিন্তু সেগুলির ধরণ-ধারন আদিবাসী গোষ্ঠির মত, এক সময়ে ভারতের মধ্যাঞ্চলের তারা রাজা ছিল সেই ইতিহাসের ছাপ তাদের সমাজের বর্তমান আচার-অনুষ্ঠানে খুঁজে পাওয়া দুস্কর। |
ছবি: পুরাতন গোন্ড হাউস (ছবিসূত্র: স্বপ্নেশ সামাইয়া-এর 'গোন্ড চিত্রকথা') | গোন্ড সমাজ ছোট ছোট ইউনিট বা গোত্রে বিভক্ত হয়ে বসবাস করে, এই গোত্রগুলি পরস্পরের মধ্যে বৈবাহিক বিনিময় করে, নিজ গোত্রে জোড় বাধা চলে না। ছোট এলাকায় ভীড় করে অনেকগুলো গোত্র জড় না হয়ে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল গোন্ড গোত্রগুলি। এরা বিশ্বাস করে তাদের পূর্ব পুরুষেরা কোন এক কালে একত্রে একটি গোত্রেই বসবাস করত, সময়ের বিবর্তনে তারা আলাদা হয়ে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গেছে, তাদের কাছে এই গোত্র পরিচিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা তাদের পূর্বপুরুষের গ্রাম ও গোত্রপতিদের নাম ও প্রতীক মনে রাখে এবং এই 'সাগা' বা গোত্রগুলির আচার-অনুষ্ঠানে সেসব নাম, প্রতীক, সংখ্যা উচ্চারিত হয়। লিখিত ভাষা নেই তাই নিজেদের ইতিহাস ধরে রাখার জন্যই এই সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা। 'সাগা' কিন্তু কোন সামাজিক কাঠামো নয়, বরং এটা তাদের মধ্যে প্রচলিত প্রথাকে কি নিয়মকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন। যেমন তারা কোন গোত্রের সাথে বিয়ে করতে পারবে বা কোনটার সাথে পারবে না, সেটা এই সাগা পরিচিতি থেকেই বুঝতে পারে। |
ছবি: গোন্ড পেইন্টিং তৈরি |
গোন্ডদের সমাজে নিজস্ব নিয়ম-কানুন আছে, নিজেদের আলাদা ধর্মাচারণ আছে, আচার অনুষ্ঠানও রয়েছে। কিন্তু সেগুলির ধরণ-ধারন আদিবাসী গোষ্ঠীর মত, এক সময়ে ভারতের মধ্যাঞ্চলের তারা রাজা ছিল সেই ইতিহাসের ছাপ তাদের সমাজের বর্তমান আচার-অনুষ্ঠানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গোন্ডদের নিজেদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী, প্রকৃতিতে সকল কিছুই জীবন্ত, সকলেরই প্রাণ আছে। এই বৃক্ষ, নদী, পশু-পাখি, পাহাড়-পর্বত, আকাশ, মেঘ, চন্দ্র-সূর্য সব কিছুরই নিজস্ব সত্ত্বা রয়েছে, তাদের সাথে সহাবস্থানের শর্ত হল সকলকেই সমীহ করা, সঙ্গীত ও চিত্র রচনার মধ্য দিয়ে তারা এই সম্মান জানানোর প্রক্রিয়াটি ধরে রাখতে চায়। 'প্রকৃতি পূজা' আদিকাল থেকে সকল মানব গোষ্ঠির মধ্যে প্রচলিত থাকলেও সমাজ বিবর্তনের নানা পর্যায়ে সেগুলি লোপ পেয়ে নানা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম চালু হয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে এর অস্তিত্ব এখনও বর্তমান। আর্য ধর্ম স্থানীয় জনগোষ্ঠির মধ্যে প্রভাব বিস্তার করার জন্য স্থানীয় জনগনের মধ্যে প্রচলিত অনেক বিশ্বাস ও ধ্যান ধারনাকে আত্মস্থ করে বৃহদাকার ধর্মমত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বৃহত ধর্ম বিশ্বাসের চাপে পড়ে এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মত-পথ শুকিয়ে যায়, কিন্তু, গোন্ডরা তাদের ঐতিহ্যগত চিন্তা চেতনাকে যথা সম্ভব ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। |
ছবি: চিত্রশিল্পী ভাজ্জু শ্যাম_উড়ানের অলৌকিক ঘটনা (The Miracle of Flight) |
গোন্ডদের মধ্যে একটা প্রচলিত বিশ্বাস হল, 'একটা ভাল চিত্র সৌভাগ্য বয়ে আনতে পারে।' সেজন্য তারা তাদের বসবাসের গৃহটির দেয়াল, মেঝে এমনকি সিলিং পর্যন্ত নানা ধরণের চিত্রে ভরিয়ে রাখত। চিত্রকলার জন্য একটা সার্ফেস লাগে, সেটা সমতল না হলেও ক্ষতি নেই। আদিম মানুষ যে গুহায় থাকত তার পাথুরে অসমতল গায়ে ছবি আঁকত। আজকাল শিল্পীরা যেমন ক্যানভাস, কাগজ, কাপড়, চামড়া, কাঠ বা বোর্ড ব্যবহার করতে পারছেন তেমন সুযোগ সেকালে না থাকলেও মনের ভাব প্রকাশের আকাংখার কোন কমতি ছিলনা। পাহাড়ের কন্দরে পাথুরে দেয়ালে আঁকা ছবিগুলি হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে। গুহাবাসী থেকে বনবাসী এবং সমতল অঞ্চলে বসবাস শুরু করার মধ্যে দীর্ঘ সময়কাল যেমন অতিক্রান্ত হয়েছে সেইসাথে ছবির পটও বাস্তব কারণে পরিবর্তিত হয়েছে। বদলে গেছে ছবি আঁকার সরঞ্জাম এবং বিষয়বস্তু। ঘরের দেয়ালে, বেড়ায়, মেঝে, উঠোনে ছবি এঁকে পালা-পার্বণে বা পারিবারিক উৎসব উদযাপনের প্রথা এখনও চালু আছে। বেড়ার ঘর খুবই ক্ষণস্থায়ী, বছর বছর বদলাতে হয় এটা এক ধরণের সাময়িক ব্যবস্থা। চালের গুড়া, গাছের কসের মিশ্রনে যে রং তৈরী হয় তা বেড়ার উপর থাকেও না টিকেও না। সেজন্যই হয়তো কাগজ, ক্যানভাস এবং আধুনিক রঙের আবির্ভাবের সাথে সাথে নতুন মাধ্যমে আঁকার বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। |
ছবি: চিত্রশিল্পী ভাজ্জু শ্যাম |
ছবি: 'বানা' বাদ্যযন্ত্রের বাদক এবং গোন্ড পেইন্টিং-এ আঁকা বানা (ছবিসূত্র: স্বপ্নেশ সামাইয়া-এর 'গোন্ড চিত্রকথা')
গোন্ড গোত্রগুলির মধ্যে 'পরধান গোন্ডরা'ই এই চিত্রকলার চর্চা অব্যাহত রেখেছে। গোত্রের মধ্যে বিভিন্ন উৎসবকে উপলক্ষ করে এই চিত্র রচনা করা হয়, সে উৎসব হতে পারে বিয়ে, নবান্ন, জন্মোৎসব এমনকি বছরের কোন কোন বিশেষ দিন তারা খুব নাচ-গান করে। গোন্ডদের একটি বিশেষ বাদ্যযন্ত্র আছে যাকে তারা বলে 'বানা'। এটি বাংলাদেশের সারিন্দার মত, ওদের সকল অনুষ্ঠানেই এর উপস্থিতি রয়েছে। |
সাপ চিত্রিত একটি শিল্পকর্ম (চিত্রশিল্পী জঙ্গর সিং শ্যাম) |
গোন্ডদের নিজস্ব ধর্মমত রয়েছে, তারা প্রকৃতি পূজারী অর্থাৎ তারা প্রকৃতির সকল কিছুরই প্রাণ আছে মনে করে, এই প্রাণময় পরিবেশে মানুষও একটি প্রাণী, সেজন্য সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান করাই তাদের ধর্মীয় শিক্ষা। তাদের ছবিতে এই সহাবস্থানের তাগিদ সবচেয়ে বেশী প্রকাশিত। সূর্য-চন্দ্র, পাহাড়-পর্বত, সাগর-নদী যেমন তাদের ছবিতে থাকে তেমনি নানা পশু-পাখী, গাছ- পালাও থাকে, এসব বিষয়বস্তু চিত্রিত করবার জন্য আধুনিক শিল্পীদের মত হাজার প্রকার রং বা আঁকার সরঞ্জাম তাদের ছিল না। কিন্তু বিষয়বস্তুর লক্ষণগুলো চিহ্নিত করতে তারা মোটেও পিছিয়ে ছিলেন না। প্রথমে চিত্রপটে ছোট ছোট ফোঁটা দিয়ে বিষয়বস্তুর আকারগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে পরে বিন্দুগুলো সংযোগ করে মোটা বা চিকন রেখা দিয়ে ছবি আঁকার ফলে রং দেবার সময়ে ক্রটির সম্ভাবনা কমে যায়। কিন্তু রেখা নির্ভর ছবি হওয়ায় সহজেই ছবিতে একধরণের গতিময়তা চলে আসে।
ছবি: হরিণ (চিত্রশিল্পী রাজেন্দ্র শ্যাম) |
গোন্ড চিত্রশিল্পী প্রথমে ছবির বিষয়বস্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সারিবদ্ধ ফোঁটা বা বিন্দু দিয়ে চিহ্নিত করে তারপর বিন্দুগুলি যোগ করে একটা পশু বা পাখী বা গাছ এঁকে ফেলে। সেই আকৃতিগুলোকে রং দিয়ে ভরাট করা হয়। বিষয়টি কিন্তু এতই সহজ নয়। কারণ এই নিয়মে ছবি আঁকা সময় সাপেক্ষ। গোন্ড সমাজে ঐতিহ্য মেনে ছবি তৈরী করার মধ্যে ছবির বিষয়বস্তু নির্বাচন, ছবির মধ্যে নানা আকৃতি মিলে একটি বিন্যাস, রঙের ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক উপাদান থেকে রং তৈরী করা বর্তমানের দৃষ্টিতে নিতান্তই অতিরিক্ত বলে মনে হতে পারে। |
ছবি: গোন্ড পেইন্টিং তৈরি |
ফিগারের সীমারেখা বা আউটলাইন কিন্তু ভরাট করার সময়ে ঢেকে দেয়া হয় না। আবার ছোট ছোট লাইন দিয়ে ফিগারের শরীরে নানা প্যাটার্ন তৈরী করা হয়। যেমন মাছের আঁশ, পাখীর পালক, পাতার শিরা-উপশিরা যথেষ্ট সূক্ষ্মভাবে আঁকা হয়। গোন্ড ছবি মাটির দেয়ালে আঁকা হত, ভারতবর্ষে মাটির দেয়াল সাধারনত গোবর-মাটি দিয়ে লেপা হয় মসৃনতা আনবার জন্য। ঐ দেয়ালের উপরেই ফোঁটা ও লাইন দিয়েই গোন্ড শিল্পীরা ছবি শুরু করতেন, ভারতের অনেক অঞ্চলে মাটির দেয়ালে ছবি আঁকার পূর্বে দেয়ালে উপযুক্ত রঙের পটভূমি তৈরী করা হয়। গোন্ড ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ছবির পটভূমি ফাঁকা থাকে অর্থাৎ কোন রঙে ভরাট করা হয় না। গোন্ড চিত্র শিল্পীরা ছবির মধ্যে অনেক সময়ে কিছুটা কৌতুক রসের আমদানী করেন, যেমন একটা হাঁসের ফিগারের পিছনে হয়ত আরও দুটি হাঁসের গলা বা মাথা, অথবা একটা গাছের শিকড়গুলোর মাথা সূঁচালো করতে গিয়ে অনেকগুলি মাছের মাথা আকঁলেন। একটি ফিগারের মধ্যে অন্য কোন ফিগারের এরকম সংযুক্তি শিল্পীর নিজস্ব চিন্তাপ্রসূত, কোন বাধাঁধরা নিয়ম নাই। একই পাখীর দুই অংশে দুই রঙের ডিটেইল মোটেও অন্যায় নয়। ধর্মীয় অনুশাসন না থাকায় বিষয়ের গুরুত্বেভেদেরও কোন নিয়ম নেই, ছবির বিন্যাসেও শিল্পীর সিদ্ধান্তই শেষ কথা। |
ছবি: ট্রি অফ লাইফ (নর্মদা প্রসাদ টেকম) |
|
ছবি: কানহা জাতীয় উদ্যানের উপজাতীয় যাদুঘর (ছবিসূত্র: স্বপ্নেশ সামাইয়া-এর 'গোন্ড চিত্রকথা') |
ভারতের অন্যান্য রেখা চিত্র নির্ভর লোকচিত্রের মতই গোন্ড ছবি দ্বিমাত্রিক বা সমতলে আঁকা, ত্রিমাত্রিকতার ভাব আনার কোন চেষ্টা নেই। রেখা মোটা বা সরু করা হয় গুরুত্বভেদে, সাম্নে-পিছনে বোঝানোর জন্য নয়। ভরাট করার জন্য রং, গাঢ় এবং হালকা করে নিকট বা দূরে বুঝানো হয় না।
বর্তমানে মাটির দেয়ালের বদলে পাঁকা দালানের দেয়াল, ক্যানভাস, কাগজ, চামড়ার উপরে গোন্ড ছবি আঁকা হচ্ছে, ফলে ছবি আঁকার সরঞ্জাম বদলে গেছে। |
ছবি: গোন্ড পেইন্টিং(মাংরু উইকে) |
ছবি: গোন্ড আর্ট পেন্সিল স্কেচ (ছবিসূত্র: স্বপ্নেশ সামাইয়া-এর 'গোন্ড চিত্রকথা') |
এই ফোঁটা এবং রেখা নির্ভর ছবি রচনার সাথে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ছবির খুব মিল। একদল নৃতাত্ত্বিক মনে করেন ঐ আদিবাসীদের সাথে ভারতের আদিবাসীদের বংশগত সম্পর্ক আছে। তবে ছবিতে আপাত মিল থাকলেও ভাবনার জগতে পার্থক্য আছে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা তাদের ভূপ্রকৃতি এবং পৌরানিক গল্প বা স্বপ্নের বর্ণনা করতে চান। একটা ফিগারের মধ্যে অনেক ছোট ছোট গল্প থাকে, সেগুলি শুধুমাত্র নকশা নয়, তাদের প্রতিকী অর্থ থাকে। এই প্রতিকী অর্থের বিষয়ে গোন্ডদের ছবি কিছুটা দার্শনিক মাত্রার। |
ছবি: দুর্গা বাই ব্যাম-এর আর্টওয়ার্ক |
প্রাচীন ভারতে যে 'পরমাণু তত্ত্ব' প্রচলিত ছিল (জগতের সকল কিছুই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরমাণুর সন্নিবেশ মাত্র), তারই প্রকাশ হয় বিন্দুর মাধ্যমে। এই পরমাণু নির্ভর মহাবিশ্বে তাই সকল বস্তুই একে অপরের সাথে সর্ম্পকতি, গোন্ড চিত্র নকশার সুক্ষ্মতা ঐ পরম সত্যকে অনুসন্ধান করে। প্রকৃতি থেকে আহরিত রং তেমন উজ্জ্বল হয় না, কিন্তু গোন্ডদের চিত্ররীতিতে রঙের ব্যবহারে স্বাধীনতা রয়েছে, ফলে যুগ পরিবর্তনের ফলে আধুনিক রং এবং রেখা আঁকবার জন্য কলম বা কম্পিউটারে ডিজাইন করে প্রিন্ট করে নিচ্ছেন। তবে সকলেই এই ব্যবসায়িক বুদ্ধি ব্যবহার করছেন তা ঠিক নয়, নামী-দামী শিল্পীরা গোন্ড চিত্রমালার মৌলিক বিষয়গুলি ঠিকই রক্ষা করছেন এবং প্রচার করে সফলও হয়েছেন। |
ছবি: চিত্রশিল্পী জঙ্গর সিং শ্যাম |
ছবি: চিত্রশিল্পী ভাজ্জু শ্যাম |
ছবি: ভারত ভবনের একটি ম্যুরাল |
গোন্ড চিত্রমালা শুধুমাত্র চিত্রই নয়, এক ধরনের চিত্রকথাও বটে। এই গোন্ডদের যেহেতু কোন লিখিত ভাষা নেই, তাই তারা চিত্রের মাধ্যমে নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নির্যাস প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দিতে চায়। লক্ষ্যনীয়, এদের ছবিতে প্রকৃতি ও তার সাথে নির্বিরোধ বসবাস দেখানো হয় কিন্তু তাদের সমাজের দৈনন্দিন বা গোন্ড জাতির সাথে অন্যান্য শক্তির বিভিন্ন সময়ে যে সংঘাত হয়েছে বা তারা কিভাবে এক সময়ে বনবাসী হয়ে পড়ল সেই ইতিহাস এই ছবির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রকৃতির নিয়মই তাই। ধ্বংস, জরা, মৃত্যু সবই থাকবে কিন্তু পোড়া মাঠে আবারও গাছ জন্মায়। এই জীবন উৎসবের বার্তাই তারা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে রেখে যেতে চায়, এই অনুভূতিই তাদের পাথেয়। |
ছবি: ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ট্রাইবাল ইউনিভার্সিটি |
ছবি: ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ট্রাইবাল ইউনভার্সিটির প্রবেশ পথের দেয়ালে পেইন্টিং (১) |
ছবি আঁকার সরঞ্জাম মাটির ঘরের দেয়ালে, মেঝেতে আঁকার জন্য তুলি ছিল থেতলানো বাঁশের আগা, আর রং হিসেবে প্রাকৃতিক উপাদান থেকে প্রাপ্ত রং। ১। কাঠকয়লা ২। সাদা মাটি ৩। গাছের রস ৪। সবুজ পাতা ৫। গোবর ৬। মুলতানি মাটি থেকে হলুদ রং ৭। স্থানীয় বালি ৮। গেরু/লাল মাটি থেকে বাদামী রং ৯। জবা ফুল থেকে লাল রং |
ছবি: ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ট্রাইবাল ইউনভার্সিটির প্রবেশ পথের দেয়ালে পেইন্টিং (২) |
ছবি: কলম দিয়ে গোন্ড পেইন্টিং-এর আউটলাইন আঁকা |
ছবি: গোন্ড পেইন্টিং-এ র্বতমানে ব্যবহৃত সরঞ্জাম |
ছবি: ম্যাজিসিয়েন্স দে লা টেরে প্রর্দশনীতে জঙ্গর শ্যাম-এর একটি ম্যুরাল |
ছবি: জঙ্গর সিং শ্যাম (ছবিসূত্র: Tribal Art India) |
বর্তমানে কয়েকজন বিখ্যাত গোন্ড শিল্পী: ১। জঙ্গর সিং শ্যাম, জন্ম-১৯৬২ সাল, ভূপাল, মধ্যপ্রদেশ, ভারত। ২। সুবাস বৈয়ম, মধ্যপ্রদেশ, রাজ্য হস্তশিল্প পুরষ্কার-২০০২ সাল। ৩।দূর্গাবাই বৈয়ম, চিলড্রেন বুক পুরস্কার-২০০৮ সাল। ৪। ভাজ্জু শ্যাম, পতনগড়, মধ্যপ্রদেশ, ভারত, পদ্মশ্রী পুরস্কার-২০১৮ সাল। ৫।নর্মদা প্রসাদ টেকাম, জন্ম-১৯৮৩ সাল, পতনগড়, মধ্যপ্রদেশ, ভারত। |