লোকজ চিত্রকলা : কলমকারি

স্থাপত্য ও নির্মাণ
শিল্পকলা
৯ নভেম্বর, ২০২৩
৮২০
লোকজ চিত্রকলা : কলমকারি

কলমকারি হল ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্যে উৎপাদিত এক ধরনের হাতে আঁকা সুতির টেক্সটাইল। ‘কলমকারি’ আন্তর্জাতিকভাবে স্থানীয় মৌলিক কারুশিল্প হিসাবে ২০০৩ সালে জি.আই (GI) স্বীকৃতি পেয়েছে।

স্থপতি কাজী আনিসউদ্দিন ইকবাল রাফু

প্রাচীন কাল থেকে অদ্যাবধি সকল প্রকার সৃষ্টিশীল মাধ্যমে ভারতবর্ষের মানুষের দক্ষতা সমগ্র বিশ্বকে চমৎকৃত করে চলেছে। নানা সংস্কৃতির জন্মভূমি এবং বিশ্বের নানা সভ্যতার কুশলতার মিশেলে সমৃদ্ধ এই বিশাল জনপদ। এখানে সভ্যতা গড়ে উঠেছে, আবার মহা শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলি কালের আবর্তে বিলীন হয়ে গেছে। কখনও বহি:শক্তির পায়ের নীচে দলিত হয়েছে, আবার দেশীয় শাসকের অধীনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়েছে। সহনীয় জলবায়ুর আকর্ষণে, কৃষিজীবী সাধারণ মানুষের সরল জীবন যাপনে মুগ্ধ হয়ে দখলদারী সৈন্যদল হাতিয়ার ফেলে দিয়ে এদেশেই স্থায়ী হয়েছে। একে অপরের চিন্তা-চেতনায় প্রভাবিত হয়েছে, নতুন ভাষা সৃষ্টি হয়েছে, নতুন ধর্মাচার চলে এসেছে, সমাজ-সংস্কৃতি বদলে গেছে। সৃষ্টিশীল শিল্প মাধ্যমগুলিতে পারস্পরিক লেনদেন খুব বেশী হয়। শিল্প এবং প্রযুক্তির কোন সীমানা থাকে না, ভাল কিছু সৃষ্টি হলেই সেটা অন্যত্র অনুকরন হয়ে যায়। ভাষার সংমিশ্রন ঘটে, সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই মেলবন্ধন গড়ে উঠে।

6a85b0fe 756a 4361 88a5 892d568f68fe

ছবি : ভারতবর্ষের মানচিত্র

ভারতবর্ষে নানা জাতি, নানা ভাষা, মানুষের আকৃতি-প্রকৃতিতেও পার্থক্য রয়েছে। এই বৈচিত্রের পাশাপাশি সহনশীলতা, একে অপরের প্রতি আগ্রহ ও সহযোগীতা, শিক্ষা, জীবনাচরনে ঐক্য রয়েছে। উৎসব, পালা-পার্বনেও অংশীদারিত্ব রয়েছে। বর্তমানে ভারতবর্ষ কয়েকটি দেশে বিভক্ত হলেও তারা বৃহত্তর সংস্কৃতির উত্তরাধকিারী। লোকজ শিল্পের আলোচনায় এর অঞ্চলভিত্তিক নানা শিল্পকলা যা শত শত বছর ধরে চলে আসছে, সেগুলি অবধারিতভাবেই চলে আসবে। বিভিন্ন ধারার শিল্পের-মিথষ্ক্রিয়ায় কালের যাত্রায় নতুন শিল্পের জন্ম হয়েছে। তাদের পার্থক্য বিষয় বস্তুতে, টেকনিকে, প্রেক্ষাপটের ভিন্নতায়, যেমনটি স্থানের, পরিবেশের, সমাজ বিন্যাসের ও মত-পথের।
বাংলাদেশের লোক-সংস্কৃতি বুঝতে হলে উৎসমূখে যেতে হবে, সেখানে সমগ্র ভারতবর্ষের সাথে আমাদের মিলিত ঐতিহ্যের খোজ নিতে হবে। লোক সংস্কৃতির শিকড় একটি নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ থাকবে এমন ভাবা যায় না। পাশাপাশি চালু থাকা বিভিন্ন কারুশিল্পের মধ্যে অহরহ মিল দেখতে পাই। লোকজ শিল্পের আলোচনায় ভারতবর্ষের অন্যান্য লোক শিল্পের পরিচয় তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। তবে এক্ষেত্রে তাদের রকমভেদ অজস্র এবং পার্থক্যও অনেক ক্ষেত্রে যৎসামান্য। সেজন্যই লোকশিল্পের একটি চিত্রশিল্প ধারাকে বেছে নিয়েছি, এবং লোকজ চিত্রশিল্পগুলির মধ্যে দক্ষিণ ভারতের প্রখ্যাত ‘কলমকারি’ ঘরানা নিয়ে এপর্যায়ে আলোচনা করব।
500025a9 712f 4d38 9cbe A24540298d8bB3bf70e8 Cdc5 4bfe A14a 8fa67ef5b914

 

সৃষ্টিশীল শিল্প যাকে আমরা আর্ট বলি, তার অন্তরে দুটি অতি প্রয়োজনীয় বার্তা রয়েছে, প্রথমত: সে সৌন্দর্যের বার্তাবহ অর্থাৎ দেখার ইন্দ্রিয়কে তৃপ্তি দেয়, অন্যাটি হল তাকে নতুন হতে হবে। অনুকরণ করলে বা নকল করলে চলবে না। একটা শাড়ীর পাড় খুব সুন্দর হতে পারে কিন্তু সেটা বারবার বহুদিন ধরে নকল করা হচ্ছে বলে সে মৌলিকত্বের মর্যাদা পেতে পারে না। সেজন্য এধরণের শিল্পকে কারুশিল্পের কাতারে ফেলা হয়। ব্যক্তিগত দক্ষতা, পরিশ্রম, সাধনা সবকিছুই আছে, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে কারুপন্য। রেখা নির্ভর চিত্রকলার একটি প্রাচীন ভিত্তি রয়েছে। গল্প বলার ছলে ছবি আঁকতে আয়োজন খুবই সামান্য রাখতে হয়, কাহিনী বুঝিয়ে দেয়াই উদ্দেশ্য, কালে কালে ছবি যখন গুরুত্ব পায় তখন আয়োজন বাড়লেও পুরোনো পদ্ধতিই বহাল থাকে। ভারতবর্ষে পৌরানিক কাহিনীগুলিকে নিয়ে যেমন রামায়ন-মহাভারতের মত মহাকাব্য রচিত হয়েছে, তেমনটি চিত্রের মাধ্যমেও ওসব কাহিনী প্রচারিত হয়েছে। এসব চিত্র প্রধানত রেখা নির্ভর, রেখার মাধ্যমেই চিত্ররচনা এবং গল্প বলা। রেখাচিত্র সৃষ্টির উপকরণ খুবই সাধারণ, কোন গাছের ডাল দিয়ে তৈরী কলম বা তুলি এবং বিভিন্ন প্রকার গাছের পাতার রস, কস, ফুল-ফল বা অন্যকোন প্রাকৃতিক উপাদান থেকে পাওয়া গাঢ় রং ইত্যাদি।

ভারতবর্ষের লোকজ চিত্রকলায় একটি সুখ্যাত নাম ‘কলমকারি’। দুটি ফার্সী শব্দ ‘কলম’ ও ‘কারি’ (কারিগরী অর্থে) যুক্ত হয়ে নামটি গঠিত হয়েছে। ফার্সী ভাষার উপস্থিতিই জানিয়ে দিচ্ছে এই চিত্রকলায় পারস্যের কিছু সম্পর্ক আছে। কলমের বিশেষ ভুমিকার বিষয়টি নাম থেকেই স্পষ্ট হয়। এই চিত্র মূলত ড্রইং, গাঢ় রেখায় ছবি এঁকে পরে রেখার ভিতরের অংশ রং দিয়ে ভরাট করা হয়। ড্রইং এর মাধ্যমেই শিল্পী তার ছবির সার্বিক পরিকল্পনা করে নেন, তারপর রং বৈচিত্রে শুধুমাত্র ফুটিয়ে তোলা।

কলমকারি চিত্রের দুটি প্রধান ধারা রয়েছে, ‘শ্রীকলাহস্তি’ ও ‘মসুলিপট্টম’, ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ এবং তেলেঙ্গানায় এই দুটি ঘরানার ছবি তৈরীর কর্মকান্ড চালু রয়েছে।

0bf74589 B957 44f7 9b53 64f74df15ad5

ছবি : কলমকারি পেইন্টিং তৈরিতে সাদা সুতি কাপড় ব্যবহার করা হয়।

E49593a7 2479 432b Be08 C33950593085

ছবি : অন্ধ্রপ্রদেশের জেলাসমূহ যেখানে কলমকারী চিত্রশিল্প করা হয়।

জানা যায় প্রায় পাঁচশত বছর আগে অন্ধ্র প্রদেশ এলাকায় কিছু লোক দল বেঁধে গ্রামে গ্রামে ধর্মের প্রচারের জন্য গান-বাজনা করে বেড়াত। তাঁদেরকে বলা হত ‘চিত্রকুট্টি’। এরা অনুষ্ঠানের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য মঞ্চের পিছনে বা মন্দিরের দেয়ালে তাদের পালা গানের বিষয়বস্তু নিয়ে ছবি টানানো শুরু করে। এই ধর্ম প্রচারক দলগুলি মন্দিরের কর্মকান্ডের সাথে জড়িত এবং তারা সাধারণ শ্রোতা-দর্শকের কাছে হিন্দু দেব-দেবীদের অপার্থিব ভাবমূর্তি গড়ে মন্দিরের কর্তা ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য এই চিত্রের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করলে এসব ধর্মের ছবির প্রচলন বেড়ে যায়। দেব-দেবীর কাহিনী নিয়ে ছবি, তাই ‘শ্রীকলা’ হাতে আঁকা ছবি হিসাবে ‘হস্তি’ কথাটা এসেছে। এই ছবির জনপ্রিয়তার কারনে এলাকার নামও ছবির ঘরানার নামে পরিচিতি পেয়েছে। ‘শ্রীকলাহাটি’ অন্ধ্র প্রদেশের চিত্তুর জেলার স্বর্ণমুখী নদীর পাড়ে একটি মন্দির শহর।

00f108b7 A163 420c B869 D6b644848c01

ছবি : উজ্জ্বল রঙের পেইন্ট কাপড়কে দেয় একটি অন্যরকম চেহারা

2ec84eb4 7aaf 41b6 9073 6cfc42b96095

ছবি : বাঁশি ও বিষ্ণু চক্র সহ ভগবান গণেশের চমৎকার ছবি 

এই শিল্পীরা কোন আর্ট স্কুলে শিক্ষা গ্রহন করেনি, পারিবারিক পরিবেশেই তাদের একাজে হাতে খড়ি হয়েছে। পরিবারের মধ্যে হিন্দু পুরানের কল্প-কাহিনীগুলো শুনতে শুনতে নিজেরাই ছবি কল্পনা করতে শুরু করেন। বড়রা কলম ধরা, আঁকার টেকনিক, রঙের ব্যবহার ইত্যাদি শিখিয়ে দেন। সেই দক্ষতার উপর নির্ভর করে নিজের মনমত একটা চিত্র রচনা করেন। সেজন্য একটি ছবি অন্যটির চেয়ে কিছুটা আলাদা হয়, টেকনিক এক রকম কিন্তু বিষয়ের বিন্যাস ভিন্ন। সাজ সজ্জা ভিন্ন। শ্রীকলাহস্তি ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য তার রেখাচিত্র। বক্ররেখায় প্রথমে মূল ফিগারগুলি আঁকা হয় তারপর চিকন রেখায় অলংকার। ভারত শিল্পের আনুপাতিক হিসাব নিকাশ এখানে বদলে গেলেও মনে হয় বিষয়ভেদে কিছু প্রমিত বা প্রচলিত নিয়ম তারা অনুসরণ করেন। ছবির চরিত্রগুলির সবারই মুখ গোল, বড় বড় চোখ, মোটা ঠোঁট। ধনুকের মত চোখের ভূরু আবার চোখের ভিতরেও একটি অতিরিক্ত রেখা। নারী-পুরুষ সকলের গায়ে অলংকার তাদের কাপড়েও কারুকাজের কমতি নেই। ছবির অন্যান্য আয়োজনে ফুলের উপস্থিতি অনেক বেশী, দক্ষিণ ভারতে দৈনন্দিন জীবনে মেয়েদের কাছে ফুল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, চিত্ররচনায় নারীর প্রাধান্য বোঝা যায়।

শ্রীকলাহস্তি কলমকারি: শ্রীকলাহস্তি কলমকারি ছবিতে কলমটি কিন্তু বিশেষ ধরণের, যদিও আজকাল ঐসব কলম ব্যবহার করার মানুষ কম। এই ছবিতে ড্রইং এর দুটি ধাপ আছে, প্রথমে ছবির মূল পরিকল্পনাটা করার জন্য তেঁতুল গাছের ডাল পুড়িয়ে কয়লা কাঠি (চারকোল) দিয়ে এঁকে নেওয়া হয়, তারপর আসল কলম দিয়ে ঐ লাইনগুলো ফাইনাল করা হয়। এই কলমটি সাধারণত; বাঁশের কঞ্চিকে একটা প্রান্ত প্রয়োজন মত চেঁছে সূচালো করে কলম ধরার জায়গায় কাপড়/তুলা/ব্যান্ডেজ পেঁচানো হয়। এরপর সুতা দিয়ে ঐ ফোলানো জায়গাটি পেঁচিয়ে শক্ত করে কাঠিটির সাথে আটকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এখন এই ফোলা অংশটি রঙে ভেজালে ঝরনা কলমের মত সরু প্রান্তে রং চলে আসে। কলমের মাথা সরু হবে না মোটা হবে সেটা নির্ধারিত হয় রেখার চাহিদার উপর। গাঢ় কাল রেখা আঁকতে হরীতকী ভেজানো রস এবং লোহার মরিচা ধরানো পানির মিশ্রন ব্যবহার করা হয়। কাপড়ের উপরে এই দাগ শুকিয়ে গেলে আর উঠবেনা। রেখার ভিতরের অংশ ভরাট করার জন্য কিছুটা মোটা কলম বা বাঁশের মাথা থেতলানো তুলি ব্যবহার করা হয়। আজকাল কিন্তু কলমকারি করার জন্য দোকানে বিশেষ ধরণের কলমই পাওয়া যায়। আর রং ভরাটের জন্য নানা রকম তুলি’ত আছেই।

A018deed 14aa 40a3 A135 8dd91a20ce4e

ছবি : ডিজাইন শীটের কাপড়ের উপর আঁকা মোটিফকে রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহার করা হয়

605dd816 Dc75 4484 992d 806ed8c5d8b3

ছবি : বিভিন্ন ধরনের কলম তৈরি করা হয় রঙ করার জন্য

3e606dbd 720e 4615 B2ff Eaf2d1560e93

ছবি : বাঁশের খাগড়া এবং সুতির কাপড় দিয়ে তৈরি ব্রাশ

শ্রীকলাহস্তি চিত্রকর পূরাকাহিনী থেকে ছবির বিষয় সংগ্রহ করেন এবং বিষয়বস্তুর প্রমিত আকৃতি বজায় রেখেও ছবির বিন্যাসে কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করেন, কিন্তু কৌশলটি যেহেতু অতি প্রাচীন তাই যারা নতুন দেখেন তাদের কাছে একই রকম মনে হয়। এই চিত্রধারার সাথে জড়িতরা সাধারণত কাজটিকে ধর্মাচরণের মত দেখেন, সেজন্য একই পরিবার এই কাজ বংশানুক্রমে চালু রাখতে সক্ষম হচ্ছে। এধরণের মানসিকতা তাদের কাজে একাগ্রতা এনে দেয়, তার পরিচয় পাওয়া যায় যত্নের সাথে আঁকা রেখার নৈপুন্যে। এই চিত্রগুলিতে রেখার গতিশীলতা, দীর্ঘ প্রধান প্রধান রেখার সাথে ছোট ছোট সহযোগী রেখা দিয়ে ছবিটিকে অলংকৃত করার নিপুনতাই এই শিল্পের মান বিচারের প্রধান মাপকাঠি।

ছবির রেখার ভিতরের অংশটুকু রং দিয়ে ভরাট করা হয় অতি সতর্কতার সাথে, যেন রং লাইন অতিক্রম না করে। সেজন্য অদক্ষ কারও হাতে এই রঙের দায়িত্ব দেয়া হয়না। ছবির চরিত্রের রং কিন্তু নির্দিষ্ট, দেবতা পর্যায়ের জন্য নীল, দানব ও অসুরদের জন্য লাল বা সবুজ, নারীদের জন্য হলুদ। ফুল-পাখীর জন্য স্বাধীনতা ও পটভূমিতে লাল দেয়া হয়।

E41c4cf2 5ca0 4610 8373 A4c425159684

ছবি : সবুজ, লাল, নীল এবং হলুদ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রঙ

২৩ থেকে ৪০ ধাপে একটি শ্রীকলাহস্তি চিত্র তৈরী হয়, কয়েক মাস সময় লাগে। আদিতে সাদা সূতির উন্নত মানের কাপড় এই কাজের জন্য ব্যবহৃত হত। কিন্তু সিল্ক ও তসর সিল্কের উপরেও এটা করা যায়। গরুর গোবর ভাল করে গুলিয়ে সাদা কাপড়টি তার মধ্যে কয়েক ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়, এরপর ধুয়ে শুকাতে হবে। তারপর ননীযুক্ত দুধ বা ঘোলের মধ্যে ভজোতে হবে। পরদিন সেই কাপড় সিদ্ধ করতে হবে। এরপর স্রোতের পানিতে ধুতে হবে এবং শুকাতে হবে। এই ননী কাপড়টিকে ড্রইং এর উপযুক্ত মসৃণ করে ফেলে এবং কলম দিয়ে আঁকতে সুবিধা হয়। ড্রইং শেষ হলে শুকাতে হবে তারপর ধুতে হবে এবং শুকিয়ে রং ভরাট করা শুরু করতে হবে। কালমকারিতে প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করা হয়, সেজন্য রং কিছুটা ঝাপসা মনে হয়, কিন্তু এই রং চটুল নয় গভীর একটা আবহ থাকে। প্রতিটা রং আলাদা আলাদা করে আরোপ করতে হবে এবং শুকানোর পর অন্য রং দেয়া যাবে। সবকটি রং দেয়া হয়ে গেলে কাপড়টা সিদ্ধ করে, তারপর কয়েকদিন পানিতে ভিজিয়ে রেখে দিতে হবে, রংটা পচানোর বা গাজাঁনোর জন্য। এরপর কাপড়টা শেষ বারের মত ধুয়ে, রোদে শুকালে ছবির কাজ শেষ।

মসিলিপটনম কলমকারি: কলমকারির অন্য প্রসিদ্ধ একটি ঘরানার নাম হল মসিলিপটনম বা মসুলিপট্টম। অন্ধ্র প্রদেশের করমন্ডল উপকুলে কৃষ্ণা জেলায় মসুলিপট্টম একটি বন্দর শহর ছিল। এখন কৃষ্ণা জেলার প্রধান প্রশাসনিক দপ্তর। এখানে আরব, পারস্যের বণিকদের সওদাগোরি জাহাজ ভিড়ত। ১৬ শতক থেকে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের বসতি উঠতে শুরু করে, ১৭ শতকে এটি বৃটিশ, ওলন্দাজ ও ফরাসীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্য বন্দর ছিল।এই জেলার পেডানা অঞ্চলে গোলকুন্ডার মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠ-পোষকতায় মসুলিপট্টম ঘরানার ছবি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মুঘল রাজ দরবারেও সুখ্যাতি ছিল। দরবার কক্ষের শোভা বর্ধনের জন্য এই ছবি আঁকা কাপড় ঝুলানো হত।

Cbf412f7 Dd03 48e0 907a C995cc50be59

ছবি : অন্যান্য ছবির তুলনায় ঐতিহ্যবাহী মোটিফের পেইন্টিংয়ের চাহিদা বেশি

কলমকারি নাম হলেও এর রেখাচিত্র তৈরী হয় কাঠের ব্লকের ছাপ থেকে। অতি দক্ষতার সাথে কাঠ খোদাই করে ব্লক তৈরী করা হয় এতে হাতে আঁকার সময় বাঁচে। রেখার ভতেরের অংশ ভরাট করার জন্য বাঁশের কলম বা তুলি ব্যবহার করা হয়। তবে ভরাট করতেও অনেক সময় ব্লকের উপর ভরসা রাখা হয়। অতি সাবধানতার সাথে ব্লকের ছাপ পরপর দেয়া হয় যাতে রেখাগুলি ধারাবাহিক থাকে, কোনভাবেই বিচ্ছিন্ন না হয়।

মুসলিম দরবারে পর্দা বা ব্যাকড্রপ হিসাবে ব্যবহৃত হত বিধায় দেব-দেবীর ছবি নাই, পশু-পাখী, ফুল-লতা ইত্যাদি নিয়ে নানা আয়োজন। পারস্য ঘরানার ফুল-পাখী কিন্তু অত্যধিক রেখায় ভারাক্রান্ত থাকেনা, সে থেকেই ওগুলো চেনা যায়। মসুলিপট্টম ছবিতে অনেকে একসাথে কাজ করতে পারে, অনেক দীর্ঘ কাপড় বিছিয়ে অনেকগুলি একই প্যাটার্নের ব্লক দিয়ে ছাপ দিলেই হল। তবে রং ভরাট করাটা বেশ সাবধানতার সাথে করা হয়। প্রতিটি রং পৃথকভাবে প্রয়োগ করা, শুকানো এবং ধুয়ে ফেলা, এই কর্মচক্র বার বার চলে। রেখার ভিতরে রং ছাড়াও কাপড়ের জমিনকেও নানা রঙে রঞ্জিত করা যায়। শ্রীকলাহস্তি ও মসুলিপট্টম, দুটি পদ্ধতিতেই কাপড়ের প্রাথমিক প্রস্তুতি একই রকম, অর্থাৎ দুধে বা ঘোলে ভেজানো, কাপড় ধোয়া এবং শুকানো, তারপর তাতে রেখাচিত্র আঁকা বা ছাপ দেয়া। মসুলিপট্টমের রঙের বৈচিত্র্য বেশী, তবে কলমকারিতে প্রাকৃতিক রংই চলে। ফিটকিরি, লোহার মরিচা,হরীতকী, আখের বা বেদানার খোসা, মঞ্জিষ্ঠা উদ্ভিদের শিকড়, নীল, তালের গুড়, আইভি লতা ইত্যাদি উৎস থেকে এসব রং আহরণ করা হয়। এই ছবি-বস্ত্রগুলির চাহিদা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নত হওয়ায় একসময়ে ‘পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম’ হিসাবে গন্য হতে শুরু করে। সেজন্য এসব বস্ত্র টেকসই এবং ‘পাকা রঙের’ হওয়া জরুরী হয়ে পড়ে। বণিকেরা এই বস্ত্র যথেষ্ট সংখ্যায় সংগ্রহে রাখতে শুরু করেছিল। দূর দেশ থেকে আসা বণিকেরা স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা ছাড়াও অন্যান্য মহার্ঘ দ্রব্য বিনিময়ের জন্য স্থানীয় উৎপাদিত এই বস্ত্র ব্যবহারের কারন সম্ভবত এর চাহিদা। সম্পূর্ণভাবে হাতে তৈরী হওয়ায় এই কলমকারি বস্ত্র বাজারে সুলভ ছিলনা। যদিও আধুনিক অর্থ ব্যবস্থায় সেই প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।

1a219b82 D100 40fc A49d 7d0968c6bf44

ছবি : ব্লক প্রিন্টিং কলমকারি

‘কলমকারি’ আন্তর্জাতিকভাবে স্থানীয় মৌলিক কারুশিল্প হিসাবে ২০০৩ সালে জি.আই (GI) স্বীকৃতি পেয়েছে। এর ফলে স্থানীয় নিবেদিত প্রাণ কারুশিল্পিরা তাদের কাজের ভাল দাম পাচ্ছেন, সমাজে তাদের মর্যাদা দেয়া হচ্ছে।
639d3b77 9c80 42d2 807b 28de0eb3ca06
সহকারি সম্পাদনায় : স্থপতি ফাইজা ফাইরুজ 
নির্ণয় উপদেষ্টা লিমিটেড, পান্থপথ

আপনার মতামত দিন

কমেন্ট

Logo
Logo
© 2024 Copyrights by Sthapattya o Nirman. All Rights Reserved. Developed by Deshi Inc.