লোকজ চিত্রকলা: পটচিত্র

স্থাপত্য ও নির্মাণ
শিল্পকলা
৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪
৪৬
লোকজ চিত্রকলা: পটচিত্র

কাপড়ের ওপর ছবি আঁকা হলে সেই কাপড়কে ‘পট’ বলা হয়। শব্দটি সংস্কৃত ভাষার ‘পট’ থেকে এসেছে। এই কাজে সাধারণত তাঁতে বোনা মোটা কাপড় ব্যবহার করা হয়। বিশেষ পদ্ধতিতে তালপাতা দিয়েও এই ছবির পট তৈরী করা যায়।

অবিভক্ত ভারতবর্ষের বৃহৎ বঙ্গ ও উড়িষ্যায় পটচিত্রের চর্চা ছিল বেশী। ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে বহুকাল ধরেই নানা লোকজ চিত্ররীতি চর্চা ছিল, বিভিন্ন জনগোষ্ঠির মধ্যে প্রচলিত এসব শিল্পে মিল থাকাই স্বাভাবিক কিন্তু তাদের পার্থক্যও যথেষ্ট - বিষয়বস্তু, উদ্দেশ্য, শিল্পীকুল ও শৈলীতে তারা স্বকীয়। এই ভিন্নতা তাদের সমাজের প্রচলিত আচার-আচরণ, ধর্মীয় ধ্যান-ধারনা এবং সমাজের শ্রেনী বৈষম্যের মাত্রা নির্দেশক। 

 

2

লেখক কাজী আনিস উদ্দিন ইকবাল

 
 

Map Bangla

ছবি: ভারতবর্ষের ম্যাপ, যেখানে পটচিত্র চর্চা করার জায়গাগুলো পশ্চিমবঙ্গ হতে পূর্ববঙ্গে বিস্তৃত হয়েছে

 
 অবিভক্ত বঙ্গের পূর্ব-বঙ্গেই পটচিত্রের চর্চা বেশী ছিল। পৌরানিক গল্প, লোকগাঁথা, ধর্মাশ্রয়ী গল্প ইত্যাদি শোনানোর জন্য পটের গানের আসর বসত। পটগুলি একস্থান থেকে অন্যত্র নিয়ে যাবার জন্য গোল করে গুটিয়ে নেয়া হত। উড়িষ্যায় কাপড়ের বদলে তালপাতা জোড়া দিয়ে পট তৈরী করায় সেগুলি ভাজ করা সম্ভব হত। 
 

গনেশ ও জননী দূর্গা   যামিনী রায়ের ছবিতে পটচিত্র

ছবি: 'গনেশ ও জননী দূর্গা' - যামিনী রায়ের ছবিতে পটচিত্রের প্রভাব দৃশ্যমান

 
 

বাংলাদেশের ফসলের জমির উর্বরতার কারনে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ কয়েকটি সময়কাল ব্যতীত মোটামুটি সচ্ছলই ছিল। কৃষি নির্ভর সমাজে স্থানীয় নানা আধিভৌতিক বিশ্বাস জন্ম নেয় এবং সেগুলি প্রায়সই তাদের গল্পের আসরে বেশ সমাদৃত হয়। কখনও ভয়ের, কখনও শ্রদ্ধার, কখনও প্রেমের উপাখ্যান। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এদেশে ভিনদেশীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে, তারা সাথে করে নিয়ে এসেছে নিজেদের সামাজিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের নানা উপাদান। যেমন, এদেশে আর্যরা প্রবেশ করেছিল অনেক পরে অর্থাৎ উত্তর ভারতে রীতিমত স্থায়ী হবার পরে। ফলে স্থানীয় ধর্ম বিশ্বাসের সাথে নিজেদের মানিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া যথেষ্টই তখন এগিয়ে গেছে, এদেশে তাদের প্রবেশের সময়ে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের মানুষও এসেছিল, তারা বরং এদেশের মানুষের সাথে মেশার বদলে নিজেদের প্রভূ শ্রেনী হিসাবে পরিচিত করতে চেয়েছে। এদেশের নিরূপদ্রব সাধারণ মানুষ বরং ঔৎসুক্যের সাথে উচ্চ শ্রেনীর ধর্ম ব্যবস্থাকে লক্ষ্য করেছে এবং অপেক্ষাকৃত বেশী জাঁকজমকপূর্ণ পূজা আর্চনায় নিজেদের সমর্পণ করে ধন্য হতে চেয়েছে।

 
 

কিন্তু নিজেদের সংস্কৃতি সম্পূর্ণ বিসর্জন দেয়নি, গণমানুষের পর্যায়ে কিছু শিল্পচর্চা রাজ দরবারে পাত্তা না পেলেও কালের আবর্তে টিকে গেছে। এই নিম্নবর্গের শিল্প কলাকে জানতে হলে এই অঞ্চলের মানুষের সামাজিক বিন্যাসটা বুঝতে হবে।

ভৌগোলিক দিক থেকে এই অঞ্চল নদী প্রধান, প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, মাটি খুব উর্বর, কৃষি কাজের জন্য বেশ উপযোগী। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় জীবন-যাপনের আয়োজন খুব সামান্য। ঋতু নির্ভর কৃষিকাজের মাঝে যথেষ্ট অবসর সময়। তাই গান-বাজনা, পালা-পার্বণ, নানা ধরণের গ্রামীন খেলাধুলা এবং শিল্পকর্মের মধ্যে তারা সময় পার করত। গল্প করা বা আড্ডা দেওয়ার অনুকূল পরিস্থিতি। এই আড্ডার সূত্রেই বিভিন্ন পৌরানিক কাহিনী প্রচারিত হয়ে বিভিন্ন বিশ্বাসের ভিত গড়ে দিয়েছে। নানা আচার অনুষ্ঠানও তৈরী হয়েছে যেন সেগুলি পালন না করলে অকল্যাণ হবে। এভাবেই এ অঞ্চলে নানা স্থানীয় ছোট খাট পূজনীয় বিষয় চলে এসেছে, কখনও বড় বটগাছ, নদী-ঝর্ণা, কোন পশু-পাখী বা চন্দ্র-সূর্য বা আকাশ-বাতাস। শ্রদ্ধা জানাবার উপায়ই পূজা দেয়া, জ্ঞানী ব্যাক্তি বা প্রয়াত পুর্ব পুরুষও এই পূজার পাত্র হতেন। চলতে চলতে পূজার নিয়ম কানুনও তৈরী হয়, কিন্তু এদেশে এসব পূজা মন্দির ভিত্তিক ছিল না, অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা পায়নি। তাদের পূজার সাথে জড়িত কল্প-কাহিনীগুলো ছড়িয়ে পড়ত গল্পচ্ছলে, তবে বৃহত বঙ্গে মুখে বলা গল্পের সহযোগী হত গান। কালের বিবর্তনে এই গানের আসরগুলিতে গল্পকে আরও আকর্ষনীয় করার জন্য ছবি প্রদর্শন খুব কার্যকরী পন্থা হিসাবে দাঁড়িয়ে যায়।

Bengal Pottochitra (the Enchanting World of Pattachitra Art by Asma Khan) (2)ছবি: বেঙ্গল পটচিত্র (The Enchanting World of Pattachitra Art by Asma Khan)

Pater Ganছবি: পটুয়া সংগীত গাইছেন একজন পটুয়া

৬০ এর দশকেও এদেশে বায়োস্কোপ প্রদর্শনী চলত, শিশু-কিশোরদের জন্য খুবই আগ্রহের বিষয় ছিল। একটা বাক্সের মধ্যে কয়েকটি দেখার মুখ থাকত, ছেলেরা সেখানে চোখ রাখত আর ভিতরে একটা গোটানো স্ক্রিনে নানা ছবি থাকত। ছবিগুলো তাতে আঁকা বা ক্যালেন্ডারের আকর্ষনীয় চিত্রও হতে পারে। বায়োস্কোপওয়ালা সুর করে ছবির বর্ণনা দিত এবং একটার পর আরেকটা ছবি নিচে গুটিয়ে যেত, তখন গল্পেরও পর্ব বদলে যেত। পয়সার বিনিময়ে এই ছবির প্রদর্শনীকে পটচিত্রের নয়া আর্থ-সামাজিক একটি ধরন বলা যায়।

 

পটচিত্র মুলত পৌরানিক কাহিনীর চিত্ররূপ, অনেকগুলি ছবি একটি দীর্ঘ পটে আঁকা এবং সেই পটটি ভাঁজ অথবা গুটিয়ে রাখা হত।  পটচিত্রের প্রদর্শনীর জন্য সামান্য কিছু আয়োজন করতে হত। কথক বা গায়কের সাথে কোন কোন বাদ্যযন্ত্রও থাকত। এরা একটি ছোট দল, গানের মাধ্যমে যথেষ্ট লোক জমে গেলে তারা বাক্স খুলে গুটানো পট বের করে টাঙিয়ে দিত। তারপর চলত নাটকীয় বর্ণনা, কখনও কথা বলা, কখনও গান বা ছড়া, এমনকি নৃত্যও।

 

রাম-রাবনের যুদ্ধের নাটকীয় পরিবেশনায় রাম বা দশমাথাওয়ালা রাবনকে চেনাতে পটে আঁকা ছবিই সবচেয়ে কার্যকর। বেহুলার বাসর বা চাঁদ সওদাগরের শপথ সবই পটে রয়েছে। গল্পের ধারা বর্ণনার সাথে সাথে  এই কল্প-কাহিনীগুলোকে দর্শকদের সামনে মেলে ধরার মধ্য দিয়ে সেই কল্পজগতে ঘুরে বেড়ানোর এক মনোহরি আয়োজন।

 

পটচিত্রের আদি উৎস খুঁজতে গিয়ে গবেষকরা ২৫০০ বছর পূর্বেও এর অস্তিত্বের আভাস পেয়েছেন। গল্প বলার ছলে যে কোন বিষয়ে প্রচারণার জন্য খুবই উপযোগী মাধ্যম হিসাবে ধর্ম প্রচারকদের মহলে বিশেষ গুরুত্ব পায়। আর ভারতবর্ষে আসন পেতেছে এমন ধর্মের অভাব নাই। বৈদিক, জৈন, বৌদ্ধ, ইসলাম, খৃষ্টান, শিখ মতগুলির নিজেদের মধ্যে ধারা উপ-ধারা হিসাবে করলে গুনে শেষ করা যাবে না।

 

বৃহত বঙ্গেরও নিজস্ব অনেক দেব-দেবী, পৌরানিক গল্প-গাঁথাও রয়েছে, লোকজ গল্পগুলি ওসব বড় বড় স্রোতের মধ্যেও নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। 

 

বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের স্পষ্ট স্বকীয়তার কারনে সকল ধর্মের রীতিনীতি কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে এবং অন্যান্য মতবাদের সাথে জারিত হয়ে নতুন পথও তৈরী হয়েছে। সেজন্য ইতিহাসের  কোন কোন পর্যায়ে এসব মতের প্রচারে এক ধরণের প্রতিযোগিতাও গড়ে উঠেছিল। তেমন পরিবেশে পটচিত্রের কদরও বেড়েছে।

 

Exploring the Significance of Pattachitra Art in Jagannath Ratha Yatraছবি: উড়িষ্যাার পটচিত্র

অন্ধ্রপ্রদেশের পটচিত্রছবি: অন্ধ্রপ্রদেশের পটচিত্র

 

Raghurajpurছবি: রঘুরাজপুর গ্রামের একজন পটুয়া ছবিসূত্র: housenama.com

When the Gods Rest…ছবি: পটচিত্রে রঙ বসানো হচ্ছে

 
 

পটচিত্র যেমন বায়োস্কোপের পূর্বসূরি তেমনি অনেকে গল্পের ধারাবাহিক উপস্থাপনার সূত্রে একে বর্তমান কালের কমিক ছবি-গল্পেরও আদি সংস্করণ মনে করেন। এই পটচিত্রই ছিল শিক্ষা, সামাজিক রীতিনীতি ও সভ্যতা প্রচারের মাধ্যম। ফলে পটচিত্রের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় এদেশে লোকজ চিত্রকলার পরম্পরা বুঝা যায়। যারা পটচিত্র আঁকেন তাদেরকে বলা হয় পটুয়া। 

পটুয়ারা পরিবার ভিত্তিক পেশার অনুসারী, অর্থাৎ বংশানুক্রমে তারা এই কাজ করে এসেছে। পটুয়ারা শুধুমাত্র চিত্রকর নয়, তারা ছবির প্রদর্শনের সাথে গানও গাইতেন, এবং সেই গানগুলি পটুয়া সঙ্গীত। বাংলাদেশে পটুয়া সম্প্রদায় মূলত মুসলমান। মুসলমানদের ধর্মাচরণে প্রতিকৃতি আঁকা বা গান-বাজনা করাতে উৎসাহ দেয়া হয় না, তাহলে পটুয়াদের এরকম বিপরীত আচরণ কেন?

 

বৃহদ্ধর্ম পুরানে বর্ণিত এক আখ্যানে বিশ্ব স্থপতি বিশ্বকর্মা নীচুজাতের এক রমনীর সাথে মিলিত হবার ফলে নয় সন্তানের জন্ম লাভের গল্প পাওয়া যায়, মাতা নিম্ন শ্রেনীর হওয়ায় ঐ সন্তানদের নিয়তি নির্ধারিত হয় তাদের কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। পটচিত্রের দায়ত্বি পড়ে সবচেয়ে ছোট ছেলের উপর, অর্থাৎ এই পেশা কুলীনদের কাছে গ্রহনযোগ্য নয়। ছবি এঁকে গান গেয়ে জনসাধারণের মনোরঞ্জন করতে পারলে সামান্য যা কিছু জুটত তা দিয়েই তাদের সংসার চলত। বর্ণবাদী সমাজে পেশা পরিবর্তন করার উপায় নাই।

 

মুসলমান শাসনামলে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠি এই সামাজিক অবহেলা এবং উচুঁ জাতের অত্যাচার এড়ানোর জন্য মুসলমান হয়ে যায়। মুসলমানরা রাজ্য জয় করেছিল ঠিকই কিন্তু নতুন কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দিয়ে সমাজকে বদলে দেয়নি। ফলে এরা তাদের পুরানো পেশায় রয়ে গেছে, মুসলমান হিসাবে তাদের নাম পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু দৈনন্দিন জীবন যাপনে হিন্দুদের সামাজিকতা বজায় রয়েছে। তবে এবার তাদের মধ্যে কেউ চাইলে পেশা পরিবর্তন করতে পারত, এবং ছবির গল্পের মধ্যেও মুসলমান পীর-আউলিয়াদের নিয়ে প্রচলিত কল্প কাহিনীগুলো গ্রহন করতেও আর বাধা ছিল না। মুসলমান সমাজে পটচিত্রের উৎসাহী পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না, গ্রামীন উৎসব ও পার্বনে পটের প্রদর্শনী ও গান হত এবং তার দর্শক শ্রোতা শুধু কোন নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী থাকত এমন নয়।

পটচিত্র এবং পটের গান বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারক X Bfa X Fxyz 19
 

Santhal Pattachitra (the Enchanting World of Pattachitra Art by Asma Khan) (2)ছবি: সাঁওতালদের পটচিত্র (The Enchanting World of Pattachitra Art by Asma Khan)

 
 

একটি পটচিত্র তৈরী করতে যে সময় ও পরিশ্রম দরকার তার অর্থমূল্য এ অঞ্চলের গ্রামীন মানুষেরা দিতে পারত না বিধায় পটচিত্র বিক্রয়যোগ্য পণ্য ছিল না। পয়সার বিনিময়ে নাটক বা গানের অনুষ্ঠানের মত দানের বিনিময়ে চলতো এর প্রদর্শন। সাধারণ মানুষের ধর্মীয় আবেগ ও চিত্ত বিনোদনকে সম্বল করে রচিত পটচিত্রের সঙ্গে পটুয়া সংগীতও পরিবেশতি হত, পটে যা আঁকা আছে গানের বাণীতেও তা থাকত। অনেকটা পাঁচালির ঢঙে গাওয়া হত।

এই ছবি যারা আঁকেন তাদের বংশ পরিচয় ‘চিত্রকর’ যদিও তাদের পটুয়া, পটিদার ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়।

 
 

পটচিত্রের প্রকারভেদ

ব্যবহারিক দিক থেকে তিন প্রকার পট বেশী প্রচলিত:

 

১. জড়ানো পট: এই পটগুলি ২-৩ ফুট চওড়া এবং ২৫-৩০ ফুট দীর্ঘ হয়। দীর্ঘ পটচিত্র গুটিয়ে রাখা হয় তাই নাম জড়ানো পট, উপরে-নীচে বা আনুভূমিক  যে রকমই হোক না কেন তার সাথে বিষয়বস্তুর আলাদা সম্পর্ক নেই। এক একটা পটে ২০টির বেশী ফ্রেম থাকে, ফ্রেমগুলির কাহিনী ধারাবাহিকতা বজায় রাখে, এক ফ্রেমের গল্প বলা হয়ে গেলে পরের ফ্রেম খোলা হয়।

 

২. ভাঁজ পট: এই পট সাধারণত তালপাতার সেলাই করা পট, ভাঁজ করে রাখা যায়। তালপাতার শিরাগুলি বাদ দিয়ে পাতলা পাতার অংশটি শুকিয়ে তারপর সেলাই করে জোড়া লাগিয়ে এই পটগুলি তৈরী করা হয়। তালপাতার উপর ছবি আঁকার জন্য ড্রইং করার সময়ে একটু চাপ দিয়ে দাগ ফেলে দেয়া হয়, যা আউট লাইন হিসাবে থেকে যায়। তালপাতার উপরে আঁকার জন্য রঙের উপাদানও কিছুটা ভিন্ন হয়। উড়িষ্যার পুরী, ভুবনেশ্বর ইত্যাদি অঞ্চলে এর চর্চা বেশী হয়েছে, এই মাধ্যমে ধর্মীয় আখ্যান বেশী চিত্রিত হয়েছে।

 

৩. চৌকা পট: আকারে ছোট। এগুলি ব্যক্তিগত সংগ্রহের উপযোগী। ধারাবাহিক গল্প বলার চেয়ে আলাদা আলাদা বিষয় বা কোন বিশেষ দেবতার প্রতি নিবেদনের অনুষঙ্গ।

 

এছাড়াও বাংলা অঞ্চলে জনপ্রিয় দূর্গাপুজার প্রতিমার পিছনে পটচিত্রের স্টাইলে গল্প ছবি আঁকা হয়। এই ছবিগুলির আকৃতি হয় পটভুমিতে কিভাবে সেটা রাখা হবে তার উপর। সাধারণ আকৃতির বাইরে কখনও বৃত্তাকার কখনও বা অর্ধ বৃত্তাকার হতে পারে। এই ছবিগুলোকে চালচিত্র বলা হয়।

Chitropot1ছবি:  জড়ানো পট (ছবিসূত্র: নীলাঞ্জন বসু)

Palm Leaf Potta Chitraছবি: ভাঁজ পট (ছবিসূত্র: zolaindia)

Pattachitra Craftsman Pooranchandra

ছবি: চৌকো পট (ছবিসূত্র: gaatha.com)

1633527105 3aছবি:'দশাবতার' এবং 'অষ্টসখী'-এর চালচিত্র (ছবিসূত্র: my KOLKATA)

1633527389 5ছবি: চালচিত্র, আর্টিস্ট - রেবা পাল (ছবিসূত্র: my KOLKATA)

 

আবার বিষয় বিবেচনায় পটের নানা গোত্র থাকে, যেমন যমপট, গাজীপট, সত্যপীরের পট, পাবুজী পট, হিন্দু প্রাণ পট, কালিঘাট পট, সাহেব পট, চকসূদন পট। এছাড়াও গ্রামাঞ্চলে সামাজিক সচেতনা বৃদ্ধির জন্য, বিভিন্ন সংক্রামক রোগ বা অপরাধ প্রতিরোধের জন্য পট এঁকে প্রচার চালানো হয়। টিকাদান ও বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির মত ব্যাপক সামাজিক প্রচারের জন্য পটের আঙিকে এখন নানা পোস্টার ব্যানার তৈরী করা হয়। পটের গল্পভেদেও তাদের চিহ্নিত করা যায়, যেমন বেহুলা-লক্ষিন্দর, রাধা-কৃষ্ণ, চৈতন্যলীলা, সীতার বনবাস, গাজী পীরের আখ্যান। 

নাম থেকেই বুঝা যায় পটের বিষয় কি। গল্প এক হলেও পটচিত্র এই রকম হবে তেমন নয়। বরং ছবির আয়োজন (Composition) এবং অলংকরণ আলাদা করাটা চিত্রকরের নিজস্বতার চিহ্ন। ধর্ম ভিত্তিক পৌরানিক কাহিনীগুলো এদেশের পটে অনেকটাই সহজ সরলভাবে প্রকাশিত, ধারাবর্ণনার শ্রোতাদের চিন্তা চেতনার স্তরই এই সহজিয়া পরিবেশনার মূল কারণ। দেবতাদের আচার ব্যবহার অনেকটা মানুষের মতই, তারা অবতার রূপে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর রূপ গ্রহন করতে পারেন, পটচিত্রে দেবতারা তাই মানুষের আদলেই চিত্রিত, হয়ত সামান্য দুএকটা অলংকার বা চিহ্ন দিয়ে আলাদা করা হয়। সাঁওতালদের জন্য মরা-হাজা, পিচলু বুড়ি বা বাংলার সাধারণ মানুষের জন্য পীরপট আঁকা হত। পীরের অলৌকিক কির্তী, যেমন বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে ভ্রমন, বনের পশুরা তার নির্দেশ পালন করার গল্প নিয়ে চিত্রকথা।
 
 

3 Pottochitrasছবি: কালীঘাট পটচিত্র, পশ্চিমবঙ্গের দূর্গা পটচিত্র, মাখন চোর কৃষ্ণা-তসর সিল্ক কাপড়ের ওপর পেইন্টিং

 

Gajir Potছবি: গাজীর পট (ছবিসূত্র: বাংলাদেশের গাজীর পটচিত্র, রিফাত আহমেদ)

গাজী পটে মূলত গাজী-কালু-চম্পাবতীর লোককাহিনী চিত্রিত হত। এই ছবিতে গাজী পীরের নানা জমাট গল্প, যেমন, তিনি লড়াই করছেন সুন্দরবনের রাজার সাথে, কখনও বাঘের পিঠে বসে আছেন হাতে তলোয়ার। এই ধরণের পটে গাজী ছাড়াও মানিক পীর, মাদার পীর, সত্যপীর, কালু ফকির, বনবিবি ইত্যাদি চরিত্রগুলিও নানা ভাবে, নানা ভঙ্গীতে ও গল্পের অংশ হিসাবে উপস্থিত থেকেছেন।

যম, যাদু ও চক্ষুদান, রাশি পট ইত্যাদি সমকালীন সমাজের অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাসের পরিচায়ক। এরমধ্যে চক্ষুদান পট বিশেষ কৌতুহলের বিষয়, পটুয়ারা মৃত ব্যক্তির চোখটি বাদ দিয়ে ছবি একে তার নিকটজনের কাছে অর্থ দাবী করত, চোখ না আঁকলে মৃত্যুপুরীতে তিনি পথ খুজেঁ পাবেন না, তাই আবেগ তাড়িত মানুষ অর্থের বিনিময়ে চিত্রকরের এই ভেল্কিবাজি থেকে মুক্তির পথ খুজত।

বারো থেকে উনিশ শতক অবধি বাংলার পটুয়ারা এই চিত্র রচনায় খুব সক্রিয় ছিলেন। নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, যশোর, বীরভূম, বাঁকুড়া, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, হুগলী, মেদিনীপুরে প্রধানত; এই পটচিত্রকররা বাস করতেন। অন্যন্য আকর্ষনীয় কাজের সুযোগ এবং সামাজিক বাধ্যবাধকতা শিথিল হবার সাথে সাথে এরা এই পেশা ক্রমশ ত্যাগ করছেন।

চৌকা পট প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, এর একটি ধরণ বৃটিশ আমলে কোলকাতায় খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাকে ‘কালিঘাটের পট’ হিসাবে আলাদা করা হয়, এই বিশেষ পটচিত্র নিয়ে কিছুটা আলাদা আলোচনা করতে চাই, সেই অংশটি এই লেখার লেজুড় হিসাবে পরবর্তীকালে প্রকাশ করার ইচ্ছা রইল।

Preservation of Cultural Heritage

The Significance of Pattachitra Art in the Jagannath Ratha Yatra Festival

ছবি: ভারতের 'পুরী'তে 'জগন্নাথ রাথা ইয়াত্রা' উৎসব (Exploring the significance of pattachitra art in Jagannath Ratha Yatra)

Pattachitra Processছবি: ছবি আঁকার কৌশল (ছবিসূত্র: gaatha.com)

তৈরি হচ্ছে পটচিত্র।ছবি: তৈরি হচ্ছে পটচিত্র (ছবিসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা)

ছবি আঁকার কৌশল

পটচিত্র আঁকার প্রথম ধাপ পট তৈরী করা। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই পটের কৌশলে অনেক পরিবর্তন এসেছে। প্রাচীন কালে ব্যবহৃত নরম কাপড়, গোবর, কাদা ও তেতুল বিচির গুড়া দিয়ে তৈরী আঠার সাহায্যে কয়েক প্রস্থ জোড়া দিয়ে জমিন তৈরী করা হত, পরে বিশেষভাবে তৈরী মাড় দিয়ে অথবা হাতে বানানো কাগজের পিছনে কাপড় সেঁটে দিয়ে পট তৈরীর চল এসেছে। দীর্ঘ পটগুলি গুটিয়ে রাখার সুবিধা থাকতে হবে, তাই পটগুলি যেন খুব শক্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হত।

 

পটুয়াদের ছবি আঁকায় কয়েকটি ধাপ রয়েছে, প্রথমে পটের সীমানা তৈরী করা হয়। তারপর ছবি স্কেচ করা, ফিগার আঁকলে প্রথমে মাথা একে তারপর দেহ এবং শেষে পা আঁকা হয়। স্কেচের কাজটি পরিবারের মধ্যে অভিজ্ঞ ও দক্ষ একজন করেন। তৃতীয় ধাপে ফিগারের বাইরের অংশটুকু লাল বা অন্য কোন রঙে ভরাট করে পটভূমি তৈরী করা হয়। এরপর ফিগারের গায়ের এবং পোশাকে রং দেয়া। পটচিত্রে অলংকরণের আতিশয্য নেই।

 দীর্ঘ পটগুলি কতগুলি ফ্রেমে ভাগ করে তার উপর লাল, নীল, হলুদ, গোলাপী, সাদা, কালো রং লাগিয়ে পটভূমি তৈরী করা হয়। তার উপর রেখার সাহায্যে বিষয়ের অবয়বগুলো এঁকে নিয়ে পরে গল্পের  উপযোগী রঙে ছবি ভরাট করা হত। রেখা কিন্তু ঢেকে দেয়া হয়না। প্রাথমিক রেখা আঁকার জন্য পেন্সিল ব্যবহার হত না, তবে কয়লা, তুলি, সুতা ইত্যাদির ব্যবহার ছিল। ছবির কম্পোজিশনে বিশেষ কোন রীতি নেই, চিত্রকরের স্বাধীনতা রয়েছে, তবে ছবির গল্পের মূল চরিত্র যথেষ্ট প্রাধান্য পায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডিটেইলে জর্জরিত না করে সরাসরি উপস্থাপনা। ভারতবর্ষের অন্যান্য লোকজ চিত্রকলায় ত্রিমাত্রিকতার কৌশলটি তেমন দেখা যায় না, এক্ষেত্রেও তেমনি ছবির বিন্যাসে স্পেস রাখা বা ত্রিমাত্রিক কৌশল যেমন কাছে-দূরে বা ফোরশর্টেনিং অনুপস্থিত। পটচিত্রে ফিগারের ভঙিমা প্রকাশে গতিমত রেখা যতটা গুরুত্ব পায় মুখের অভিব্যক্তি সেই তুলনায় খুব সাদামাটা। ভারতের শিল্প ও চিত্রাঙ্কনের শাস্ত্রীয় ব্যাকরণ এই নিম্নবর্গের চিত্রমালায় অনুপস্থিত হলেও ছবি যথেষ্ট বাঙময় এবং উদ্দেশ্য সফল।   
 

Untitled 4ছবি: পাম গাছের পাতায় ছবি আঁকার কৌশল (ছবিসূত্র: Irakoi)

 

ছবির সরঞ্জাম

আগেই পট তৈরীর পদ্ধতি নিয়ে কিছু ধারণা দিয়েছি, তবে স্থানীয় প্রভাব অর্থাৎ প্রয়োজনীয় উপাদানের সহজলভ্যতাও একটা বিষয়। রং বানাতে ঝিনুক বা শঙ্খের গুড়া, সাদা মাটি, গেরু মাটি, তেতুল বিচির গুড়া, হলুদ, হলুদ পাথরের গুড়া, নীল, সিঁদুর বা আলতা এমনকি গোবর পর্যন্ত ব্যবহৃত হত। পরবর্তীকালে নানা কেমিকেল রং ক্রমশ সেই জটিল পদ্ধতির অবসান ঘটিয়েছে। তুলি হিসাবে পাখরি পালক, কাঠির মাথায় পশুর লোম লাগিয়ে বানানো তুলি বা বাঁশের কঞ্চির মাথা থেৎলে নরম করে বানানো এক রকম তুলি দিয়েই চিত্রকররা কাজ করতেন।

Pattachitra Brushছবি: ছবি আঁকার সরঞ্জাম (ছবিসূত্র: gaatha.com)

ছবি আঁকা একটি পারিবারিক কাজ, তাই নারী-পুরুষ সকলেই অংশগ্রহন করে, একাজ শুরু বা শেষ করার সময়ে বিশেষ কোন ধর্মীয় আচার পালন করার প্রথা থাকার কোন তথ্য নেই। তবে চিত্রকর গল্পছবির চরিত্রগুলোর পরিচয় তুলে ধরবার জন্য নিদর্শন এঁকে বুঝিয়ে দেন, এই হল শ্রীকৃষ্ণ বা এই হল রাবন। পটুয়ারা এই ছবি আঁকার মাধ্যমে কোন ধর্মচর্চা করে না, তাই তাদের কাছে দর্শক-শ্রোতার চাহিদা মুখ্য।

বর্তমান কাল

আদি পটচিত্রের সামাজিক চাহিদা এখন আর নেই, সেই স্থান দখল করেছে কমিক বই বা এনিমেশন সিনেমা। তবে পোস্টার, ফেস্টুনের মত ছবি নির্ভর প্রচার উপাদান দেখা গেলেও সেগুলো কোন হিসাবেই পটচিত্রের সাথে তুলনীয় নয়। পটের আঁকার ধরনটি বরং পট ছেড়ে বিভিন্ন হস্ত শিল্পের গায়ে আঁকা হয়, গৃহসজ্জার জন্য পর্দা বা কোন প্যানেলে ওই মোটিফ ব্যবহৃত হয়। পটচিত্র এখন মিউজিয়ামে থাকে, আর গাজীর গান কবে শুনেছি মনে নাই।

Patta Chitra Work at Odishaছবি: বর্তমানে বিভিন্ন মাধ্যমে পটচিত্রের রুপান্তর দেখা যায়


 

Your Image

আপনার মতামত দিন

কমেন্ট

Logo
Logo
© 2025 Copyrights by Sthapattya o Nirman. All Rights Reserved. Developed by Deshi Inc.