এলাকা পরিকল্পনা- পরিবর্তন অথবা তৈরী করা

স্থাপত্য ও নির্মাণ
তত্ত্ব
৪ ডিসেম্বর, ২০২৩
৮৫০
এলাকা পরিকল্পনা- পরিবর্তন অথবা তৈরী করা
প্রতিবেদক: স্থপতি ম. ইশতিয়াক কামাল
স্থপতি এবং পরিকল্পনাবিদদের অন্যতম কাজ হচ্ছে এলাকা পরিকল্পনা । এলাকা পরিকল্পনার আওতা ইমারত নির্মাণ থেকে ব্যাপক অথচ নগর পরিকল্পনা থেকে ক্ষুদ্র । কোনো নির্দিষ্ট এলাকার পরিকল্পিত পরিবর্তন যা উন্নয়নের জন্য নির্দিষ্ট তাই হচ্ছে এলাকা পরিকল্পনা । নগর পরিকল্পনা থেকে এর ভিন্নতা হচ্ছে মাত্রায়, পরিমাপে অর্থনৈতিক ও ভৌগলিক শর্তে এবং গ্রামাঞ্চলের সাথে সম্পর্কে । ছোট পরিসর বলে এলাকা পরিকল্পনার সমস্যা বা সুবিধা-অসুবিধা কোনো অংশে কম না । পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিদেরও কোনো অংশে কম না। পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিদের তাই এই নিয়ে যথেষ্ট সাবধানতার সঙ্গে অগ্রসর হতে হবে । এখানে যেমন কর্ম স্বাধীনতা আছে তেমনি সীমাবদ্ধতাও থাকবে । সবচাইতে মারাত্মক ভুল হবে যদি পেশাদাররা স্রষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ন হয়।
কয়েক দশক আগেও দেখা গিয়েছে এলাকা পরিকল্পনার কাজ পেশাদার স্থপতি বা পরিকল্পনাবিদদের উপর ন্যস্ত করে দেওয়া হত, তারা তাদের অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত অভিপ্রায়ের মিশ্রনে শহরে-শহরে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা করতেন । তারপর আসতো বাসিন্দা বা এলাকা অধিবাসীরা যারা পরিকল্পনার ফল তারা ভোগ করতো, ভাল মন্দ যাই হোক তা ভোগ করা ছাড়া উপায় ছিল না । তবে বেশ কিছু উদাহরণ আছে যেখানে দূরদশী পরিকল্পনাবিদদের কাজ সত্যিই প্রশংসনীয় । তবে এখন এই নিয়ম পাল্টবার সময় এসেছে। এলাকা পরিকল্পনা এখন আর গৎবঁধা নিয়মের অন্তর্ভৃক্ত নয়। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলসমূহে যেখানে উন্মুক্ত জমির পরিমাণ কম এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অধিবাসীদের নিয়েই কাজ করতে হয় এবং এই বাসিন্দাদেরকেই পুনর্বাসন করতে হয় । এলাকা পরিকল্পনায় তাই এখন ত্রিভুজ ধারনা কাজ করে।C7fb7f50 E636 4cb9 Ad91 845db19081a7
ত্রিভুজের তিন মেরদতে তিনজন স্বতন্ত্র সংস্থা বা ব্যক্তি। সবার উপরে এলাকাবাসী অর্থাৎ যাদের এলাকা পরিকল্পনা করা হবে তারা । তারপর স্থপতি বা পরিকল্পনাবিদ এবং তৃতীয় মেরদতে সেবা প্রদান সংস্থা বা যারা বিদ্যুৎ, গ্যাস ও আনুসাঙ্গিক সেবা প্রদান করবেন তারা । সবার মধ্যখানে রয়েছে প্রজ্ঞাপন- যা কিনা সকলের মধ্যে যোগযোগ রক্ষা করে চলবে, সমন্বয় সাধন করবে । এই তিন পক্ষই একে অপরের পরিপূরক । আবার তিনজনই অর্থনীতির বাধনে আবদ্ধ । শেষমেষ অর্থই এই ধারার গতি নিয়ন্ত্রণ করে। এই কার্যই ধারাটা নতুন কিছু নয; আনুষ্ঠানিক approach বা প্রয়োগবিধি থেকে একটু ভিন্ন । অতীতের বড় বড় নগর- বন্দর এই ত্রিভুজ নিয়মেই গড়ে উঠেছে- পরিবর্তন হয়েছে শুধু সময়ের, প্রযুক্তির আর গঠনতন্তরের ৷ যেহেতু বিকেন্দ্রীকরণ এবং দায়িত্বের বন্টন হয়েছে তাই এই পুরানো ত্রিভুজ আমরা নতুন করে চিন্তা করতে পারি।
F1801c20 165c 4847 A1f3 D6482b29d941এলাকা নির্বাচনের পর সর্বপথমে এলাকাবাসীদের কথা চিন্তা করা হয়। তারা কে কিভাবে সেখানে অবস্থান করছেন সেটা যেরকম গুরুতুপূর্ণ তাদের ভবিষ্যতের ইচ্ছাও তেমন তাৎপর্যপূর্ণ । এলাকার কি চরিত্র হবে তাদের স্বাতন্ত্রবোধ কতটা তাদের নানা বেচিত্র গ্রহণের আগ্রহ কতটা, সবই বিবেচ্য।

এলাকাবাসীদের মধ্যে ধর্ম, পেশা, শিক্ষা বয়সের যত ভিন্নতা থাকবে তত প্রাঞ্জল পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব । হবে দ্বিতীয় মেরুতে স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদগণ তাদের অভিজ্ঞতা আর শিক্ষার আলোকে বিচক্ষণতার সাথে এলাকা উন্নয়ন পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করেন। বিভিন্ন এলাকাবাসীদের নিকট থেকে এবং অন্যান্য কেস ষ্ট্যাডি (Case Study) করে তারা সুচিন্তিত পরামর্শ দেন। এলাকা উন্নয়নে তাদের ভূমিকা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ । কারণ এলাকাবাসী বিশেষজ্ঞদের মাঝে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারেন। তারা এলাকাবাসীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর প্রয়োগ প্রযুক্তির মধ্যে মিলন সৃষ্টি করেন।

তৃতীয় মেরুতে অবস্থান করেন সেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহ (Service Sector যাঁরা পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, রাস্তা-ঘাট ইত্যাদি নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করবেন। তিন মেরুর প্রত্যেকেই প্রত্যেকের পরিপূরক । একটা সুন্দর স্বাস্থ্যসম্মত এলাকা পরিকল্পনায় সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়। আর এই সহযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য চাই প্রচার বা পাবলিসিটি যার ফলে এলাকাবাসীর যেন প্রথম থেকেই ব্যাপারটা সম্পর্কে অবগত হতে পারেন । তাদের মতামত প্রদান করতে পারেন। এর ফল বহুবিধ; প্রথমত যারা সংশ্লিষ্ট অথচ অবগত নন তারা জানতে পারবেন। এক এলাকার পরিচিতির সঙ্গে অন্য এলাকাও এই ধরনের কার্যক্রম সম্বন্ধে সচেতন হবে । বিচক্ষণতার সঙ্গে পর্যালোচনা হবে, ফলশ্রুতিতে পর্যায় ক্রমে একটা test case mJ model case সৃষ্টি হতে পারে ।

আর সব কিছুকেই অদৃশ্য পর্দার ন্যায় সামগ্রিক অর্থনীতি ব্যাপারটাকে জড়িয়ে আছে এবং থাকবেই। অর্থসংকট যেমন অনেক কার্যক্রমকে সীমিত করে রাখতে পারে তেমনি সেই একই কার্যক্রমকে আরও cost efficient করে তুলতে পারে । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিকল্পনাবিদদের একটা অভিপ্রায় থাকে অসাধারণ কিছু সৃষ্টির । স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদ এবং Client সবাই অসাধারণ একটু কিছু আশা করে। বিপদ আসে যখন কাজটা শেষ হল আর ফল আশানুরুপ হয় না। এলাকাবাসী এবং নক্সাকারী, দুই পক্ষই অসস্তুষ্ট, ফলে ভবিষ্যতে এই ধরনের কার্যক্রমে তাদের সংকোচ আসে, অথচ একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে সাধারণের মধ্যে অসাধারণ লুকিয়ে থাকে । এলাকা পরিকল্পনার মতন বড় কাজে যেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতির বিস্তর ব্যবধান, পেশার বৈচিত্র, বয়সের অমিল, সেখানে সাধারণ দুই একটা জিনিসের মধ্যে অসাধারণ বৈচিত্র্য বা স্বাতন্ত্রবোধ গড়ে উঠে । হয় সুন্দরে- অসুন্দরের মিলন, আসে পরিণত চিন্তা- আসে আগ্রাসন আসে অংশগ্রহণ-আসে তর্ক, আলোচনা আর পাল্টা তর্ক এবং পর্যালোচনা । এক ঘেয়েমী সরে গিয়ে আসে ভিন্নতা । যে কোন এলাকা উন্নয়নে একটা রুচিসম্মত পরিবেশ তৈরি করার জন্য তাই চাই এই ত্রিভুজের মধ্যে পারম্পরিক যোগযোগ । পূর্ণ সহযোগিতা এবং বিশ্বাস, বিশেষ করে একে অনোর সথে আলোচন করে বর্তমান পরিস্থিতির পূর্ণ অনুধাবন বিশেষ প্রয়োজনে ভবিষাৎ পরিকল্পনা জন্য। চিন্তা করতে হবে বর্তমানে যে জমি আছে তা কিভাবে সমাধান করা সম্ভব হবে তা সমাধান করতে হবে । আসবে রাস্তা-ঘাট-স্কুল-মন্দির, মাদ্রাসার পরিসর ও অবস্থান ।
এক্ষেত্রে পূর্বের বাসিন্দাদের সাথে যোগাযোগ করতে হতে পারে । সাথে সাথে স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদদের যোগযোগ রাখতে হবে সার্ভিস শিল্পের দিকে । এই তৃতীয় মেরুর অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতা (limitation) থাকতে পারে- বিশেষ করে যখন পয়-নিষ্কাশন, রাস্তা, বিদ্যু, গ্যাস, পানি সরবারহের কথা ওঠে। পদে পদে তাদের সাথে আলোচনায় মিলিত হতে হবে। প্রয়োজনবোধে সমীক্ষা/জরীপ করে পরিসংখ্যান করতে হবে । ইমারতের উচ্চতা, ধরন, রাস্তার দিকে ইমারতের সম্মুখভাগ (Alignment), খেলার মাঠ, পুকুর, বাজার এর অবস্থান নির্ধারণ করতে হবে । সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা কি হবে গ্রয়োজনাবোধে নক্সার পর নক্সা মডেল ইত্যাদি তৈরি করে ঠিক করতে হবে। এইসব কাজের জনা অর্থনৈতিক সংকট অন্তরায় হলেও ইচ্ছা থাকলেই এলাকাবাসীর সহযোগিতায় বা এলাকার সমবায়ের মাধ্যমে একটা ব্যবস্থা করা যায়। প্রতিবারে অবশাই এলাকাবাসীদের চাওয়া পাওয়ার একটা ন্যায্য হিসাব রাখা প্রয়োজন । যাতে তা সময় সময়ে মিলিয়ে নেওয়া যায়।

কিছু কিছু জিনিস অবশ্যই সুযোগের উপর ছেড়ে দিতে হবে । তাতে অনেক সময় যথাযথ সমাধান সতস্ফূর্ত ভাবে বেরিয়ে আসে । চিন্তাধারায় সংকীর্ণতা পরিহার করে সমষ্টির উন্নয়নের জন্য উদারতার প্রয়োজন । এই উদারতাই একটা ভিন্ন সম্পদে পরিণত হয় । তখনই আসবে detail এর প্রতি নজর । তখনই কাজটা হবে মানবীয় (Humanic) এই ধরনের মুক্ত আলোচনা না থাকলে এবং বিভিন্ন সংস্থা/পক্ষের মধ্যে যোগযোগ না থাকলে তৈরি করার পর অনেক সময় সামাজিক সমস্যা, জটিলতা, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদির সৃষ্টি হতে পারে ।

নির্বাচিত এলাকায় নতুন পুরাতনের সমাহার থাকলে অনেক সমস্যা দেখা দেয়। অসচেতন পরিকল্পনাবিদ হয়তো সবুজ বেষ্টনী দিয়ে পুরাতনকে এক ঘরে করে ফেলতে পারে। তাতে যেমন নতুন পুরাতনের পৃথক থাকতে পারে অন্যদিকে অনিচ্ছা স্বর্তেও নৃতনটাই হয়ে যাবে আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দু । অথচ কোন স্থানের ইতিহাস তার গোড়াপত্তন যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ এটাকে অস্বীকার করা উচিত নয় । দুই মিলিয়ে নতুন এলাকায় প্রাণচঞ্চল কেন্দ্র হতে পারে-যা থেকে সকলেই উপকৃত হবেন। তাদের সাথে পর্যায়ক্রমে আলোচনার মাধ্যমে তাদের স্থান ত্যাগের কারণ নির্ণয় করতে হবে । একই সাথে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পেলে তারা পর্বের জায়গায় ফিরতে আগ্রহী কি-না তা জানতে হবে ।

এখানে একটা বিষয় সতর্ক থাকতে হবে স্থপতি পরিকল্পনাবিদরা যেমন, এলাকাবাসীদের বা তৃতীয় সংস্থাদের এই কাজে উদ্ভুত করতে পারেন এবং স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের প্রভাব এদের উপর পড়বে । পক্ষান্তরে এর উল্টাটাও ঘটতে পারে, পরিকল্পনাবিদদের কাজের উপর প্রভাব ফেলতে পারে । খেয়াল রাখতে হবে যেন এই প্রক্রিয়ার মূল কার্যক্রমটা জড়িয়ে না যায় । এদের মতামত যেমন অনোর উপর চাপিয়ে দাওয়া যাবে না। তেমনি অন্যের মতামতও সরাসরি মেনে নাওয়া যাবে না। পারস্পারিক মতামতের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে এলাকা পরিকল্পিত প্রক্রিয়াকে চলমান রাখতে হবে । শুধুমাত্র তখনই একটি সুস্থ ও বাসযোগ্য এলাকা পরিকল্পনার ধারণা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

আপনার মতামত দিন

কমেন্ট

Logo
Logo
© 2024 Copyrights by Sthapattya o Nirman. All Rights Reserved. Developed by Deshi Inc.