ইমপ্রেশনিজম তৈরী হয়েছে শিল্পীদের চোখের বিষন্নতা থেকে। এই বিষন্নতা ডালপালা মেলেছে, তৈরী করেছে আধুনিকতা, যেন এক বিজয় তোরণ, যে তোরণের মধ্যে দিয়ে ইউরোপিয়ান শিল্প পৌঁছেছে বিংশ শতকে। ইমপ্রেশনিজমের সঙ্গে বিষন্নতার সম্পর্ক কি? ইমপ্রেশনিজম হচ্ছে আধুনিকতার আরম্ভ, বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতার প্রথম সোপান। ইউরোপিয়ান পেইন্টিং এর পূর্বতন ইতিহাস ভেঙ্গেছে ইমপ্রেশনিজম এবং পরবর্তী আধুনিক আন্দোলনগুলো পোষ্ট ইমপ্রেশনিজম, এক্সপ্রেসনিজম, অ্যাবস্ট্রাকসনের সূত্রপাত এখান থেকেই। স্টুডিওর বাইরে আঁকা, সরাসরি দেখা আলোককে দৃশ্যমানের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া, সকল রং আপেক্ষিক করে তোলা, ধূলি ধূসর ইতিহাস এবং মতাদর্শ হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়া, প্রাত্যহিক প্রতিভাসকে শহুরে মানুষের অজ্ঞিতার বিষয় করা : এখানেই ইমপ্রেশনিজমের শক্তি। এই শক্তি সরলতার ও সততার, পেইন্টিং এর কোন গোপন নেই, সবকিছুই প্রকাশ্য, দিনের আলোর মত স্পষ্ট। লুকোবার কিছুই নেই, এই দৃষ্টিভঙ্গী পেইন্টিংকে লিবারেটেড করে দিয়েছে। চোখের বিষন্নতার কথা আমি উল্লেখ করেছি। এই বিষন্নতা পেইন্টিং গঠনের বিষন্নতা এবং এই বিষন্নতা পেইন্টিং পদ্ধতি থেকে উঠে এসেছে। এই পদ্ধতি হচ্ছে ইমপ্রেশনিষ্ট পদ্ধতি। পিগমেন্টের হাল্কা স্বচ্ছতা, ক্যানভাসের সুতো এই স্বচ্ছতার মধ্যে দিয়ে দেখা যায়, ব্রাশ স্ট্রোক, আলো ও ছায়ার দোলা, এ সবে উদ্ভাসিত চক্ষুর সত্যতা এবং অবজেকটিভ অস্পষ্টতা, সবই দৃশ্যকে করে তোলে ভবঘুরে, গৃহহীন অন্তসারহীন, এখানে আশ্রয় নেয়া সম্ভব। এ ধরনের পেইন্টিং এর দিকে তাকালে এই অনুভূতিটাই জাগে। ইমপ্রেশনিজমের অর্থ যদি ইমপ্রেশনই হয়, তাহলে সতত পরিবর্তমানতা দেখা এবং যে দেখে অর্থাৎ দর্শক, তার মধ্যে কি সম্পর্ক তুলে ধরে? দর্শক, এ ক্ষেত্রে পেইন্টার এবং দর্শক, দুইয়ের ইমপ্রেশনই, কম-বেশী সঞ্চারমান, চোখের পলকে দৃশ্যটি দূরে সরে যায় কিংবা বদলে যায়। জ্ঞানের সঙ্গে জানার একটি সম্পর্ক আছে। কিন্তু ইমপ্রেশন, বিপরীতে, একা। যতই গভীর ভাবে, অন্তরঙ্গ ভাবে, অভিজ্ঞতাশ্রুয়ীভাবে মুহুর্তটিকে দেখা হোক না কেন, ইমপ্রেশনটি পরে হয়ে উঠে স্মৃতির মতো, যে স্মৃতি প্রমাণের পরপারে। দৃশ্য এবং দর্শকের মধ্যকার সম্পর্ক, এখন থেকে পলাতকের মতো, যেন এক রহস্য কিংবা গোলকধাঁধা। মেঘের তলায় একটি গাছ এবং ঐ গাছটি রোদের আলোয়, যেন দুই গাছ, দুই অভিজ্ঞতা, চোখে দুই অভিজ্ঞতার উদ্ভাস। এই উদাহরণটি, চিত্রিত গাছ দুটি, একই সঙ্গে সুচারু ও অস্পষ্ট। সবকিছুই বিসর্জিত চক্ষুর সুচারুতার কাছে, যে সুচারুতা রং ও টোনের কাছে বিসর্জিত। স্পেস, পরিমাপ, ইতিহাস, আইডেনটিটি, সবই আলোর খেলার কাছে অন্তর্লীন। মনে রাখা দরকার চিত্রিত আলো, বাস্তবের আলোর মতো স্বচ্ছ নয়। চিত্রিত আলো চিত্রিত অবজেক্টকে ঢেকে দেয়, বরফে ঢাকা নিসর্গের মতো। ১৮৭২-এ দুটি পেইন্টিং আঁকেন লাইলাক গাছের। একটি মেঘাছন্ন দিনে, অন্যটি রোদ উজ্জল দিনে। গাছটির নিচে শুয়ে আছে তিনটি ফিগার। প্রথম ক্ষেত্রে ফিগারগুলোকে মনে হয় লাইলাকের ছায়ায় তরঙ্গের মতো। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, আলোর উজ্জলতায় দিনের আলো হয়ে উঠেছে লিজার্ডের মতো, অদৃশ্য। প্রথম ক্ষেত্রে লাইলাকের ফুলগুলো কপার রঙা, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে পুরো দৃশ্যটাই জ্বলছে, সদ্য আগুণ জ্বালানোর মতো। দুটি পেইন্টিংই উদ্ভাসিত দুটি ভিন্ন আলোর এনার্জি থেকে। সবকিছুই বিচ্ছুরিত, দুই ভিন্নভাবে। সুচারুতা বা অস্পষ্টতার যোগসাজসে দর্শক বাধ্য হন নিজের অভিজ্ঞতায় লাইলাক ফুলের দিকে কিংবা নৌকার দিকে, কিংবা ঘরবাড়ির দিকে ফিরে তাকাতে। এই সুচারুতা দর্শকের ভিজুয়াল স্মৃতি জাগিয়ে তোলে এবং এই অস্পষ্টতা দর্শকের স্মৃতিকে সংযোজিত করতে সাহায্য করে। তা বাদেও দর্শকের উন্মিলীক দৃশ্যের চোখের স্মৃতি তীক্ষভাবে, প্রখরভাবে উদ্দীপিত হওয়ার দরূন অন্যান্য চোখের স্মৃতি গন্ধ উষ্ণতা ভিজা ভিজা, পেশাকের টেক্সচার, সবকিছুই অতীত থেকে আহরিত থাকে। একেই কি বোদলেয়ার বলেছেন, করেসপন্সেস,সমান্তরলতা: অভিজ্ঞতার এমন একাগ্রতা মোহাবিস্ট করে। অতীতের মধ্যে প্রক্ষিপ্ত হওয়া এবং অতীতের দিকে অগ্রসর হওয়ার মধ্যে তীব্র উন্মাদনা আছে। এই উন্মাদনা, একসঙ্গে প্রত্যাবর্তন এবং সরিয়ে নেওয়া। শেষে, সবকিছুই, একসঙ্গে ঘটমান, লাইলাকের আগুণ থেকে অবিচ্ছিন্ন। পেইন্টারের কাছে একজন মনের চোখে এ সবই রং, আর দর্শকের কাছে, স্মৃতি, স্মৃতিময়তা। এভাবেই এই বিশেষ পেটন্টিং টি কিংবা ইমপ্রেশনিষ্ট কাজগুলো পাঠ করা সম্ভব। তাহলে কি বদলেছে? পূর্বে দর্শক, প্রবেশ করাইতেন পেইন্টিংএর মধ্যে। একটি পেইন্টিং সৃষ্টি করত নিজের সময় ও স্পেস এবং তাদের অভিজ্ঞতা টিকে থাকত অপরিবর্তিত হয়ে। এর সঙ্গে রীতি মাফিক পারসপেকটিভের কোন যোগ ছিল না। এটা সুং চীনা নিসর্গের জন্য সত্য কিংবা ব্রিটিশ-পূর্ব স্বদেশীয় নিসর্গ চিত্রের জন্য সত্য। পিরো ডেল্টা ফ্রানচেসকার ‘সলোমনের তাবু’ কিংবা গ্রনওয়ালডের ‘গলগোথা’র জন্য এ সব সত্য: মুহুর্ত আবদ্ধ একটি স্বকীয়তার মধ্যে। এ কথা ম’নের ‘গার সালাজারের’ জন্য ঠিক নয়। ইমপেশনিজম ঐ সময় এবং ঐ স্পেসকে আবদ্ধ করেছে। ইমপ্রেশনিস্ট পেইন্টিং যা দেখায় তা হচ্ছে, যা পেইন্ট করা হয়েছে এমনভাবে তা আর সেখানে নেই। এ ক্ষেত্রেই পেইন্টিং ফটোগ্রাফের খুব কাছের। ইমপ্রেশনিষ্ট পেইন্টিং এর মধ্যে প্রবেশ করা যায় না। পেইন্টিং কি দর্শকের স্মৃতি টেনে আনে কিংবা উসকে দেয়? মনে এবং তাঁর বন্ধুরা তাঁদের কাজের পজিটিভিস্টিক ও সায়ান্টিফিক যে সব দাবি করেছেন সেসব কতটুকু ঠিক? মনের বন্ধু উপন্যাসিক জোলাও একই দাবি করেছেন, তাঁর উপন্যাস ল্যাবরেটরি রিপোর্টের মত অবজেকটিভ এবং আবেদনহীন। জন বার্জারের উক্তি স্মর্তব্য, জোলার লেখার আসল শক্তি উৎসারিত গভীর, অন্ধকার এবং অচেতন অনুভূতি থেকে। বার্জার যেমন লেখা সম্মন্ধে জোলার ধারণাকে প্রশ্ন করছেন, তেমনি মনে এবং তাঁর বন্ধুরা তাঁদের কাজের পজিটিভিস্ট মূল্যায়ন সম্মন্ধে যা ভেবেছেন সেখানেও প্রশ্ন করেছেন বার্জার। বার্জারকে অনুসরণ করলে এসব কাজের ভিন্নতর আয়তন খুঁজে পাওয়া যায়। এই আয়তন থেকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব কেন স্মৃতি এত প্রবল মনে এবং তাঁর বন্ধুদের কাছে। সমুদ্র, নদী জলাভূমি সমন্ধে তাদের আবেগ এবং প্রেম প্রণয় এ সবই ফিরে ফিরে এঁকেছে তাঁদের কাজে; স্মৃতির হাত থেকে তাঁরা পালাতে পারেন নি, স্মৃতির দিকে চোখ মেলে তাঁরা গভীরতার দিকে, অন্ধকারের দিকে এবং অচেতন অনুভূতির দিকে পরিক্রমন করেছেন। জয়নুল আবেদিনের কতক ইমপ্রেশনিষ্ট কাজে এই স্মৃতির দুর্মতার দিক, গভীরতর দিক, অন্ধকার দিক এবং অচেতন অনুভূতির দিকের খোঁজ পাওয়া যায় না? এসব কাজের সঙ্গে তাঁর রিয়ালিষ্টিক কাজের দূরত্ব যোজন যোজন। তাঁর ইমপ্রেশনিষ্ট কাজে মনের মতে সূর্যের আলোর প্রতিক্রিয়া তিনি নিরীক্ষন করেছেন। সূর্যের আলো মিশে নদীর ঢেউয়ে, আকাশের নীলে, নৌকার গায়ে; যেমন ভাবে মনে চোখের আলো মিলিয়েছেন ঘাসের ডগায় ঝোপঝাড়ে। জয়নুল আবেদিন, মনের মতো, আলোক পেইন্ট করেন নি, তাঁরা করেছেন স্মৃতি, শৈশবের কিংবা কোন এক কালের দেখা কোন দৃশ্যের। আলো অবশ্যই। কিন্তু কোথাকার এবং কবেকার আলো? এই আলো তৈরী হয়েছে আলো ও রংয়ের আন্তসম্পর্ক থেকে, আলো ও রংয়ের আন্তসম্পর্ক পেইন্টিংটিতে তৈরী করেছে গতিচঞ্চলতা, এ সবই দেখা দেয় মনে, বনার্ড, ডিলনিজদের কাজে একটা ভিশন তৈরী হচ্ছে উন্মিলীত করছে রংয়ের স্ব”ছতা, কনট্রাস্ট দীপ্তি। আমাদের মধ্যে মম নিতে থাকে নানা অনুভব, যেমন কি না আপোলিনিয়র তাঁর বলেছেন: জানালাটা খোলা কমলালেবুর মতো আলোর সুন্দর ফল। |