সাদা আলো, কালো ছায়া

স্থাপত্য ও নির্মাণ
তত্ত্ব
৩ ডিসেম্বর, ২০২৩
১,৩৪৯
সাদা আলো, কালো ছায়া

স্থপতি লুই.আই.কা’ন বিশ্ব আধুনিক স্থাপত্যে একজন অগ্রনায়ক। পেনসেলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যে অধ্যাপনা করেছেন বহুকাল। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় সেখান থেকে খুব দূরে নয়।  ১৯৬৮ সালে বসন্তকালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাইস আর্কিটেকচার বিভাগের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে করে তিনি কথাগুলি বলেছিলেন যা ১৯৬৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।

স্থপতি লুই.আই.কা’ন বাংলাদেশে খুবই পরিচিত একটি নাম। পুরোনাম লুইস ইসাডোর কা’ন, আমাদের শের-ই বাংলা নগরের স্থপতি তিনি। তার সৃষ্ট এই ভবনটি সারা বিশ্বের স্থাপত্যের মানচিত্রে একটি উজ্জ্বল তারকা। শের-ই বাংলা নগরের বেশীরভাগ বিখ্যাত ভবনের স্থপতিও তিনি। সংসদ ভবনের অতি পরিচিতির কারণে সেগুলি সম্মন্ধে আলোচনা কমই হয়। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, সংসদ ভবনের এম.পি. হোস্টেল, সরকারী কর্মকর্তাদের বাসভবন, কমিউনিটি হল, স্টাফ কোয়ার্টার এবং আরও অনেকগুলি ভবনই তার চিন্তার ফসল। বিশ্ব আধুনিক স্থাপত্যে তিনি একজন অগ্রনায়ক। পেনসেলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যে অধ্যাপনা করেছেন বহুকাল। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় সেখান থেকে খুব দূরে নয়।  ১৯৬৮ সালে বসন্তকালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাইস আর্কিটেকচার বিভাগের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে করে তিনি কথাগুলি বলেছিলেন যা ১৯৬৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।

স্থপতি কা’নের এই লেকচারটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট হল, তার কাব্যধর্মী উপস্থাপনা। তার বক্তৃতাটি রেকর্ড করে লিখিত আকারে প্রকাশিত হবার পর অসাধারণ বিষয়টি সকলের কাছে স্পষ্ট হয়। ঢাকায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি বক্তৃতা করেছেন, সেখানেও তার কথাগুলি একই রকমের ছিল কি না জানি না। তার লেখাটি পড়তে গিয়ে দুটো বিষয় আমাকে আকর্ষণ করে, এক, কঠিন বিষয় সহজ করে বলবার অপূর্ব দক্ষতা, দুই, কথামালার কাব্য ধর্মী বিন্যাস। আমাদের বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য ভাবানুবাদ করাটাই উপযুক্ত মনে করেছি, ভাষায় বিষয়টি সহজবোধ্য করা যায় অন্যদিকে কাব্যধর্মটিও বজায় থাকতে পারে। মহান স্থপতির বাক্যালাপকে নিয়ে আমার এই দুঃসাহস কতটুকু সফল হল তা জানিনা, পাঠকই তার বিচার করবেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই বিশ্বখ্যাত স্থপতির জীবনালেখ্য এর আগেও আমি লিখেছি এবং তা স্থাপত্য ও নির্মাণে প্রকাশিত হয়েছে।

কাজী আনিসউদ্দিন ইকবাল
সম্পাদক-স্থাপত্য ও নির্মাণ

 
 

সাদা আলোকালো ছায়া

স্থপতি লুই. আই. কা’ন

রূপান্তর: কাজী আনিসউদ্দিন ইকবাল

 

এক মাস আগে আনুমানিক,
কাজের বেলাটা  চলে গেছে অনেকক্ষণ
আমি বসে আছি অফিসেই, যেমন আমার নিয়ম।
এবং লোকটা প্রশ্ন করল, হাঙ্গেরী থেকে এসেছে এদেশে
যখন রাশিয়া প্রকৃতপক্ষে হাঙ্গেরী দখল করে নিল
তার পক্ষে থেকে যাওয়াটা ছিল অসম্ভব,
তার জিজ্ঞাসা কি আমারও নয় ?
আমিই বা কি জানি সেই উত্তর ?

নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে পড়ছিলাম
ক্যালিফোর্নিয়ায় কি হচ্ছে, এই’ত কিছুদিন আগে
ক্যালিফোর্নিয়া ঘুরে এলাম, বার্কলেতেও ছিলাম
দেখেছি দিন বদলের ঢেউ
মেশিনের অবশ্যম্ভাবী দাপুটে প্রতাপ
এবং শুনেছি সেখানে কতিপয় কবির কথা
যারা কবিতা বলতে চেয়েছেন,
একটিও শব্দ তাতে নাই।

কমপক্ষে দশ মিনিট নিশ্চুপ,
মনটাকে রীতিমত চিরুনী চাষ দিয়ে
গ্যাবরকেই জিজ্ঞেস করলাম,
‘সাদা আলোর ছায়াটা কি ? ’

সাদা আলো ….? সাদা আলো ?
একটি কথা পূনঃ পূনঃ বলা
অনেকটা যাকে আমরা স্বগতোক্তি বলি
গ্যাবরের অভ্যাস, বোঝবার জন্যই হয়ত,
এবং শেষ পর্যন্ত, ‘আমি জানি না’।
আমি বলি ‘কালো ,
সত্যি বলতে কি সাদা আলো বলতে কিছু নেই
তেমনি কালো ছায়াও হয় না’।
এই মুহুর্তে আমরা
সূর্যকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছি,
প্রখর রৌদ্রকে ব্যবচ্ছেদ করে
খুঁজতে চাই সত্য নিরন্তর,
পঙ্ক্তিমালায় সুরচিত কাব্য নয়
মানুষের হৃদয়ের বাণী।

শৈশবে সূর্যের আলো ছিল হলুদ
আর ছায়াটিকে মনে হত নীল
কিন্তু এখন দেখি পরিস্কার সাদা আলো আর কালো ছায়া।
অস্থির হই না, জানি একদিন সতেজ হলুদ আলো
এসে পড়বে আবার আমার জানালায়
দেখতে পাব সেই নীল স্বপ্নের ছায়া।
পরিবর্তনের হাওয়া এনে দিবে নতুন বিস্ময়।
শুধু মাত্র মননের শক্তি সৃষ্টি করে নতুনের পথ
বিচার বিশ্লেষনে তা অসম্ভব।

‘বলত গ্যাবর,
স্থাপত্য ছাড়া আমি আর কি বা করতে পারতাম ?
হয়ত, নতুন এক রূপকথা লিখতাম,
রূপকথা থেকেই’ত এসেছে বিমান, এসেছে বাষ্প ইঞ্জিন,
বলতে পারি কত অদ্ভুত মনকাড়া সব যন্ত্রের নাম।
সবই সেই স্বপ্নের ফসল।

একটা কাহিনী মনে পড়ছে,
‘প্রিন্সটনে’ আমার পর পর তিনটি লেকচার দিতে হবে।
ভাষণের কোন শিরোনাম নেই।
আমার সেক্রেটারী চেপে ধরল
প্রিন্সটনের প্রচারের জন্য শিরোনাম চাই।
গ্যাবরের সাথে ওই সন্ধ্যার পরে
আমি কিন্তু, শিরোনাম পেয়ে গেছি-
(এমন একজন বন্ধু থাকাটা কতটা সৌভাগ্যের,
যে সব কিছুই বুঝতে চায়
ছোট ছোট উপসর্গে নিয়ন্ত্রিত নয় )

গ্যাবর কিন্তু খুবই আগ্রহী
আসলে, ও শব্দের অর্থ এবং তার দ্যোতনা নিয়ে
মাথা ঘামায় বেশী রকমের।

শব্দ তার কাছে এতটাই যেন
‘ফিডিয়াসের ভাস্কর্যের’ সাথে
দাড়ি পাল্লায় মাপতেও পিছপা হবে না এতটুকু।

শব্দের নাকি দুটো গুন আছে
একটি মাপতে পারি প্রতিদিনের ব্যবহারে,
অন্যটি শব্দের নিজস্ব দ্যোতনা
যা মাপার কোন স্কেলই নাই।

আমি কিন্তু আমার ‘প্রিন্সটন ভাষণের’ শিরোনাম
পেয়ে গেছি।
প্রথমটি হতে পারে, স্থাপত্য- সাদা আলো এবং কালো ছায়া,
দ্বিতীয়, স্থাপত্য ও মানুষ
তৃতীয়, স্থাপত্য-অবিশ্বাস্য এক অধ্যায়।

এই অবিশ্বাস্য কথা একটু, জোরদার হল কি ?
কথাটা বুঝতে জানতে হয়
‘কলামে’র জন্ম সম্ভাবনা।
সহজ কথা হ’ল দেয়াল থেকেই কলাম সৃষ্টি।

দেয়াল মানুষকে দিয়েছে অনেক,
ধ্বংসের মুখে দূর্লংঘ বাধার প্রতীক।
কিন্তু মানুষ যে আটকা পড়তে চায় না,
বাইরের দুনিয়াটা তার দেখা চাই।
তাই দেয়াল খুঁড়ে গর্ত করা হল,
দেয়াল কি কোন ব্যথা পায়নি ?
‘কি করছ তুমি আমাকে নিয়ে’,
আমি তোমাকে দিয়েছি নিরাপত্তা
তোমাকে নির্ভয় করেছি
আর এখন কি না তুমি আমার
বুকে ছিদ্র করে এফোঁড় ওফোঁড় করছ ?
বেঈমান!
তখন নিরূপায় মানুষ বলল,
‘কিন্তু আমি যে বাইরেরটা দেখতে চাই
বাইরে রয়েছে কত বিস্ময়!
আমাকে’ত দেখতে হবে’।

দেয়ালের মন খারাপে কিছু আসে যায় নি
বরং দেয়ালকে বহুধা বিভক্তই হতে হল
খোলা দৃষ্টিপথকে স্থান করে দিতে।
এখন দেয়ালের গায়ে মসৃণ পাথর
জানালার উপরে লিনটেল
দেয়ালের আর মন খারাপ করার জো নেই।

দেয়াল তৈরী কতগুলি নিয়মের মধ্যে এসে গেল।
সেই সাথে দেয়ালের মধ্যে যে ফাঁকা থাকবে
তারও জন্য এল শৃংখলা,
এবারে কলামের কথা,
স্বতঃস্ফুর্তভাবেই শৃংখলার দাস,
ফাঁকা পরিসরের জন্য তাকে চাই
বদ্ধ ঘরের জন্যও চাই।

নিজের গায়ে ছান্দিক বাতায়নের আয়োজনটা
বরণ করে দেয়াল হারাল তার ভাব গম্ভীর পরিচয়
কখনও এতটাই ফাঁকা হতে হল তাকে
যেন দেয়াল বলে আর চেনাই যায় না
একগুচ্ছ কলামের সারি !
এ উপলব্দি
নয় প্রকৃতি প্রসবিত।
এর জন্মসূত্র লেখা আছে মানুষের
অলৌকিক অনুভূতির ভেতর কুঠুরীতে,
যেখানে মানব সত্ত্বার অপূর্ব অনুভূতি
প্রকাশের যন্ত্রণায় ছটফট করে।

বেঁচে থাকাটার অর্থই নিজেকে প্রকাশ করা,
আমার ঘৃণা
আমার ভালবাসা
আমি চাই সকলে জানুক আমার প্রতীতি
আমার ক্ষমতার দৈর্ঘ্য।
মন যদি হয় আত্মা,
মস্তিস্ক তাহলে এক বিশেষ শারিরীক উপাদান
সেখানেই আামি খুঁজে পাই আমার স্বাতন্ত্র
তার সঞ্চালনেই আমার কর্মযোগ।
গোগলের সেই পর্বত, শিশু এবং সরিসৃপের গল্পের মত।

প্রকৃতি কাউকে বেছে নেয় না,
শুধু মেলে ধরে তার নিয়ম অমোঘ,
সবকিছুই ঘটে যায়
পারিপার্শ্বিকতার বিস্তীর্ণ জালে
সেখানে মানুষ তার পথ বেছে নেয়,
নিয়ত চলমান নান্দনিক বিচার।
মানুষের সকল সৃষ্টির সাথে তাই
শিল্পের প্রকাশনা অবধারিত।

অন্য দিকে, যা কিছু সৃষ্টি প্রাকৃতিক
তার অন্তরেই রয়ে যায় তার জন্মকথা,
পাথরের হৃদয়ে থাকে পাথরের ইতিহাস।
মানুষকে বিশ্লেষণ করে দেখ
পেয়ে যাবে তার জন্মসূত্র-বিবর্তন গাঁথা।

বোধগম্য হল কি এ জটিল রহস্য?
বুঝতে পারলে ধরা দেবে মহাবিশ্বের অকুল রহস্যের ক্ষীণ রূপরেখা।
এক মুঠো ঘাস হাতে নিয়ে
এই মহাযজ্ঞের রূপ বর্ণনা করতে পারেন
এমন আছেন কেউ কেউ।
সাধারণের জন্য চাই শিক্ষা বহুবিধ।
সাধনেই সিদ্ধি-
‘অর্জুনের বিশ্ব দর্শন’ একালে অধরা।

জীবনের পথই শিক্ষার পথকে করেছে আলোকিত।
আমাদের ‘সচেতন আমি’ বুঝিয়ে দেয়
মানব পথচলায় প্রকৃতির অবদান।
আমাদের জ্ঞান বৃক্ষ জন্ম নিয়েছে
জানবার দূর্ণিবার আগ্রহের বীজ থেকে।

সেই জিজ্ঞাসাই বলে দেবে সভ্যতার ইতিহাস।
শিখবার প্রথম ধাপে
প্রকাশের দক্ষতা চাই।
কেউ বুঝিয়ে দিলে তবে’ত আমি শিখতে পারি।

বেঁচে থাকার নিরন্তর আকাংখার মাঝেও
প্রকাশের অদম্য আগ্রহ।

ধর্ম বিশ্বাসও কি সৃষ্টি হয়নি
সেই প্রশ্ন করবার আগ্রহের অনুকূলে ?
মানুষের জন্ম-ইতিহাস
এক অনন্ত জিজ্ঞাসার ইতিহাসই বটে।

‘মানুষের সেবক হবার জন্য প্রত্যেক ইমারত’
এ অনুভূতির চেয়ে বড় কোন চেতনা
কোন স্থপতির থাকতে পারে,
তা আমার বুদ্ধি সীমানার বাইরে।
সে ইমারত হতে পারে সরকারী দপ্তর
অথবা কারও নিজস্ব বাড়ী
কিংবা বিদ্যাপীঠ, হাসপাতাল
বা আনন্দ ফূর্তির মহল,
তাতে স্থপতির লক্ষ্যচ্যূতি অবান্তর।

এখন যে স্থাপত্য তৈরী হচ্ছে,
তাতে মানুষের জন্য কথাটা প্রায়সই উহ্য,
প্রোগ্রাম যারা লিখছেন, তাদের অনুসরণ করাই
স্থপতির সাফল্যের চাবী,
ইমারতকেও বরণ করতে হবে একই পরিণতি।

উদাহরণ দেব প্রোগ্রামের রূপান্তরের,
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণী কক্ষে
একটা আশ্রম ডিজাইন করতে দিলাম,
আমি বললাম ‘আমি হলাম একজন সন্ন্যাসী’
ভেবেছি সন্ন্যাসীদের জন্য একটা
সংঘ গড়তে হবে।
এখন প্রশ্ন হ’ল, কোথা থেকে শুরু হবে ?
সন্ন্যাসীদের সংঘ ব্যাপারটা কি ?
কোন নির্দেশনা অনুপস্থিত।
আলোচনা চলছে দু’সপ্তাহ ধরে,
সন্ন্যাসীর প্রকৃতি বুঝতেই এতটা সময়।

ভারতীয় বংশদ্ভুতা এক নারী
সর্ব প্রথম অর্থবহ কিছু একটা বলতে পারল।
‘জায়গাটা এমন হওয়া উচিত যেন
একটা কোষ থেকে সব কিছু ডাল পালার মত বিচ্ছুরিত’।
বলল আরও, ঐ কোষ থেকেই একটি মন্দির গড়বার প্রেরণা,
ঐ কোষেই অনুভূত হবে নির্জনতা কতটা জরুরী

এবং ঐ কোষের ভিতরে কোন ধ্যান আসনে, সংঘক্রিয়ায়
বুঝতে পারা যাবে একটি ‘ওয়ার্কশপের প্রয়োজনটা কোথায়’।

আরও একজন ভারতীয়,
একটু বাড়িয়ে বলতে চাইল,
(এসব ভাব জগতের বিষয়ে ওদের
মন একটু বেশী ঝুঁকে থাকে হয়ত)
‘একটা চায়ের ক্যান্টিন মন্দিরের সমান’
মন্দির কিন্তু মর্যাদায় নিরব কক্ষের সমান,
আর সেই নির্জন পরিসর, সেও’ত ক্যান্টিনের সমকক্ষই বটে।
কেউ কারও চেয়ে ছোট নয়!
ক্লাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল ছেলেটি, একজন ইংরেজ.
একটি অদ্ভুত সুন্দর ডিজাইন দেখাল,
একটি অগ্নিকুন্ড যোগ করেছে সে,
বাইরে থাকবে সেই আগুনের আধার।
আগুনের গূঢ় অর্থমালা তার অনুভূতিকে
একটি পথের সন্ধান দিয়েছে।
আগুনের তাপ আছে আর আছে দহনের অঙ্গীকার।
সেও একটা নির্জন ধ্যানাসন তৈরী করেছে
আশ্রম থেকে আধা মাইল দূরে।
‘ধ্যানের জন্য নির্জন পরিসর থাকাটা আশ্রমের গৌরব’
বলেছে সে, ‘এই নির্জনতা
আশ্রমের খুব দরকার
অতি প্রয়োজনীয় শক্তি।

পিট্সবার্গ থেকে একজন সাধুকে ডাক পাঠালাম,
সদা প্রফুল্ল সাধু পুরুষ তিনি,
চিত্রশিল্পী, বড় স্টুডিওতে থাকেন।
কর্মকক্ষে উপস্থিত থাকার তাড়াহুড়া নেই তার,
আমাদের প্লানগুলো নিয়ে রগড় করলেন,
আধা মাইল দূরে ক্যান্টিন দেখে হতাশ,
‘আমি’ পারলে আমার বিছানায় বসে খাই!’
মনমরা আমরা সকলেই।

তিনি চলে গেলে আমরাও ভাবি,
একজন সামান্য পুরোহিত মাত্র,
কতটা তার জানবার অধিকার।
আমরা সেই প্রোগ্রামটা নিয়ে এগুই,
অনেকগুলো চমৎকার কাজ হয়েছে।
বলা যায়,
এই প্রোগ্রামটিই ছিল সবচেয়ে বড় সাফল্য
কারণ ডিজাইনের ভিত্তি কোন নি¯প্রাণ কাগজ নয়,
যেখানে বলা হয়, এই ঘরটি এত বর্গফুট আরেকটি অত।
একটি কমনরুম কতটা বড় হওয়া উচিত
সে বিচার এখানে উপেক্ষিত।

যখন ‘জুরী’ বসল, ফাদার রোনাল্ড অতিথি।
আশ্রম প্রশ্নে প্রথা বিরোধী চিন্তক।
তার সামনে পুরানো প্রোগ্রাম টিও দেওয়া হল
যা ছিল সেই একঘেয়ে প্রথা মাফিক।
তাতে নতুনের গন্ধ নেই, নি¯প্রাণ !
অথচ এই শিক্ষার্থীরা,
তারা ছিল উজ্জ্বল, প্রত্যেকেই নতুন সমাধান হাতে
সকলেই পেয়ে গেছে নতুন জীবনের স্বাদ!
সামান্য নতুন আঙ্গীকে ভাবার অবকাশ
নতুন ভাবনার শক্তি  তাদের করেছে উজ্জীবিত,
এই’ত আজকের দিনে নতুন আবিস্কারের পথ।

এমনি আরেকটি গল্প বলি,
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ‘ছেলেদের ক্লাব’ ডিজাইন করতে দিলাম,
আজকের দিনে খুবই মজার একটা বিষয় নয় কি ?
‘ছেলেদের ক্লাব’ বলতে কি বুঝি ?
একটা জায়গা’ত বটেই-সেটা সবাই বুঝেছে,
কিন্তু সকলের কাছে ওই ‘জায়গা’ কথাটা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে।
যে লোকালয়ে ক্লাবটি হবে সেটি আসলে এক ক্রসরোড, কয়েকটি রাস্তা যদি বন্ধ করে দেওয়া যেত,
চলাচল রূদ্ধ করে দিয়ে, অন্তত এমন পথগুলি যে পথ সহজে কেউ মাড়ায় না।
নতুনের মিলন মেলার পাশে পুরানো সড়ক,
অবাস্তব অচল গ্রন্থনা!
কিন্তু যখন পথগুলোর মিলন স্থানকে
করা হল একটি প্লাজা তখন ঐ জায়গায় ছেলেদের ক্লাবটিকে
আর অসম্ভব বলে মনে হল না।
নতুন আয়োজনে রাস্তা হয়ে গেল
পার্কিং অথবা খেলার স্পেস,
প্রাণবন্ত যেমনটি ছিল আগে।

আমি যখন ছোট ছিলাম,
আমরা দোতলার জানালা থেকে ফুটবল ছুঁড়ে মারতাম,
আমরা খেলার মাঠে যেতাম না।
মাঠ খেলার পূর্ব শর্ত নয়,
খেলা উৎসাহের ফসল, আয়োজনের নয়।

আমাদের সেই ছেলেদের ক্লাবের বৈশিষ্ট নিয়ে যখন কথা হচ্ছে,
একজন বলল,
‘আমি ছেলেদের ক্লাব বলতে একটি খড়ের গাদা বুঝি’।
আরেকজন, খড়ের গাদায় ভীষণ আপত্তি
তার মতে, ‘এটা একটা ছোট ঘর’
(খুব একটা বুঝেছে বলা যায় না)
সেই গ্যাবর, আগেই দিয়েছি পরিচয়,
ক্লাসে উপস্থিত ছিল এবং যথারীতি
কিছু জিজ্ঞেস না করলে উত্তর দেয়া তার স্বভাব বিরুদ্ধ।
তিন সপ্তাহ অতিক্রান্ত
আমরা তখনও ছেলেদের ক্লাব এর চরিত্র হাতড়ে চলেছি।
জিজ্ঞেস করলাম গ্যাবরকেই
‘ছেলেদের ক্লাব বলতে তুমি কি বুঝ ?’
তার উত্তর হল,  ‘ছেলেদের ক্লাব হল এক ধরনের ধারণা
যার মর্ম কথাটি হল ‘থেকে’ গন্তব্য নয়।
সহজ করে বললে, ওখান থেকে কোথাও যাওয়া যায়,
ওখানটাকে উদ্দেশ্য করে কেউ আসবে না।

জটিল চিন্তা,  যখন ভাবি
সাদা আলো আর কাল ছায়া ,
কেন এই পরিবর্তন ?
কারণ মানুষ কোন না কোন ভাবে বাস্তব জিনিসই বুঝবার চেষ্টায় আছে,
মানুষ নয় জিনিষ চেতনার সূত্র খুজতে উৎসাহ নেই।
কিন্তু আমূল পরিবর্তনের পথেই নতুনের জন্ম
বাস্তবেরও নবতর ব্যাখান।

একটা বিদ্যালয় কি ? সে কি ‘গন্তব্য’ না কি উৎস ?
এ প্রশ্নে আমিও নিরুত্তর, সিদ্ধান্তহীন।
কিন্তু আমি যদি হই একটা স্কুলের স্থপতি
এ প্রশ্নটি হবে খুবই বিব্রতকর।

আপনি কী বলবেন ?
আপনার ৭টি সেমিনার রুম চাই
নাকি জায়গাটা হবে প্রেরনার, উদ্দিপনার,
অথবা এমন একটা কিছু,
ভাবনার গহীন কন্দর হাতড়ে
মানুষ যেখানে কথা বলতে চায় ?
ওরকম জায়গায় কি সম্ভব একটা ‘ফায়ার প্লেস’ ?

দীর্ঘ করিডোরের বদলে একটা গ্যালারী
কেমন হবে এই প্রতিস্থাপন ?
গ্যালারী কিন্তু একটা সত্যিকারের ক্লাসরুম
ওখানে ছেলেটি বক্তার কথা হয়ত বুঝতে পারে নি
পাশের ছেলেটির কাছেই প্রশ্ন তার
তুমি কি বুঝেছ ?
দুজনের ফিসফিসনিতেই জটিলতার গিট খুলে যায়।

আমি যে আশ্রমের কথা বলছি
সেখানে একটা প্রবেশস্থল আছে, সেটা প্রবেশ দুয়ারও বটে।
সকল ধর্মের বাণীতে আমন্ত্রণের অলংকার
সকলের জন্যই’ত দুয়ার খোলা চাই।
কিন্তু সে আবাহন থাকে শুধু প্রধান ফটকে
ভিতরে আশ্রমের নিজস্ব পবিত্রতা ।

জীব বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য তৈরী করেছিলাম
সল্ক ইনষ্টিটিউট, তো সেই সল্ক সাহেব
আমার অফিসে এলেন,
একটা ল্যাবরেটরী বানাবেন এবং তার
প্রোগ্রাম তার হাতে, সহজ সরল।
‘আপনাদের এই পেনসেলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে
চিকিৎসা বিদ্যার জন্য কত বর্গফুট?’-জিজ্ঞাসা তার।
এক লক্ষ বর্গফুট-সে তো কম নয়!
কিন্তু সল্ক চাইলেন পিকাসোকে ল্যাবরেটরীতে নিয়ে আসতে !
তার জন্য যা লাগে দিতে রাজী সে অধিকার।
এটা তার জবরদস্তী, কে করবে অস্বীকার?
মাপ-জোপ বিজ্ঞানের চর্চার অনিবার্য অনুষঙ্গ,
মাইক্রোব’ত মাইক্রোবই থাকতে চায়
নিতান্তই বাস্তব কারণ।
গোলাপ কি কখনও অন্য ফুল হতে চায় ?
তেমনি মানুষও থাকতে চায় মানুষ হিসেবে।
বিশেষ এক মনোভাব, কিংবা বিশেষ অন্যকিছু
যা এক দিকে টানছে তোমাকে, অন্যদিকে যেতে দিতে নারাজ
সঠিক পথে চল হে, নইলে চাবুক,
এমনি এক দৃঢ় প্রতীজ্ঞা
অভূতপূর্বকে করেছে সফল চিরকাল
একথা বুঝেছিলেন ঐ সল্ক মহোদয়।

বিজ্ঞানীর লক্ষ্য থাকে স্থীর,
নিজেকে রাখতে হয় আঁটসাঁট
ভিন্নতর চিন্তাবিলাসের ঝুঁকিও বৃহত্তর।
অনুসন্ধী মনের সহচর সেই অসীম সত্তা
শিল্পীর প্রকৃত অনুভব।

এই হল স্রষ্টার ভাষা।

বিজ্ঞান তাকে খুঁজে পায় যা রয়েছে বিদ্যমান
শিল্পী তুলে আনে অপার্থিব
যা কেউ দেখেনি কখনও।
এই ছিল সল্ক ইনষ্টিটিউটের অন্তসার
এখানেই ব্যবধান পেনসেলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের।
সল্ক ধারণ করেছে
ল্যাবরেটরী আর কমন রুমের সমতা আয়তনে।

ওখানে একটা আর্ট লবী আছে,
ছবি আর চিঠি পত্রের প্রদর্শনী।
ওখানেই সকলের খাবারের আয়োজন,
খাবার ঘরের চেয়ে ভাল কোন
সেমিনার রুম অসম্ভব, অন্তত আমার বিশ্বাস।

একটা জিমনাসিয়ামও আছে,
যারা বৈজ্ঞানিক নয় তাদের জন্যও আলাদা পরিসর।
ডিরেক্টর সাহেব, তারও ঘর আলাদা
এমনকি অনেক ঘর নামহীন, পরিচয়হীন।
প্রবেশ হলেরও’ত নাম লেখা নেই পরিস্কার।
অথচ ওটাই’ত সবচেয়ে বড় জায়গা।
ভিন্ন পথে প্রবেশ করাও সম্ভব
আপনি বাধ্য নন যে এপথ দিয়েই ঢুকতে হবে।
তবে প্রবেশ হলটি এমন যে সেখানে চাইলে
একটা ‘ব্যানকোয়েট’ হতে পারে।
সেই আমলের ‘ব্যারন’দের বিশাল হল ঘরের মত নয়
যেখানে আপনি না চাইলেও কাউকে করতে হবে সম্ভাষণ।

এবং আপনি নিশ্চয়ই বুঝেন
গবেষকরা হ’ল সেই জাতের মানুষ
যারা ভয় পান, পাশের লোকটিকে,
তার মতই একই বিষয়ে সে কাজ করছে কি না
এমনি একটা ভয়ের চাদরে নিজেকে
আবৃত করে রাখে, এদিক থেকে বলতে গেলে,
সন্দেহ তাকে করে রাখে মৃতপ্রায়।

এমনি সব ধারণাগুলি থেকেও তৈরী হতে পারে প্রোগ্রাম
(যদি ওই প্রোগ্রাম কথাটাকেই আমরা সবচেয়ে পছন্দ করি)
তবে এই শব্দটি আমার কাছে একটু হালকা শোনায়,
আমি বলি, এ হ’ল একটা উপলব্ধি,
কতগুলি স্পেসের চরিত্রটাকে বুঝে তাদের
কি কি কাজে লাগানো যায় তার সত্যিকারের অনুধাবন।
এখন আপনি বলবেন,
এমনও স্পেস আছে যাকে বলা যায় অনির্দিষ্ট,
ব্যবহারে একটু এদিক ওদিক করাটাই উত্তম।
আমিও একমত।

কিন্তু কতগুলি জায়গায়’ত পরিবর্তন অমার্জনীয়,
সেসব পরিসর উদ্দেশ্যের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত,
তাদেরকে সেরকমই থাকতে হবে।
ঐ জায়গাগুলি আসলেই থাকে অপরিবর্তনীয়
পরিবর্তন হয় মানুষের যারা আসে আর যায়।
এসব জায়গায় আপনি বার বার এসেছেন
অথচ আজ ৫০ বছর পরেও বলছেন,
ওইটা লক্ষ্য করেছ ? সেইটা দেখেছ ?
আসলে এই স্থানগুলি
সামগ্রীকতায় একটা অনুপ্রেরণার মত।
এর একটি ছোট্ট অংশ বা একটি ডিটেইলের জন্য নয়,
স্থানটি আপনার মন হরণ করেছে
অনেকটা স্বর্গীয় অনুভূতি !
এরকম একেকটা পরিবেশের অনুুভূতি
‘ব্যক্তি আমার’ কাছে খুবই জরুরী।
একটা ভবন যেন বিশ্বময়তার অন্তরে একটি বিশ্ব।
তাই বলি, ঐ সব ভবন যারা প্রার্থনার
জন্য, বসবাসের জন্য অথবা মানব সমাজের
যে কোন কর্ম উদ্দেশ্যে নিবেদিত
তাদের হতে হবে ‘তার চরিত্রের পরিচয়বাহী’।

এই চিন্তাধারা নিয়েই আমাদের চলতে হবে,
তা নইলে স্থাপত্যের মরণ !

কেউ কেউ ভাবছেন স্থাপত্য শিল্প এখন মৃত শয্যায়,
হয়ত কোন সুবিধা হয় তাদের, সুযোগ নেবার।
পুরো দায়িত্ব নেবার ওদের  ক্ষমতা নেই।
অনেকেই মেশিনকে দিতে চান অতি অধিকার।
মেশিনকে বাদ দেবো কেন ?
থাকবে প্রযুক্তি আরও যত নব আবিস্কার।
কিন্তু যারা গড়তে চান মেশিন নগর
তাদের বলছি কখনওই হবেনা তেমন
মেশিন নয় হতে হবে মানুষের শহর।

নগর পরিকল্পনায় রয়েছে  ঘাটতি অনেক।
স্থপতিদের উপর দায়িত্বটা ছেড়ে দিলেই
পাওয়া যাবে প্রচুর সমাধান।
অস্বীকার করি না, নগর স্থাপত্যে হয়নি অনেক কিছুই
স্থাপত্যের শৃংখলা তার মধ্যে জরুরী বিশেষ ।
কেন জলাধারগুলি শহর থেকে দূরে ?
পথের সংযোগে এসে থেমে যাই কেন ?
আমরা’ত যাত্রা বিরতী চাই না
চাই গতি নিরন্তর।

আরও অনেক থাকে প্রয়োজন,
মানুষের, সমাজের।
আসুন আরও একটু উদার হই।
লক্ষ্য রাখুন, পানির সংকট বাড়ছে
পানির ব্যবহারে একটা শৃংখলা জরুরী এখন।

ফোয়ারা হতে পারে নয়নাভিরাম
শীতাতপ নিয়ন্ত্রণও ছাড়তে পারবনা জানি,
কিন্তু খাবার পানির সমমানে
পানি ব্যবহারের যুক্তি কোথায় ?

আমি,
ভারতে একটা শহর গড়তে যাচ্ছি
অন্তত বলা যায় দায়িত্বপ্রাপ্ত আমি।
ভাবছি সেখানে সবচেয়ে গুরুত্ব পাবে পানির টাওয়ার।
পানির টাওয়ারগুলি বসিয়ে দেব একেবারে মাঝখানে।
সড়ক সংযোগের সাথেই দাঁড়িয়ে থাকবে এসব টাওয়ার।
অবশ্য এসব সংযোগে ফায়ার সার্ভিস বা পুলিশ ষ্টেশনও
চিন্তা করা যায়, তবে এসব জায়গা ইমারত হতেই হবে
ভাবতে চাই না এমন।
রাস্তার একটু সম্প্রসারণই হয়ত যথেষ্ট।
বাতাস যেমন করে
এয়ার প্লেনের প্রপেলারের মধ্য দিয়ে
বাধাহীন প্রবাহিত,
তেমনি আমার সড়ক সংযোগ হবে
সড়ক চলবে সড়কের মত
আপনিও হতে পারেন বিমানে সওয়ার।

ডালেস এয়ারপোর্টে ঈরো সারিনেন
প্রবেশের জায়গাটির চমৎকার
সমাধান দেখালেন।
যা কিছু সেখানে চলমান তারা
একই প্রকৃতির হবার সুযোগ নেই,
তাদের চলাচলের প্যাটার্নেও মিল হবে না নিশ্চয়ই।
তবে সেখানে গেলে মনে হবে
এমন কোথাও এসেছি যা আমার উদ্দেশ্যকেও জানাচ্ছে সম্ভাষণ।

অন্যান্য এয়াপোর্টগুলিতে যেমন
বিভিন্ন  এয়ারলাইন কোম্পানীর ছোট ছোট দোকান,
ডালেস ওদের থেকে ভিন্ন, উন্নত বলাই ভাল।
ওসব এয়ারপোর্টে আপনি যেন একটা খাঁচায় ঢুকেছেন,
মানুষ সেখানে অসহায়, মর্যাদা রাখা দায়।
মনে হবে, ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোনখানে’।

আজ অপরাহ্নে কথা হচ্ছিল
স্থাপত্য শিক্ষার তিনটি দিক নিয়ে।
আসলে, আমার বিশ্বাস আমি স্থাপত্য শেখাই না,
নিজে শিখতে চেষ্টা করি।
তবুও ওই তিনটি বিষয়ে আলোচনা চলুক,
প্রথমটি হল ‘স্থাপত্য পেশা’।
পেশাজীবির দায়িত্ব হয়ে পড়ে,
যে লোকটি তাকে কাজটি দিয়েছে তার
সকল প্রয়োজন, এমনকি ঐ মানুষের
সম্পর্কীত বিভিন্ন মানবিক, সামাজিক বিষয়গুলো
পুরো বুঝে নেয়া।
সেই সাথে প্রকৃত অর্থেই জানতে হবে
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাঝে পার্থক্য কোথায় ?
নন্দন তাত্ত্বিক ধ্যান ধারণাও স্থপতির পেশাগত
অবস্থানের বাইরে নয়।
আপনি নিশ্চয়ই প্রকল্পের প্রোগ্রামটিকে
পরিসর আয়োজনের দিকেই নিয়ে যাবেন,
একজন পেশাজীবি স্থপতি হিসেবে সে’ত ভুলবার নয়,
কিন্তু লক্ষ্য করবেন, মানুষের জন্য এসব পরিসর।
মানবিক হতে হবে তার মূল সূর।
বলতে পারেন, পরিসরের শৃংখলা এটা
অথবা মানুষের ‘কর্ম’ কে সর্বাত্মক উপলব্ধির কথা।
আমি বলছি, আপনার দায়িত্ব হিসেবে,
উচিত হবে না, ক্লায়েন্টের হাত থেকে
শুধু মাত্র একটি ‘প্রকল্প চাহিদা’ নিয়ে,
সেটাই মিলিয়ে মিলিয়ে কাজ করে যাওয়া।
যেমনটা হয় রুগীর ডাক্তারী পরীক্ষার সময়।

আরেকটি বিষয় হল,
নিজেকে মেলে ধরাটা শিখতে হবে,
এটা শিক্ষার্থীর নিজস্ব অর্জন এবং তাকে
শেখাতে হবে দার্শনিকতা বিষয়টি আসলে কি ?
বিশ্বাসের অর্থ কি ? ধর্মের প্রকৃত নির্যাস।
অন্যান্য শিল্পকেও জানতে হবে
তাদের ব্যবহার, পদ্ধতি সবকিছু।
আমি প্রায়সই বলে আসছি, হয়ত বহুবার,
স্থপতিকে শক্তভাবে নিতে হবে তার অধিকার।
ধরে রাখতে হবে তার কর্ম পরিধি।

চিত্রশিল্পী কিন্তু একটা মানুষকে উল্টো করে আঁকতে পারে,
মধ্যাকর্ষণের আমোঘ নিয়ম
তাকে বাধা দেবে না।
পেইন্টার যদি মানুষের চেয়ে দরজা ছোট করে আঁকে
কিংবা দিনের ছবিতে কালো আকাশ
অথবা একটি পাখি যে উড়তে পারে না
তাতে কি কিচ্ছু যায় আসে ?

শিল্পীর কল্পনার স্বাধীনতায়
বাস্তব নীল, অবলীলায় হতে পারে লাল।
ভাস্কর কামানের মুখে বসিয়ে দেয়
চারকোণা চাকা,
বক্তব্য তার ‘যুদ্ধ অচল’।
কিন্তু স্থপতিকে চাকাটা গোলই রাখতে হবে
দরজা মানুষের আকারের চেয়ে বৃহত্তর।
স্থপতির ক্ষমতা অন্যখানে,
জানতে বুঝতে হবে সেই অধিকার।
স্থপতি মানুষের হাতে তুলে দেবে প্রযুক্তি
যা থেকে তারা গড়তে পারে অপূর্ব অবিশ্বাস্যকে।
প্রকৃতিতে যা নেই, প্রযুক্তি তা দিতে পারে,
দৈহিক ক্ষমতা অতিক্রান্ত,
আশা জাগানিয়া সংবাদ।
কারণ প্রকৃতির আছে অমোঘ নিয়ম,
মানুষের আছে ইচ্ছা।

তৃতীয় যে কথাটি আমি বলতে চাই,
আপনাকে শিখতে হবে
‘স্থাপত্য বলে কিছু বাস্তবে নেই’
স্থাপত্য কর্মই থাকে বাস্তবে, আর
স্থাপত্যের বাস মনের ভিতরে।
একটা ইমারত, একটা স্থাপত্য কর্ম গড়া যায়,
সেটা হল ‘স্থাপত্য চেতনার’ প্রতি তার নৈবেদ্য।
এই চেতনা কোন ষ্টাইলকে চিনে না,
চেনে না কোন প্রযুক্তি, মানে না কোন পদ্ধতি।
চেতনা শুধু অপেক্ষা করে আছে
কখন সে মূর্ত হবে, ধরা দেবে আপনার কাছে।
স্থাপত্য চেতনা বিমূর্ত, তাকে মাপবার উপায় নেই।
পার্থেননকে মাপতে পারবেন ?
সেটা হবে পার্থেননকে ধ্বংস  করার সামিল,
তেমনি প্যানথিয়ন,
দেখুন, এসব ইমারত মানুষের চিন্তা চেতনার
সফল ধারক।

হ্যাড্রিয়ান যখন প্যানথিয়ন বানাতে চেয়েছিল,
ভেবেছিল এমন একটা জায়গা হবে,
যেখানে প্রার্থনার জন্য
আসবে যে কোন মানুষ, অনিয়ন্ত্রিত।
তাই দেখুন, একটা দিকহীন ইমারত!
বর্গাকার নয়, কারণ, বর্গের কোণগুলি
কোণের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়।
প্রার্থনার ঘর কিন্তু কোন বেদী নেই‘ত।
আলো আসছে উপর থেকে, কাছে যাবার জো নেই,
সে আলোর ঠিক নীচে দাঁড়ালে, মানুষটিকে নয়
অবয়বই দৃশ্যমান !

ভাবতে পারেন, কি অসাধারণ স্থাপত্য সমাধান
সকল স্থপতির জন্য এই হ‘ল প্রেরণা,
এই হল আদর্শ ভবন।।

 

আপনার মতামত দিন

কমেন্ট

Logo
Logo
© 2024 Copyrights by Sthapattya o Nirman. All Rights Reserved. Developed by Deshi Inc.