স্থপতি সামান্থা লামিসা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভাষ্য হিসেবে ‘ভেনিস আর্কিটেকচার বিয়েনালে', স্থাপত্যকে বিস্তৃত পরিসরে প্রকাশ করার এবং বোঝার মঞ্চ। ইতালিয়ান শিক্ষাবিদ এবং স্থপতি কার্লো রাত্তির কিউরেশনে ১৯ তম ভেনিস আর্কিটেকচার বিয়েনালের ২০২৫ সালের আসরের বিষয় “Intelligens: Natural.Artificial. Collective.”। |
মূল বিষয়বস্তুকে মাথায় রেখে,বাংলাদেশি তরুণ স্থপতি রিজভী হাসান এবং স্থপতি খাজা ফাতমির 'Born in a Camp'' ইনস্টলেশনটি এই ঐতিহ্যকে এক ব্যতিক্রমী গভীরতায় নিয়ে গেছে। শুধুমাত্র নির্মাণ শৈলীর গল্পে সীমাবদ্ধ না থেকে, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান থেকে শরণার্থী শিবিরের বাস্তবতা, সাংস্কৃতিক পরিচয় ও স্থাপত্যিক অভিব্যক্তির এক নান্দনিক প্রকাশ ঘটছে এই প্রকল্পটিতে। বাংলাদেশি তরুণ স্থপতিরা কেবল নিজেদের অবস্থান নয়, বরং তাঁদের দায়িত্ববোধ, প্রতিশ্রুতি ও একান্ত মানবিকতা নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট অবস্থান থেকে স্থাপত্যকে পুনরায় দেখার সুযোগ তৈরি করছেন, Born in a Camp বিশ্বকে এই র্বাতাও দেয়।
Born In a Camp, Cordiere di Arsenale এর “কালেকটিভ” শীর্ষক কক্ষে অবস্থিত। প্রদর্শনীটি দর্শকদের জন্য ১০ মে ২০২৫ - ২৩ নভেম্বর ২০২৫ র্পযন্ত উন্মুক্ত থাকবে। |
'Born in a Camp' - এর ইন্সটলেশন (ছবি স্বত্ব: স্থপতি রিজভি হাসান) |
আদর্শের উৎস ও নির্মাণের পটভূমি ২০১৭ সালে মিয়ানমারে ঘটে যাওয়া জাতিগত নিধনযজ্ঞ থেকে পালিয়ে আসা ৭ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।না বলা অসংখ্য গল্প, ভেঙে ফেলা ঘর, ছিন্নমূল ভবিষ্যৎ এবং একটি জাতিগত পরিচয়ের অবিনাশী আকাঙ্ক্ষার অনেকটাই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কঠোর বাস্তবতার আড়ালে ঢেকে যায়। প্রতিনিয়ত জীবনের সাথে চলমান যুদ্ধের বাইরেও, তাদের যে সৃজনশীল চিন্তার চর্চা, এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝে থেকেও জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার যে দৃঢ় প্রত্যয়, তা বিশ্বের কাছে অনেকটাই অদেখা।
১৯তম ভেনিস আর্কিটেকচার বিয়েনালেতে বাংলাদেশী স্থপতিদের অংশগ্রহণ -'Born in a Camp' - এর ইন্সটলেশন_(ছবি স্বত্ব: স্থপতি রিজভি হাসান)
অস্থায়ী বাস্তবতা, শিবিরের জীবন ও স্মৃতিকে কেন্দ্র করে গঠিত হয় Born in a Camp’ । “এটি একটি ভ্রাম্যমাণ স্থাপত্য-সত্তা, যা চিঠি, স্মৃতিকথা, গল্প, রচনা এবং কবিতার একটি সংকলন। এর মাধ্যমে শরণার্থীরা তাদের প্রতিকূল জীবনগাথা বহির্বিশ্বের সঙ্গে ভাগ করে নেয়। ইনস্টলেশনটির মূল ধারণা, কোনো জায়গায় অস্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলার মাধ্যমে স্মৃতি ও ভাবনার আদানপ্রদান ঘটানো। কিছু সময়ের জন্য এটি একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসতি তৈরি করে, তারপর আবার অন্য কোথাও চলে যায়—এই অভিযাত্রা চলতে থাকে। যেন মানুষ উপলব্ধি করতে পারে, প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও, কিভাবে কেউ নতুন করে দৃঢ়ভাবে উঠে দাঁড়াতে পারে। কিভাবে কেউ দুঃসহ অভিজ্ঞতার পরও এগিয়ে যেতে পারে, সৃজনশীল বুদ্ধিমত্তার চর্চা করতে পারে। যতক্ষণ না উপযুক্ত কোনো আশ্রয়স্থল খুঁজে পায়।” |
প্রকল্পটির আদি ধারণা তৈরি করেন স্থপতি রিজভী হাসান এবং স্থপতি খাজা ফাতমি। তারা দুজনেই বিগত পাঁচ বছরের অধিক সময় থেকে উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থী শিবিরে, বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য এনজিওর মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন। শরণার্থী শিবিরে কাজের সুবাদে দুজনেরই বিভিন্ন স্তরের হস্ত বা কারু শিল্পের কারিগরদের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। ক্ষেত্রবিশেষে তৈরি হয় চিন্তাধারা এবং জীবনধর্মী কাজের বিনিময়। |
(ছবি স্বত্ব: স্থপতি রিজভি হাসান) |
স্থপতি রিজভী হাসান এবং স্থপতি খাজা ফাতমির মতে, “এই ইনস্টলেশনটি গড়ে তোলা হয়েছে কিছু নিবেদিতপ্রাণ রোহিঙ্গা কারিগরের সহযোগিতায়, যারা এখনো নিজেদের সৃষ্টিশীলতাকে ধরে রেখেছেন। তাঁরা শুধু কারিগরই নন, তাঁরা একই সঙ্গে চিন্তক, লেখক এবং দার্শনিকও—এই সম্প্রদায়ের মেধার প্রতিনিধিত্বকারী। ইনস্টলেশনটির প্রতিটি প্যানেল আলাদা, কারণ এগুলো ভিন্ন ভিন্ন কারিগরের হাতে তৈরি ও ডিজাইন করা হয়েছে। একত্রে এই বৈচিত্র্যর্পূণ প্যানেলসমূহ একটি যৌথ সত্তা নির্মাণ করে, যা আমাদের শিখিয়ে দেয় অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে পাওয়া একটি গভীর উপলব্ধি - “অস্থায়ীত্বে বেঁচে থাকা মানেই অপূর্ণতা নয়।” |
নকশা পদ্ধতি ও নির্মাণ প্রকল্পটি শুরু হয় স্থপতি দল এবং শিবিরে থাকা শরণার্থীদের স্বতর্স্ফূত অংশগ্রহণে। স্থপতি রিজভী এবং স্থপতি ফাতমির কনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে যোগ দেন, জিম্বাবুয়ের এলিস যিনি বর্তমানে ইয়েল ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। একাধিক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এই কর্মশালাগুলোতে নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই তাদের ব্যক্তিগত অভিব্যেক্তি, অভিজ্ঞতা,ভবিষ্যৎ চিন্তা এবং অনিশ্চয়তার গল্পগুলোকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার আগ্রহ প্রকাশ করেন। যদিও রিজভী এবং ফাতমি, উভয়ই রোহিঙ্গা ভাষা আয়ত্ত করেছেন, তা স্বত্বেও একে অপরকে সম্পূর্ণভাবে বোঝার উদ্দেশ্যে একটি সর্বজনীন মাধ্যম ছিলো ড্রইং/স্কেচ/ চিত্রাঙ্কন। অংশগ্রহণকারীরা তাদের স্মৃতি, যন্ত্রণা ও আশা, অভিজ্ঞতা, তাদের মতো করে কাগজে আঁকেন।
১৯তম ভেনিস আর্কিটেকচার বিয়েনালে
এই কর্মশালাকে একটি পূর্ণাঙ্গ কাঠামো দেয়ার উদ্দেশ্যে, স্থপতি রিজভী এবং স্থপতি ফাতমি তিনটি রূপরেখা নির্ধারণ করেন : . এই ইনস্টলেশন হবে তাঁদের গল্প বলার বাহক। . এটি হতে পারে বহনযোগ্য, যেহেতু শরণার্থীগণ একটি পরমিত স্থান অর্থাৎ শিবিরের বাইরে যেতে পারেন না তাই, এই ইনস্টলেশনটি হবে তাদের গল্পের বাহক — যেমন, একটি হাতে লেখা চিঠি কিংবা পোস্টকার্ড, যা মানুষ পড়তে পারে, ছুঁয়ে দেখতে পারে, আবার উত্তরও লিখে দিতে পারে। . অথবা একটি গল্প, যা কোন ভ্রমণকারীর সুটকেসে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে পুরে নেওয়া যায়, এমন। এই রূপরেখার সাথে পরিচিত হবার কিছুদিন পর,অংশগ্রহণকারীদের মাঝের একজন (যাবের ভাই) কারিগর,কাঠ দিয়ে তৈরি একটি প্রোটোটাইপ নিয়ে হাজির হন। যেটি ৪৩ সে.মি. x ৬৪ সে.মি.x ২৬ সে.মি. দৈর্ঘ্যের একটি সুটকেসে সফলভাবে ভাঁজ হয়ে যেতে পারে। এই ভাঁজযোগ্য কাঠামোই পরবর্তীতে হয়ে ওঠে মূল নির্মাণের ভিত্তি। |
স্থাপত্য বিন্যাস ও কাঠামোগত অভিব্যক্তি
ইনস্টলেশনটি গঠিত হয়েছে আটটি পৃথক ইউনিটের সমন্বয়ে। প্রতিটি ইউনিটে আছে ১৮টি করে কাঠের প্যানেল বা ‘চেম্বার’। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে ১৪৪টি প্যানেল একত্রিত হয়ে একটি সমগ্র রচনার জন্ম দেয়। প্রতিটি প্যানেলে একেকটি পোস্টকার্ডের সমান এবং একেকজন কারুশিল্পীর হাতে পরম মমতায় নির্মিত। ফলে পুরো কাঠামোটি বহুস্বর ও বহুরূপী জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।
স্থাপত্য পরিকল্পনার দিক থেকে, ইনস্টলেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তার রেখাগত কিন্তু ভাঁজযোগ্য গঠন। প্রতিটি ইউনিটকে একটি কাঁধে বহনযোগ্য কাঠামোর মতো সাজানো হয়েছে - যা একটি কোর স্ট্রাকচার বা স্পাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে এবং পার্শ্ববর্তী স্তরে তার গঠন বিস্তার করে। ইনস্টলেশেন প্ল্যান অনুসারে, এই ইউনিটগুলো পারস্পরিক সংযোগে বিভিন্ন আকৃতিতে রূপ নিতে পারে - কখনও একটি ভাস্কর্যের মতো, কখনও রাস্তার মতো প্রসারিত।এই গঠন একদিকে যেমন মডুলার এবং অস্থাবড়, অন্যদিকে তা প্রতীকী। প্রতিটি স্তরে (Level 01 থেকে Level 06) তাদের বিন্যাসে এক ধরণের স্থাপত্যিক ছন্দ রয়েছে, যেটি শিবিরের ভেতরে থাকা বৈচিত্র্য এবং সহাবস্থানের রূপক। |
|
এই নির্মাণ প্রক্রিয়া শুধু কারিগরি দক্ষতার পরিচয় নয়, বরং একটি মানবিক বহিঃপ্রকাশের অনুশীলন।সকলের সমষ্টিগত উদ্যোগে তৈরি। স্থপতি রিজভী এবং ফাতমি, দুজনেই মূল নির্মাণ দলের প্রসঙ্গ এনেছেন এবং তাদের প্রশংসা করেছেন। অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন - নুরুল আমিন, রাজিয়া বেগম, শফিকুল ইসলাম, মোঃ জাবের, খাইরুল আমিন, আমিনুল্লাহ, ফয়সাল, হুসেইন, নুরুল ইসলাম, নূর আলম, আলী জহর ও আরও অনেকে। তাঁরা শুধু কারিগর নন; তাঁরা একাধারে স্মৃতি রক্ষাকারী ও কল্পনাশীল ভাষ্যকার, যারা একটি দর্শনকে ধারণ করেন। |
|
চিঠি, সংলাপ ও প্রতিক্রিয়া
এই ইনস্টলেশনের পাশে ছড়িয়ে থাকে অসংখ্য চিঠি - শরণার্থী সম্প্রদায়ের মানুষের নিজের হাতে লেখা, যা পড়ে দর্শনার্থীরা তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে ,সেই চিঠিগুলো ফিরে যাবে শরণার্থী শিবিরে। স্থপতি রিজভী হাসান ও খাজা ফাতমির এই ইনস্টলেশন কেবল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নয়; এটি বিশ্বের প্রতিটি উদ্বাস্তু, প্রত্যাখ্যাত ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে - যাদের অস্তিত্ব আজকের বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার সাক্ষ্য বহন করে। |
নান্দনিকতা, প্রতিরোধ ও আত্মপরিচয়ের অভিব্যক্তি ‘Born in a Camp’ প্রকল্পটি স্থাপত্যকে কেবল স্থাপত্য নির্মাণ-এর প্রযুক্তি হিসেবে নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও মানবিক অস্তিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করে। এটি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মতো প্রতিকূলতায় জন্ম নেওয়া মানুষের জীবনের শক্তি ও সৃজনশীলতাকে বিশ্ব দৃষ্টির সামনে তুলে ধরার সুযোগ তৈরি করে। স্থাপত্য কেবল অবকাঠামো নির্মাণে সীমাবদ্ধ না থেকে, মানবিক অনুশীলনের ক্ষেত্র হতে পারে, যেখানে স্মৃতি, শ্রদ্ধা ও সম্ভাবনা - সবকিছুই জায়গা পায়। স্থাপত্য- ইতিহাস ও ভবিষ্যতের মধ্যে এক আত্মদর্শী সংলাপের ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। ‘Born in a Camp ’ প্রকল্পটি তেমনই এক কণ্ঠ - যেখানে প্রতিকূল পরিবেশে বসবাসের মধ্য থেকেও উচ্চারিত হয় সম্মান, যেখানে সাময়িক বসবাসের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যায় অস্তিত্বের শিকড়,কিংবা এক বাক্স গল্প নিয়ে বেরিয়ে পড়া যায় বিশ্বদারে।
১৯তম ভেনিস আর্কিটেকচার বিয়েনালেতে বাংলাদেশী স্থপতিদের অংশগ্রহণ ('Born in a Camp' - এর ইন্সটলেশন) |