পুরনো কারাগারের ভেতর প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া গিয়েছে প্রাচীন দুর্গের অস্তিত্ব

স্থাপত্য ও নির্মাণ
সাম্প্রতিক
৩১ অক্টোবর, ২০২৪
১৪
পুরনো কারাগারের ভেতর প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া গিয়েছে প্রাচীন দুর্গের অস্তিত্ব

পুরাতন ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রাপ্ত নিদর্শন ঢাকার গোড়াপত্তন সম্পর্কে নতুন ধারণা দিচ্ছে।

পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে প্রত্নতত্ত্বিক খননে পাওয়া নিদর্শন ও প্রাচীন দুর্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করছে, ১৪৩০ সালেই এখানে বিশাল প্রাসাদ দুর্গ নির্মিত হয়েছিল; অর্থাৎ সমৃদ্ধ রাজধানী শহর ছিল এখানে। দুর্গ ছাড়াও এই খননে রোলেটেড মৃৎপাত্র ও গ্লেজড মৃৎপাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, যা ইঙ্গিত করে ঢাকা শহরের গোড়াপত্তন কমপক্ষে ২৫০০-১৮০০ বছর (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫ম—খ্রিস্টীয় ২য় শতক) আগে হয়েছে। এমনকি আদি-ঐতিহাসিককালে ঢাকা বিখ্যাত সিল্ক রুটের সঙ্গে যুক্ত থাকার দাবিও উঠছে এই প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে। সেই সঙ্গে 'রাজধানী ঢাকা'র পরম্পরা ও ইতিহাস যে আরো প্রাচীন সেই ইঙ্গিতও দিচ্ছে।

গত মঙ্গলবার রাজধানীর পুরান ঢাকার নিমতলীতে এশিয়াটিক সোসাইটি হেরিটেজ মিউজিয়ামের ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান ও বক্‌তৃতায় পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলাফল তুলে ধরেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও খননকাজের তত্ত্বাবধায়ক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। অনুষ্ঠানে ‘পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন : ঢাকার গোড়াপত্তনের বিশ্লেষণ' শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন তিনি।

 
 

যমুনা ভবনের পশ্চিমের এলাকা উৎখননে আবিষ্কৃত দেয়ালের অংশবিশেষ

ছবি: যমুনা ভবনের পশ্চিমের এলাকা উৎখননে আবিষ্কৃত দেয়ালের অংশবিশেষ (ছবিসূত্র: প্রথম আলো)

 
 

সুফি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তাঁর নেতৃত্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল প্রত্নতত্ত্ব গবেষক ও শিক্ষার্থী ২০১৭-১৮ সালে পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ করেন। তাঁরা কারাগারের প্রধান ফটকের সামনের অংশ, রজনীগন্ধা ভবনের আঙিনা, কারা হাসপাতালের সামনের অংশ, দশ সেল ও যমুনা ভবনের পশ্চিম এলাকা-এই পাঁচ স্থানে ১১টি খননকাজ করেন। এই খননে ঢাকার পুরনো দুর্গের সম্ভাব্য দুর্গপ্রাচীর, বিভিন্ন কক্ষ, নালা, কূপ প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ছাড়া এখানে কড়ি, মোগল আমলের ধাতব মুদ্রা, বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির ভাস্কর্যসহ অনেক রকম প্রত্ননিদর্শন পেয়েছেন।

এই গবেষণা ঢাকার ইতিহাস উন্মোচনের দ্বার উন্মুক্ত করেছে উল্লেখ করে সুফি মোস্তাফিজুর বলেন, একখণ্ড রোজেটা স্টোন লিপি পাঠোদ্ধার যেভাবে প্রাচীন মিসরের রহস্য উন্মোচন করেছে, তেমনিভাবে পুরান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আবিষ্কৃত পুরনো দুর্গ, রোলেটেড মৃৎপাত্র ও গ্লেজড মৃৎপাত্র ঢাকার সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য উন্মোচনের দ্বার উন্মুক্ত করেছে।

আবিষ্কৃত প্রত্ননিদর্শন:

সুলতানি আমলের ইট : খননকৃত খাদের প্রায় প্রতিটিতে এবং প্রায় প্রতিটি স্তরে ইট ও ইটের টুকরা আবিষ্কৃত হয়েছে। সাধারণ ইটের পাশাপাশি অলংকৃত ইট ও ইটের টুকরা এবং ঝামা ইটও পাওয়া যায়, যা প্রত্নস্থানের স্থাপত্য থেকে বিভিন্ন সময় অপসারিত হওয়া। ইটের আকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এখানে সুলতানি যুগসহ বিভিন্ন সময়ের ইট রয়েছে।

গ্লেজড মৃৎপাত্র ও রোলেটেড মৃৎপাত্র : সিল্ক রুটের সঙ্গে সম্পর্কিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ১০ সেলসংলগ্ন এলাকা শাখার পশ্চিম দিকে আকাশি নীল, গাঢ় নীল ও সবুজ প্রলেপযুক্ত গ্লেজড মৃৎপাত্রের টুকরা পাওয়া যায়। প্রায় একই রকম গ্লেজড মৃৎপাত্র বাংলাদেশের আদি-ঐতিহাসিক প্রত্নস্থান উয়ারী- বটেশ্বর ও মহাস্থানগড়ে আবিষ্কৃত হয়েছিল।

 

খননে পাওয়া রোলেটেড মৃৎপাত্রের টুকরা

ছবি: খননে পাওয়া রোলেটেড মৃৎপাত্রের টুকরা (ছবিসূত্র: প্রথম আলো)

 

খননে প্রাপ্ত কয়েকটি গ্লেজড মৃৎপাত্র

ছবি: খননে প্রাপ্ত কয়েকটি গ্লেজড মৃৎপাত্র (ছবিসূত্র: প্রথম আলো)

 
 সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে প্রমাণিত হয়েছে, ইসলাম খানের আগমনের অনেক আগেই ঢাকায় একটি প্রাসাদ দুর্গ ছিল। সুবাদার ইসলাম খানের সেনাপতি ও লেখক মির্জা নাথান তাঁর 'বাহারীস্তান-ই-গায়েবী' বইতে ঢাকায় যে দুর্গের কথাটি উল্লেখ করেছিলেন, সেটিকে পরে ইতিহাসবিদেরা ‘ঢাকাদুর্গ' হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। এই দুর্গে ইসলাম খান বসবাস করেছেন। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে পাওয়া নিদর্শন যুক্তরাষ্ট্রের বেটা ল্যাবরেটরিতে কার্বন-১৪ পরীক্ষা করার পর প্রমাণ পাওয়া গেছে, এগুলো ১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দের। ফলে এখন নিশ্চিতভাবেই বলা যাচ্ছে, এই দুর্গ ইসলাম খানের আসার আগেই নির্মিত হয়েছিল এবং এটিকে 'ঢাকাদুর্গ' নয়; বরং ‘ঢাকার দুর্গ' বলা সংগত। 

সম্পাদনায়: স্থপতি ফাইজা ফাইরুজ                                                                                                                       

সূত্র: প্রথম আলো, কালের কন্ঠ

 

আপনার মতামত দিন

কমেন্ট

Logo
Logo
© 2024 Copyrights by Sthapattya o Nirman. All Rights Reserved. Developed by Deshi Inc.