হুগো আলভার হেনরিক আ'লটো ছিলেন একজন ফিনিশ স্থপতি এবং ডিজাইনার। তার কাজের মধ্যে রয়েছে স্থাপত্য, আসবাবপত্র, টেক্সটাইল এবং কাচের পাত্রের ডিজাইন, সেইসাথে ভাস্কর্য এবং চিত্রকর্ম।
কাজী আনিসউদ্দিন ইকবাল |
ফিনল্যান্ড, উত্তর গোলার্ধের কাছাকাছি ইউরোপের একটি দেশ, নকিয়া ফোন এবং Kone Elevator এর জন্মদাতা দেশ হিসাবে সারা দুনিয়ায় পরিচিত। শিল্পোন্নত দেশ হিসাবে দেশটির যে ছবি আমাদের চোখে ভেসে উঠবে আদতে এর পরিবেশ ঠিক বিপরীত। বছরের দীর্ঘ সময় বরফে ঢাকা ফিনল্যান্ডের বসন্তকাল এক অভূতপূর্ব উৎসবের আমেজ বয়ে আনে। হ্রদ, পাহাড় আর ঘন বনের আবহে ফিনল্যান্ডের মানুষ সূর্যের আলোকে অপরিসীম আবেগে বরণ করে। দমবন্ধ করা শীতের শেষে সূর্যের উৎসব হয় উচ্ছ্বাসিত। মানুষগুলোও তেমনি, আবেগে উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতে যেমন সময় লাগে না তেমনি দীর্ঘ সময় বরফে গৃহবন্দী থাকায় আত্মবিশ্লেষণে তারা খুবই অভ্যস্ত। |
মানব জীবনের সাথে এই বৈপরিত্যের ঐক্য প্রতিষ্ঠা ফিনল্যান্ডের যে সব মানুষ করতে পেরেছেন স্থপতি আলভার আলটো তাদের অন্যতম একজন। ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি শহরের একজন ট্যাক্সি ডাইভারকে জিজ্ঞেস করলেও আলটোর সবিস্তার বিবরণ পাওয়া যায়। ফিনল্যান্ডের জাতীয় মানসে এতটাই তার প্রভাব। আলভার আলটো ১৮৯৮ এর ৩রা ফেব্রুয়ারী পূর্ব বোথনিয়ার কুওর্টিনা গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তার বাবা ছিলেন একজন ল্যান্ড সার্ভিয়ার। নিজ কাজে দক্ষ এবং স্মার্ট হিসাবে সুখ্যাতি ছিল তার। ড্রইং এর নিখুঁত মাপ জোঁকের মত তার পোষাক পরিচ্ছদও থাকত নিখুঁত। আলটোর মা ছিলেন খুবই প্রাণবন্ত, স্নেহশীল, নতুন কোন আইডিয়াকে তিনি প্রশ্রয় দিতেন কিছুটা ক্ষতি স্বীকার করে হলেও। বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান আলটোর বাহ্যিকতায় বাবা কে সহজেই খুঁজে পাওয়া যেত। বাবা বলতেন ‘সব সময়ে ভদ্রলোকের মত আচরণ করবে’, ছেলে বাবার মতই পোষাকে এবং ব্যবহারে ছিল কেতা দুরস্ত। মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সহৃদয়তা এবং উচ্ছ্বাসের কারণে আলটো সকল আসরেই মধ্যমনি হয়ে উঠতেন। শৈশবে আলটোর নানার প্রভাব পড়েছিল তাদের পরিবারের উপর, বন সংরক্ষক নানা শিখিয়েছিলেন, ‘গাছপালা মানুষের সাহায্য ছাড়াই বাচঁতে পারে, মানুষ পারবে না’। আলটো, তার ছোট দু’ভাই এবং বোন, সকলেই খোলামাঠ, বন ও প্রকৃতির একনিষ্ঠ প্রেমিক ছিলেন। আলটোর যখন বয়স মাত্র ৫, তখন ওদের পরিবার মধ্য ফিনল্যান্ডের জাইভাসকিলা শহরে গিয়ে বাসা বাঁধল। জাইভাসকিলা হ্রদ, জঙ্গলে ঘেরা সুন্দর এক শহর, বিদ্যাচর্চার জন্যও বিখ্যাত, ‘ফিনল্যান্ডের এথেন্স’ ডাকা হত। পরিবারটির এখানে চলে আসার সেটিও একটা কারণ। বাবার বিশাল সাদা টেবিলের নীচে খেলা করতে করতে এক সময়ে বাবার টেবিলেই আঁকা জোকা শুরু করা আলটো ছোট কাল থেকেই ড্রইং যে দক্ষ হবে সে‘ত অনিবার্য। জাইভাসকালোর উদার নৈতিক পরিবেশ এই পরিবারে সিনেমা, থিয়েটার, নাচ-গান, খেলাধুলার প্রতি অকৃপন আকর্ষণ এনে দিল। কিশোর আলটো যেমন পরিবারের সকলের স্কেচ করতেন, তেমনি লেখালেখিও চলত। রীতিমত শিক্ষকের কাছে পেইন্টিং শেখার পাশাপাশি পিয়ানো বাজানো রপ্ত করতেন। বাড়িতে একজন উচ্চস্বরে বই পড়ত অন্যরা শুনত। আনন্দ মুখর এই সংসারে আঁধার নেমে এল মায়ের হঠাৎ মৃত্যুতে, আলটোর বয়স তখন ৮। |
অবশ্য মায়ের শূন্যস্থান বেশী দিন অপূর্ণ থাকেনি, ওদের খালা ঐ জায়গাটা গ্রহন করেছিলেন। জাইভাসকিলার গ্রামার স্কুলে পাঠ পদ্ধতি ছিল উদার, ছাত্রদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা জাগিয়ে তোলা হত। ওখান থেকে আলটো খুবভাল রেজাল্ট করে বেরিয়ে ছিলেন। পরীক্ষার পরে হাতে কলমে কাজের অভিজ্ঞতা পাবার আশায় গেলেন স্থানীয় স্থপতি সালেরভোর কাছে, ভদ্রলোকের কাছে কিছুদিন কাজ করলেও তার মন জয় করতে পারেন নি। সালেরভো তাকে উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘আর্কিটেক্ট হওয়া বাপু তোমার কম্ম নয়, লেখালেখি যখন করতেই পার, পত্রিকা অফিসে গিয়ে চেষ্টা কর, হয়ত কোনদিন সম্পাদকই হয়ে যাবে’। তার এই শ্লেষ আলটোর মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল সন্দেহ নাই, জেদী আলটো এই চ্যালেঞ্জ গ্রহন করেছিলেন, ভদ্রলোক যে ফিনল্যান্ডের জাতীয় জীবনে একটি বড় উপকার করেছেন, সন্দেহ নাই। এরপর আলটো হেলসিংকি ইনষ্টিটিউট অফ টেকনোলজীতে স্থাপত্য শিক্ষার জন্য জাইভাসকিলা ছাড়লেন। তার প্রাণবন্ত স্বভাবের জন্য সকলের পছন্দের মানুষ হয়ে উঠতে তার দেরী হলনা, মেয়েদের কাছে‘ত বটেই। এই পড়াশুনার মধ্যে লেখালেখিটা কিন্তু বন্ধ হয়নি, ডানপন্থী কোন গ্রুপের সাথে জড়িত সন্দেহে জেলও খাটতে হয়েছিল কিছুদিন। ১৯১৮ সালে গৃহযুদ্ধে তার পড়াশুনা খুবই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। যাহোক আলটো তার স্থাপত্য শিক্ষার জীবনে দুজন শিক্ষককে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন, একজন আস্কো নিস্ত্রম, স্থাপত্যের ইতিহাস পড়াতেন, অন্যজন আরমাস লিন্ডগ্রেন, যিনি সমকালীন স্থাপত্য চর্চা এবং নির্মাণ কৌশল শেখাতেন। সময়টা ছিল ফুরফুরে, চারিদিকে একটা পরিবর্তনের হাওয়া। দৃষ্টিভঙ্গী বদলাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে মানুষজন, খসে পড়ছে প্রাচীন ভারী অলংকার। হালকা হতে, চটুল হতে সংস্কার ছেড়ে যে যার মত ছোট ছোট গ্রুপে, জলসায় আড্ডায় বেছে নিচ্ছে নতুন মত, নতুন পথ। ১৯২১ সালে আলটো লেখাপড়া শেষ করেছেন, নিজের শহর জাইভাসকিলাতে কয়েকটি বাড়ী ডিজাইনও করেছেন যেগুলির নির্মাণ তখনও চলছে, অথচ আলটো স্থির করতে পারছেন না কোনদিকে ঝুঁকবেন। আর্ট এক্সিবিশন করলেন, শিল্প সমালোচক হিসাবে লেখালেখি করলেন, দু’য়েকটা স্থাপত্য প্রকল্পের সাথেও ফ্রিল্যান্স কাজ করলেন, এমনকি মিলিটারী সার্ভিসেও যোগ দিয়েছিলেন। মিলিটারী সার্ভিসের স্কুল থেকে তাকে শৃংখলা ভঙ্গের দোষে এক প্রকার তাড়িয়েই দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত তাকে সেই জাইভাসকিলাতে ফেরত যেতে হল। সেখানে গিয়েই প্রথমে শহরের সবচেয়ে দামী হোটেলের বেসমেন্টে তার ডিজাইন অফিস খুলে বসলেন, হোটেলের প্রাচীরে বড় বড় করে লিখলেন ‘ ALVAR AALTO OFFICE FOR THE ARCHITECTURE AND MONUMENTAL ART ১৯২৩ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ওটি ছিল তার ডিজাইন এবং লেখালেখির দপ্তর। তার এই প্রচারে কাজ হল, বাড়ী সংস্কার থেকে, গীর্জার পালপিট, ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন থেকে পর্দার রঙ সব ধরণের নিমন্ত্রনেই তিনি সাড়া দিচ্ছেন, আগ্রহীরাও ভীড় জমাচ্ছেন। ১৯২৩ সালে স্থপতি আইনো মারসিনোকে নিয়োগ করতে হল জমে থাকা কাজগুলিকে একটা নিয়মে বেধে ফেলার জন্য, কিন্তু নিজেও অতি সত্বর দুবছরের বড় আইনোর নিয়মের শুড়ে আটকে গেলেন, পরের বছরই বিয়ে করলেন তাকে, আইনো রসিকতা করে বলেছেন, ‘ওর কাছে আমি এত টাকা পেতাম যে, এছাড়া ওর আর বাঁচার কোন উপায় ছিল না’। আলটোর আগোছালো কাজগুলি আইনো অতিদ্রুত চমৎকারভাবে গুছিয়ে ফেললেন ডিজাইনেও সক্রিয় অংশগ্রহন করা শুরু করলেন। আলটোর সফলতার একটা বড় খুঁটি ছিলেন আইনো। আইনোর স্কেচ থেকে আলটো নিজেদের জন্যে একটা ভিলাও তৈরী করেছিলেন, ‘ভিলা ফ্লোরা’, ওখানে তাদের নগ্ন সূর্য স্নান বেশ প্রচারও পেয়েছিল। আলটো-আইনো জুটি ১৯২৫ সালে দেড় মাসের সফরে ইটালীতে হানিমুন করতে গিয়ে ইটালীর ঐতিহাসিক স্থাপত্য কীর্তিগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন, বিশেষ করে ওদের ফার্নিচার তাদের খুব পছন্দ হল, কয়েকটা কিনেও আনলেন। পরবর্তীকালে ওদের ফার্নিচার ডিজাইনে যে ইটালী ভ্রমনের যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল তা অনস্বীকার্য। ১৯২৫ সালেই ওদের কন্যা হান্নি জন্ম নেয়, আর পুত্র হামিলকার তিন বছর পর। ১৯২৬ সালে আলটো পাশের দেশ সুইডেন ও ডেনমার্কে গেলেন বেড়াতে, ওখানে গুন্নার অসপ্লান্ড এবং স্ভেন মার্কেলিয়াসের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠল। অসপ্লান্ডের সাথে তার এই বন্ধুত্ব সারা জীবন টিকে ছিল, আলটো স্টকহোমে তার স্যুট বানাতেন। ডেনমার্কের ছোট ফ্লাটগুলি তার খুব পছন্দ হয়েছিল। ১৯২৭ সালে ওরা আবার ফিনল্যান্ডের দক্ষিণ পশ্চিমে টুর্কুতে চলে গেলেন, কয়েকটা কাজ হাতে ছিল, তারমধ্যে পাইমিও যক্ষ্মা নিরাময় হাসপাতাল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই ডিজাইন করার সময়ে ওরা গাড়ী চালিয়ে সুইডেন, ডেনমার্ক, হল্যান্ড হয়ে ফ্রান্স পর্যন্ত ঘুরে এলেন। এবার তারা আধুনিক স্থাপত্য ধারার নামজাদা স্থপতিদের সাথে মেলামেশা করার সুযোগ পেলেন। বন্ধুত্বের পরিধি বিস্তারিত হল, ফ্রান্সের লী কর্ব্যুসিয়ের, জোহানেস দুইকার, সিগফ্রায়েড গাইডিয়ন, ফার্নন্ড লেগার, জার্মানীতে বাহাইস এর পুরোধা ওয়াল্টার গ্রোপিয়াস সহ আরো অনেকেই এখন বন্ধু, তাদের সাথে যোগাযোগ হয়, মত বিনিময় হয়। আধুনিক স্থাপত্য ধারার সাথে একাত্ম হলেন আলটো, যক্ষ্মা সেনেটোরিয়াম তার সাক্ষ্য বহন করছে। নিজের কর্মদক্ষতা এবং বন্ধুত্ব এই পাথেয় নিয়ে নেমেছিলেন আলটো এবং স্বনৈ স্বনৈ উন্নতিও করেছেন। এরিক ব্রিগম্যানের সাথে ১৯২৯ সালে ‘টুর্কুর ৭০০ বছর’ প্রদর্শনীর ডিজাইন করতে গিয়ে ফার্নিচার নির্মাতা অটো কোরহোনেনের সাথে পরিচয়। কাঠকে বাঁকিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করার প্রযুক্তি নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছিল, অটোর জন্য তার ডিজাইন করা একটা টুল সম্বন্ধে তিনি ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন, ‘এই টুল হাজার হাজার লোক কিনবে’, তার সেই টুল এযাবৎ লক্ষ লক্ষ লোক ব্যবহার করছে। এহেন সফলতার কারণে তার ডিজাইন করা ফার্নিচারের নামই হয়ে দাঁড়ালো ‘আলটো ফার্নিচার’। |
|
গ্লাসের ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে, তিনি প্রথাগত ফর্মের বাইরে ফিনল্যান্ডের ভূপ্রকৃতির আদলে প্যারিস প্রদর্শনীর জন্য একটি ভাস বানালেন, যা আজও ‘স্যাভয় ভাস’ নামে সারা বিশ্বে আদৃত। ফিনল্যান্ডের মানুষ এই ডিজাইনটিতে তাদের জাতীয়তা প্রকাশিত হয়েছে বলে মনে করে, বিদেশী অতিথিদের উপহার দিতেও পছন্দ করে। এসব নতুন ফর্মের আবিষ্কার প্রসঙ্গে আলটো বলেছেন, ‘খুব চেষ্টা করলেই যে একটা নতুন ফর্ম পাওয়া যাবে তা নয়, যার জন্য ফর্ম খোঁজা হচ্ছে, তাকে জানতে হবে গভীরভাবে তাহলে এক পর্যায়ে বিষয়ের এবং ফর্মের একটা ঐক্য সূত্র বের হয়ে আসবে, সেই সূত্র ধরে এগুলে একটা যথার্থ ফর্ম তৈরী হতে পারে।’ ১৯৩৩ সালে আলটো-আইনো দক্ষিণ-পূর্ব ফিনল্যান্ডের ভাইপুরীতে একটা লাইব্রেরীর কাজ করবার জন্য হেলসিংকির কাছে একটা দ্বীপে বসবাস শুরু করলেন। ভাইপুরী এখন রাশিয়ার অংশ। এখানে তারা বাড়ীর একটা অংশকেই অফিস বানিয়ে ফেললেন। এখানে থাকতেই ১৯৩৫ সালে, মেইরী গুলিখসেন এবং নিলস গুস্তাভ হাল এর সাথে মিলে তারা একটা ফার্নিচার নির্মাতা কোম্পানী খুললেন, নাম হল ‘আর্টেক’। |
এই কোম্পানীর মূল কাজই ছিল আলটোর ডিজাইন করা ফার্নিচার বিক্রী করা। যক্ষ্মা হাসপাতাল এবং ভাইপুরী লাইব্রেরীতে সব ফানিচার্র এই কোম্পানী সাপ্লাই দিয়েছিল, পরে ওরা যখন যুক্তরাষ্ট্রে MIT তে বেকার হোস্টেল ডিজাইন করলেন সেখানেও ওদের ডিজাইন করা ফার্নিচার নিয়ে হাজির হল ‘আর্টেক’। ‘আর্টেক’ প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরই ওরা আবার ইউরোপ ভ্রমনে গেলেন, এবার লন্ডনেও। তখন প্যারিসের আর্ন্তজাতিক ফেয়ারে তার ডিজাইন করা ‘ফিনিশ প্যাভেলিয়ন’ এর কাজ শেষ। নিউইয়র্কের প্যাভেলিয়ন ডিজাইন করার পালা। তার গ্লাসের পাত্রগুলি খুবই বাজার পেয়েছে। আঁকা বাঁকা আকৃতির ‘স্যাভয় ভাস’ তার মাথায় গেঁথে গেছে, বেশ কটি ভবনে তার এই ফর্ম, কখনো সিলিং কখনও পার্টিশান দেয়াল। এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি, ‘মানুষের চারপাশে যা কিছু থাকে তার একটা প্রতীকি মূল্য আছে, মানুষের শরীর যেমন হাড়ের কাঠামো, তার সাথে নমনীয় ভাবে মাংস পেশীগুলি জোড়া থাকে, এদের সম্মিলনেই আমরা জীবন পাই, অন্যান্য জীবের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই, চলমান জীবনে এই ঐক্য না হলে সে চলতে পারবে না, বাড়ীর ক্ষেত্রেও তাই, পারিপার্শ্বিক থেকে তাকে উপাদান নিতে হবে, যা মূল কাঠামোর উপযোগীতার জন্য কার্যকর।’ ১৯৩৮ সালে অসলোতে ‘নর্ডিক আর্কিটেকচারাল কনফারেন্সে ভাষন দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, প্রকৃতি হল সবচেয়ে বড় প্রমিতকারী কমিটি (standardisation committee), ক্ষুদ্রতম কোষের মধ্যেও জীবনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রতিটি উপাদানের প্রমিতি রয়েছে এবং তার মধ্যেই রয়েছে কতনা বৈচিত্র্য, কতনা সম্ভাবনা, স্থাপত্যের প্রমিতির জন্য আমাদেরও ঐ রকমের মনোভাব দেখাতে হবে।’ |
১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে তারা নিউইয়র্ক প্যাভেলিয়ন করেছেন, অসাধারণ সাফল্য এসেছে, সেমিনারে বক্তব্য রেখেছেন, ওদের কাজের প্রদর্শনী হয়েছে ‘ মিউজিয়াম অফ মর্ডান আর্ট-এ। ২য় সফরে তাদের সঙ্গী ছিলেন ভিলা মেইরীর মালিক, তাদের বাড়ীটি তখন সদ্য নির্মিত হয়েছে। আমেরিকা জানল বিশ্ব স্থাপত্যের এই নতুন নক্ষত্রকে। ২য় মহাযুদ্ধের শুরুতে আলটো যুদ্ধে যোগ দেয়া না দেয়া নিয়ে নিজ দেশে ঝামেলায় পড়েন, অনর্থক যুদ্ধকে তিনি সমর্থন করতেন না এবং এসব নিয়ে বিদেশে বক্তৃতাও করেছেন। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের ডামাডোলে তার ভূমিকা বিভিন্ন মহলে নানামূখী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া সক্ষম পুরুষদের জন্য ওদেশে বাধ্যতামূলক ছিল। যাহোক শেষ পর্যন্ত আলটোকে যোগ দিতে হয় নি। ১৯৪৩ সালে আলটো ফিনল্যান্ডের স্থপতিদের এসোসিয়েশনের (SAFA) সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৮ সাল অবধি এই পদে আসীন ছিলেন। তাদের এসোসিয়েশনের একটি দল এই যুদ্ধের মধ্যে জার্মানীতে গিয়েছিল প্রমিতকরণের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য এবং সেখানে গিয়ে গেস্টাপোদের কারাগারে বন্দী স্থপতি নীল কোপেনকে মুক্ত করেন, পরবর্তীকালে কোপেন তার সাথে কাজ করতেন। যুদ্ধের পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের MIT তে কয়েকবছর শিক্ষকতা করেন। ওখানে তিনি ছাত্রদের জন্য একটি হোস্টেল (বেকার হাউস) ডিজাইন করলেন। এখানে ফার্নিচারগুলি সাপ্লাই দিয়েছিল ওদেরই প্রতিষ্ঠান আর্টেক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জীবন তাদের ভাল লাগেনি, কৃত্রিমতায় ঘেরা, গভীরতা নেই। ১৯৪৮ সালে তাই দেশে ফিরে এলেন, কিন্তু এই প্রত্যাবর্তন সুখের হল না। তার জীবনের সুখের ভোমরা আইনো মারা গেলেন অল্প দিনের মধ্যেই। আলটো যেন দিশেহারা হয়ে পড়লেন। মদ আর ভ্রমনে সময় পার হতে লাগল, কাজকর্ম সব শিকেয় উঠল। এমনও হয়েছে যে, প্যারিসে তার নিজের সকল কাজের প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতেও তিনি ভুলে গেলেন। ১৯৫০ থেকে ৫২, এই সময়ে তিনি সাইনেটসালো টাউন হল ডিজাইন করছিলেন, এলিসা মাকিনিয়েমি নামে এক তরুনী স্থপতি তার সাথে এরমধ্যে যোগ দিয়েছিলেন, ৫২ সালে তারা বিয়ে করলেন, আবার শুরু হল নতুন জীবন। আসলে জীবনে কোন কিছুই স্থায়ী নয়, না সুখ না দুঃখ। এরপর থেকে আলটো কিন্তু বড় বড় সব কাজ করেছেন, সম্মানও পেয়েছেন। ফিনিশ একাডেমীর মেম্বার হলেন ১৯৫৫ সালে, ১৯৬৩ তে সভাপতি। ফিনল্যান্ডের সর্বোচ্চ একাডেমিক সার্কেল এই একাডেমী, অনেকটা বৃটিশ রয়েল কলেজের মত। এরপরের কয়েকটি বছর তার প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কেটেছে, কাজ আর কাজ, কোনটাই ছোট নয়। সমগ্র ইউরোপের জন্য আলটো ডিজাইন করছেন, বন্ধুদের বাড়ী, গীর্জা, কনভেনশন হল, মিউজিয়াম, ইউনিভার্সিটি, হাউজিং এস্টেট, অগুনতি। সবাই তাকে চায়। ইরানের শাহ পাহলভীর স্ত্রী ফারাহ দিবাও (নিজে একজন স্থপতি ছিলেন) তাকে একটা মিউজিয়াম ডিজাইন করতে দিয়েছিলেন, যদিও ডিজাইন বেশীদূর শেষ পর্যন্ত এগুতে পারেনি। এমনকি আমাদের বাংলাদেশের সংসদ ভবন ডিজাইনের জন্যও তাকে আহবান করা হয়েছিল, ব্যস্ততার কারণে আলটো সেই কাজ নেন নি। জীবনের শেষ অংশে এসে তিনি অনেক ডিজাইন করেছেন, তাদের বেশীরভাগই তার জীবনদ্দশায় নির্মিত হয়নি। |
আধুনিক স্থাপত্যের এই নন্দিত পুরুষ ১৯৭৬ সালের ১১ই মে পরলোক গমন করেন, তাকে তার প্রিয় পত্নী আইনোর পাশে শুইয়ে দেয়া হয়। তার দ্বিতীয় স্ত্রী এলিসা ১৯৯৪ সালে মারা গেলে তাকেও আলটোর পাশে সমাহিত করা হয়। তার দীর্ঘ জীবনে, তিনি আধুনিক স্থাপত্য ধারাকে অন্য একটা মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন, বিল্ডিং এর ফর্ম কোন কঠোর নিয়ম মানতে বাধ্য নয়, প্রয়োজন ভেদে, পরিবেশভেদে তা পরিবর্তন হতে পারে। তার সময়ে স্থপতিরা বিল্ডিং এর সাথে সাথে ফার্নিচারসহ তার অদ্যোপান্ত ডিজাইন করতেন, তিনিও করেছেন, কিন্তু তা করতে গিয়ে একগুয়েমীকে প্রশ্রয় দেন নি। বরং তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘ মানুষের জীবনের সব কিছু স্থাপত্য ধারণ করতে পারে না, তাই নিয়মকানুন শীথিল রাখতে হবে যাতে আরও নতুনের জন্ম নেবার সুযোগ থাকে। যদি তা না করা হয় তাহলে স্থাপত্য একপেশে সিদ্ধান্তের ফসল হয়ে দাঁড়াবে।’ ‘ Form follows function’ আধুনিক স্থাপত্য ধারার এই মূলভাবনার সাথে একমত হয়েও তিনি চারিদিকে কঠোরতার দেয়াল টেনে দেননি, নিয়ত পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছেন, প্রকৃতিকে আত্মস্থ করে তার ত্রিমাত্রিক সৃষ্টিতে নবরূপে প্রকাশিত করতে চেয়েছেন। আমাদের স্থাপত্যে প্রকৃতির ঘাড়ে চেপে বসার যে অপসংস্কৃতি চর্চা চলছে তা থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে এই মহান স্থপতির কাছ থেকে আমাদের দীক্ষা নেবার প্রয়োজন রয়েছে। |
|
|
সমগ্র কমপ্লেক্সটির মাঝামাঝি জায়গায় প্রধান প্রবেশ মুখ, সেখান থেকে এগিয়ে জমির উচুঁ নীচু স্থান ও প্রকৃতি ভেদে ভবনের একেকটা অংশ একেকটা কৌনিক অবস্থান গ্রহন করেছে। একদিকে বিল্ডিং যেমন দৃঢ়ভাবে প্রকৃতির উপর নিজের আধিপত্য ঘোষণা করছে, অন্যদিকে জমির প্রাকৃতিক লে-আউটও সে অনুসরণ করছে। যক্ষ্মা রোগীদের উপর ব্যাপক রিসার্চ চালিয়েছেন আলটো। তাদের ওয়ার্ডগুলি গরম থাকতে হবে, রোগীরা শুয়ে থাকলে সরাসরি সূর্যের আলো পছন্দ করে না, আবার রোদ পোহানোর জন্য, হাটাহাটি করার জন্য দীর্ঘ করিডোর চাই। এমনকি তাদের শ্বাস নিতে কষ্ট হয় বলে বিশেষ আরাম চেয়ারও (পাইমিও চেয়ার নামে খ্যাত) ডিজাইন করেছেন। রঙ ব্যবহার করেছেন অনেক, রোগীদের ওয়ার্ডে হালকা রঙ অথচ পাবলিক স্পেসে উজ্জ্বল লাল রঙের বাহার। উপরে ডেকের মত দীর্ঘ পরিসর, রোগীরা শুয়ে শুয়ে প্রকৃতির শোভা দেখতে পায়। |
|
বলা বাহুল্য, আধুনিক স্থাপত্য ধারার এই সফল উপস্থাপন তৎকালীন ইউরোপে তখনও খুব বেশী ঘটেনি, এই ভবনটি তাকে আর্ন্তজাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছিল।যক্ষ্মার প্রকোপ কমে গেলে এই স্যানাটোরিয়ামকে সাধারণ হাসপাতালে পরিবর্তীত করা হয়, হাসপাতালের জন্য আরও কিছু সংযোজন করা হয়, সমগ্র ভবনটির চেহারাও অনেকটা বদলে যায়। কিন্তু এক সময়ে ফিনল্যান্ড যে যক্ষ্মা আক্রান্ত হয়েছিল এবং সে উপলক্ষে তাদের স্থাপত্যের প্রাণ পুরুষ যে ডিজাইন করেছিলেন, তা ধরে রাখার জন্য অনেক কিছুই আগের মত রাখা হয়েছে। জাতি হিসাবে ফিনল্যান্ডের মানুষরা যে সম্মান ধরে রাখতে পছন্দ করে এই আচরনই তার প্রমাণ। |
|
|
একটা পাহাড়ী জায়গার কিছুটা হালকা ঢালু জমিতে চারিদিকে গাছ -গাছালীর মাঝখানে এই ভিলা। দূর থেকে গাছের ফাঁকে চোখে পড়বে একটা আধুনিক বাড়ীর সাদামাটা প্রচ্ছদ, কাছে গেলে দেখা যাবে প্রচুর ডিটেইল। বাইরে থেকে ভিতরে অথবা ভিতর থেকে বাইরের এই ক্রম পট পরিবর্তন আলটোর চিন্তাধারার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট। বাড়ীতে ঢুকেই উপরতলায় যাওয়ার যে কাঠের সিড়িটি চোখে পড়বে তার দুপাশ একগুচ্ছ গাছ সদৃশ কাঠ দিয়ে সাজানো যেন বাইরের গাছগুলির প্রতিরূপ। বাড়ীর ভিতরের আবহ বাইরের প্রকৃতির বিপরীত নয়। নীচতলায় অতিথি অভ্যর্থনার আয়োজন, খাবার ঘর, রান্নাঘর, বসার লাউঞ্জ এবং অনূচ্চ পাথুরে দেয়াল ঘেরা লন তার এককোনে সুইমিং পুল এবং সাউনা (স্টীম বাথ নেবার ঘর)। প্রসঙ্গত পাঠককে স্মরন করিয়ে দিতে চাই ফিনল্যান্ড ভীষন রকমের শীতের দেশ, শীতকালে -১৫ ডিগ্রী সে. থেকে -২০ ডিগ্রী সে. তাপমাত্রায় চলে যায় আকচার। স্টীম বাথ তাই আদীকাল থেকেই ওদের সংস্কৃতির অঙ্গ। ফিনল্যান্ডের এই সাউনা পরবর্তীকালে ইউরোপের মাধ্যমে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়েছে। |
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে মাষ্টার বেড এবং অন্যান্য গেস্টরুম। মাস্টার বেডরুমের সাথে রয়েছে ডেক এবং গেস্টরুমগুলো থেকে বের হয়ে আসা জানালা। ঢালু ছাদের উপরে মাটি ভরাট করে ঘাস জন্মানোর ব্যবস্থা। প্রকৃতির সাথে বিরুদ্ধতা নয় বরং তার সাথে বসবাস করার ক্ষুদ্রতম সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা। আলো প্রবেশ এবং নিসর্গের সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য প্রচুর কাঁচের দেয়াল। প্রতিটি স্পেসের কার্যকারীতা সঠিকভাবে বজায় রয়েছে। ঘরের ভিতরের প্রয়োজনীয় চাহিদা এবং বাইরের পরিবেশের সমন্বয় ঘটাতে আলটো কোন জটিলতা সৃষ্টি করেননি, যথেষ্ট সহজ উপস্থাপনা। এই সহজ সৃষ্টি প্রকৃতির সাথে চলার আবেগ প্রসূত, বাড়ীটিতে যারা থাকবেন তাদের জন্য রয়েছে প্রকৃতির চিরন্তন আবাহন। |
ফিনিশ প্যাভেলিয়ন (১৯৩৮-৩৯)
|
আলটো এবং তার স্ত্রী আইনো দুজনেই এই কাজটির জন্য প্রতিযোগীতায় অবতীর্ন হয়েছিলেন। আলটো দুটি এবং আইনো একটি ডিজাইন জমা দিয়েছিলেন এবং তাদের ডিজাইনই যথাক্রমে ১ম, ২য় ও ৩য় নির্বাচিত হয়েছিল। আলটোর এই প্যাভেলিয়নটি এখন আর নেই কিন্তু আলটো তার সমকালীনদের চেয়ে কতটা অগ্রসর এবং ব্যতিক্রমী ছিলেন তা বুঝতে এই প্যাভেলিয়নের ডিজাইনটি শিল্প রসিকরা উদাহরণ দেখিয়ে থাকেন। নিউইয়র্কের এই প্যাভেলিয়নটির দুবছর আগে আলটো প্যারিসে ‘ওয়ার্ল্ড ফেয়ার’এ আরেকটি সুযোগ গ্রহন করেছিলেন। সমকালীন ফিনল্যান্ডের স্থাপত্য ও শিল্পের সাথে ইউরোপের সংস্কৃতি রাজধানীর মানুষদের পরিচয় ঘটানোর একটি সফল প্রচেষ্টা। স্থান নির্বাচন আলটোর পছন্দ হয়নি, ডিজাইনে নিজে পুরোমাত্রায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এই সুযোগটিকে তাই তিনি পুরোমাত্রায় ব্যবহার করেছেন। প্যারিসের প্রদর্শনীতে তিনি জোর দিয়েছিলেন তার দেশের আধুনিক সংস্কৃতির উপর, ফিনল্যান্ডের একটা সামগ্রীক পরিচয় তুলে ধরা যায়নি, এবার নিউইয়র্কে তিনি দেখালেন তার দেশের প্রকৃতি, ইতিহাস এবং তার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি। তার কথায়, ‘আমি এমন একটি ফিনল্যান্ড প্যাভেলিয়নের কথা ভেবেছি যা আমাদের সাংস্কৃতিক, ব্যবহারিক এবং চেতনাগত ভাবধারাগুলি সমন্বয় করে একটি একক দৃশ্যের অবতারণা করবে। এই প্রদর্শনীটি সাধারন ব্যবসা আশ্রয়ী ‘ফেয়ার’ নয়। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, এমন একটি সমন্বিত বস্তুগত এবং সাংস্কৃতিক অভীধা নিশ্চয়ই কোনরকমভাবে আয়োজন করা ‘ট্রেড ফেয়ার’ থেকে বেশী কার্যকরী।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘এই ঐক্য প্রচেষ্টা একটি খেয়ালী নান্দনিক ভাবনা নয়, এর মর্মে একটি সঙ্গীত আছে যা প্রকাশিত হয়েছে কাঠামোর তরঙ্গায়িত উপস্থাপনায়, এই স্থির তরঙ্গ আমাদের কল্পনাকে আকর্ষণ করে তার দৃষ্টব্যের দিকে ঠেলে দিবে, আমাদের মনোজগতে নতুন একটি প্রভাব বিস্তার করবে।’ |
একটি বাক্স সদৃশ কাঠামো, বাইরে বাশ বনের মত করে খাড়া কাঠের লাইন, প্রবেশ মুখে কিছু কাচের ব্যবহার, এই সাদামাটা অথচ ইংগীতবহ প্রচ্ছদ তিনি ওই প্যাভেলিয়নের জন্য যথেষ্ট মনে করেছিলেন। কিন্তু ভিতরে ঢুকলেই ফিনল্যান্ড একটা অভূতপূর্ব জৌলুস নিয়ে প্রদর্শনীর ডালা সাজিয়ে বসে আছে। একটা সর্পিল পার্টিশান ছাদ থেকে বাক্সের কোনাকুনি ঝুলিয়ে স্পেসটিকে দু ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই সর্পিল পার্টিশানটি এই প্যাভেলিয়নের সবচেয়ে আকর্ষনীয় উপাদান। ফিনল্যান্ডের ভুপ্রকৃতির রূপকল্প হিসাবে এই ঝুলন্ত হেলানো দেয়ালটি আবার তিনটি স্তরে সাজানো। এর গায়ে বাঁশের সারির মত কাঠ তার মাঝে কিছু ছবি। আলো জ্বললে পিছন থেকে আলো এসে কতগুলি লাইনের মত মনে হয়। প্যাভেলিয়নটির উচ্চতা বেশী থাকায় দুইপাশ মেজেনাইন ফ্লোর করে, একপাশে একটা ক্যাফে এবং অন্যপাশে অর্থাৎ সর্পিল পার্টিশানের পেছনে প্রদর্শনীর স্পেস। ক্যাফের একপ্রান্তে ফিল্ম প্রদর্শনীর জন্য একটা স্ক্রীন এবং সেটি একটি অপ্রচলিত আকৃতির ডেবে যাওয়া দেয়ালের মধ্যে। ঐ ডেবে যাওয়া জায়গাটিতে কেউ দাঁড়িয়ে অনায়াসে ক্যাফেতে বসা মানুষদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে পারবে। আলটোর এই প্যাভেলিয়ন নিয়ে বিদগ্ধ মহলে এত হৈ চৈ এর কারণ বর্তমানের একজন পাঠকের পক্ষে অনুধাবন করা হয়ত কঠিন, মনে রাখতে হবে যখন তিনি এসব বিচিত্র ফর্ম নিয়ে এসেছেন সেটি ১৯৩৮ সাল। স্থাপত্য তখন চলত নিয়মের কঠোর অনুশাসন মেনে। প্রকৃতির উপর বলদর্পে দাঁড়িয়ে থাকত প্রাসাদভবন এবং তার চারিপাশে বাগান তৈরী হত প্রাসাদের সেবক হিসেবে। সেই প্রকৃতিকে স্থাপত্যের ফর্মে রূপায়িত করার এমন প্রয়াস ছিল অবান্তর। |
বেকার হাউস (১৯৪৭-১৯৪৯)
|
সাইনেটসালো টাউনহল (১৯৪৯-১৯৫২)
|
প্রথমেই বলতে হবে ঐ উচু উঠোনটির কথা, এর চারপাশ ঘিরে লাইব্রেরী, অফিস এবং কর্মচারীদের এপার্টমেন্ট ব্লক গুলো স্বকীয়তা বজায় রেখেও একটি বিল্ডিং এর অংশ হিসাবে সাজানো হয়েছে। গ্রীক-রোমান সভ্যতায় নাগরিকদের সম্মেলনের স্থান ছিল আগোরা এবং ফোরাম। মুক্ত মানসে মেলামেশার প্রতিরূপ তার এই উঠান, উচু করা হয়েছে মানসিক প্রস্তুতির জন্য, রাস্তার কোলাহল থেকে মুক্ত করার জন্য। স্পেসকে বড় করার জন্য কাউন্সিল হলের ছাদ অনেক উচু (১৭ মি.) করেছেন যেখানে নাগরিকদের মতবিনিময় হবে। উঠানের ছাদ আকাশ আর কাউন্সিল হলের ছাদও তিনতলা সমান উচু। বরফের দেশ, উঠান’ত শীতকালে বরফে ঢাকা থাকবে, তাই কাউন্সিল হলের ছাদটি হয়ত তিনি যথাসম্ভব উচু করেছেন একটা মানসিক সমসূত্র বজায় রাখার জন্য। আলটোর ডিজাইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল স্কেল, অর্থাৎ ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তার আলোকে প্রতিটি স্পেসের আকার নির্ধারণ করা। স্থপতিরা জানেন এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভবনের কাঠামো এবং কাঠামোর সাজুয্য বজায় রাখতে গিয়ে স্পেসের সঠিক উপস্থাপন সম্ভব হয় না। মানুষের দৈহিক মাপ থেকে স্থাপত্যের মডিউল নির্ধারনের ইতিহাস অনেক পুরানো, আধুনিক স্থাপত্যে লী কর্ব্যুসিয়ের এক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা করেছেন। দেহের মাপের সাথে মানসিক চাহিদা এক কথায় ব্যবহারিক ও নান্দনিক চাহিদার সমন্বয় করে যখন স্কেল নির্ধারণ করতে হয় তখনই স্থপতির ক্ষমতার আভাস পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ভবনটির যেসব অংশ নিতান্তই কেজো, সেগুলিকে নীচতলায় অর্থাৎ রাস্তার লেভেলেই রাখা হয়েছে এবং তাদের পরিসরের আকার আকৃতিও মানানসই। যেমন, দোকান, ব্যাংক, ফার্মেসী ইত্যাদি। আবার যেসব অংশে উচ্চতা চাই, খোলা আকাশ চাই, নিসর্গের অনুভূতি চাই, সেগুলি উপরে এবং তাদের উচ্চতায় তারতম্য রয়েছে। আবার এই নানা ধরনের পরিসরের মধ্যে কাঠামোগত ঐক্য বজায় রাখার জন্য প্রবেশ মুখগুলো বড়, উচু ইত্যাদি নানাভাবে সংকুলান করেছেন।বিল্ডিং এর কাঠামো আধুনিক স্থাপত্য ধারায়, কলাম এবং স্লাবের সাথে তিনি ইটের দেয়াল ব্যবহার করেছেন সস্তা ইট যার মাপের ঠিক নাই, একই মাত্রায় পোড়ানো হয়নি। দেয়াল গাঁথায় বাইরের দিকে যে অমসৃনতা এসেছে তাকে তিনি স্বাগত জানিয়েছেন। |
|
হেলসিংকি ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (১৯৪৯-১৯৭৪)
|
প্রচন্ড শীতের দেশ ফিনল্যান্ড, খোলা বাতাস নয় নিয়ন্ত্রিত বায়ু-প্রবাহই কাম্য। করিডোর এই কমপ্লেক্সে একটি মূলভূমিকা নিয়েছে। সেন্ট্রাল লাইব্রেরী এবং ক্যাফে পশ্চিম প্রান্তে রাস্তা থেকে মুল ক্যাম্পাসটিকে আড়াল করে রেখেছে। প্লানটি লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে শেষ প্রান্তে অর্থাৎ স্থাপত্য ডিপার্টমেন্টে পৌঁছুতে অনেকটা পথ হাটতে হয়। লাইব্রেরীকে সামনের দিকে রাখা হয়েছে সকলের জন্য কাছাকাছি রাখার উদ্দেশ্যে। স্থাপত্য বিভাগের প্রতি আলটোর স্বাভাবিক পক্ষপাতিত্ব রয়েছে, সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য এখান থেকে দেখা সম্ভব। আলটোর বহু ব্যবহৃত কনক্রীট কলাম, স্লাব এবং ইটের দেয়ালের কাঠামোর সাথে এখানে বিভিন্ন জায়গায় যোগ হয়েছে মেটাল ছাদ। প্লাষ্টার বিহীন ইটের অমসৃন গাঁথুনি এবং বড় বড় কাচের জানালা এখানেও উপস্থিত। ফিনল্যান্ডের ভূ-প্রকৃতি অনুসারী তার সেই সর্পিল অবয়ব দেবার চেষ্টা এখানে অনুপস্থিত। শিক্ষাকে আলটো সব সময়ই সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন। গ্রীক এক্রোপলিস থাকত পাহাড়ের উপরে, দেবতার অধীষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে তিনি আরাধনার পর্যায়ে কল্পনা করেছেন, এক্রোপলিসের মত সবচেয়ে উচু জায়গায় বসিয়েছেন একাডেমিক ভবন, সেখানেই সবাই প্রথম আসছে, দেখছে তার সাজানো প্লাজা, কলামের সারি, গ্রীক-রোমান ভাবধারার প্রতিফলন। ‘প্রকৃতির মাঝখানে বসিয়ে, ভূপ্রকৃতির অনুসারী নয়, প্রযুক্তি প্রকৃতিকে শাসন করবার জন্যে,’ হয়ত এই উপলব্ধি তাকে এই এক্রোপলিস সদৃশ পরিকল্পনায় উদ্বুদ্ধ করে থাকবে। এই প্রকল্পের ডিজাইনকালেই তার প্রিয়তমা পত্নী আইনো মারা যান, আলটো এই প্রকল্পের প্রতি প্রচন্ড আবেগাপলুত হয়ে পড়েন, প্রকল্পের সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, ‘ Ave alma mater, morituri te salutant’ অর্থাৎ মহান শিক্ষার পাদপীঠ, মৃত্যুপথযাত্রীর সালাম গ্রহন কর। |
সামার হাউস (১৯৫২-১৯৫৪)
|
ছোট শহর, বন আর হ্রদের ঐশ্বর্য্যে গর্বিত এর নাগরিকদের প্রধান আকর্ষন ছিল শিক্ষা এবং অবসর সময়ে নৌকা বিহার। বিশ্ববিখ্যাত স্থপতির জন্য নিরিবিলি কিছু পুরানো বিষয়কে নাড়াচাড়া করার প্রকৃত পরিবেশ বটে। প্লটটির গা ঘেষে যে পাথুরে উচুঁ জমিটি ছিল তার উপরে তিনি এই বাড়ীর প্রধান অংশটি রাখলেন। বাকী সব ছোট ছোট ঘর এবং অন্যান্য আয়োজন লেজের মত হৃদের সামনে একটু খালি জায়গা রেখে এগিয়ে গেছে। উঁচু উঁচু গাছের মাঝে উকিঁ দিচ্ছে সাদা রঙ করা বাড়ীটি। ভিলা মেইরীর মত এখানেও রয়েছে সেই আভ্যন্তরীন উঠোন এবং তাকে ঘিরেই বসার, খাওয়ার, রান্নার, শোবার ঘর। পিছনে একটা দরজা দিয়ে পরে বানানো গেস্ট হাউস জোড়া লেগেছে। পুরা বাড়ীটি লাল ইটে তৈরী কিন্তু বাইরের দিকে ইটের উপর সরাসরি সাদা রঙ করা, ছাদ কিন্তু মেটাল এবং উঠোনের দিকে ঢালু। উচু উচু খাড়া গাছের গুড়ির সাথে সাযুজ্য রাখতে বোধকরি উঠোনের বাইরের দেয়ালে কতগুলি খাড়া ল্যুভার দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, ব্যস ঐ পর্যন্তই আর কোন আড়ম্বর নেই। |
ভিতরে উঠোনের চারপাশে কিন্তু ইটের লাল রঙের নানা শেডের বাহার। ইটের নানা ধরনের গাঁথুনির পরীক্ষা চলেছে এখানে। আলটোর কাঠের মুলিয়নসহ বড় বড় কাচের জানালা এখানেও উপস্থিত, আলোর প্রাচুর্য ছাড়া কোন কিছুই কল্পনা করতে পারতেন না এই আলোকিত মানুষটি। লেকের দিকে উঠোনের মুখটি খোলা যাতে বসার ঘর থেকে লেক দেখা যায়। বাড়ীর ভিতরে যথারীতি কাঠের ফ্রেমে দোতলা এবং কাঠের ফার্নিচার। প্রশ্ন উঠতে পারে, নতুন কি পরীক্ষা হল এখানে, আলটো তার উত্তর দিয়েছেন একটু ঘুরিয়ে, ‘যা কিছু অতীত হয়ে যায়, তা আর ফেরত আসে না, কিন্তু তার রেশ থাকে। ঐ রেশটাই নতুনের ভিতরে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে।’ |
নতুনের দাপটে পুরানোকে একদম ঝেড়ে ফেলতে আগ্রহী নন আলটো, তাই নতুনের মধ্যে পুরানো যা কিছু ভাল তাকে কেমন করে মানিয়ে নেবেন তারই অনুশীলন করেছেন এখানে। প্রসঙ্গত বলতে হয়, তার সময়ে আধুনিক শিল্পধারার স্থাপত্যের জয় জয়কার, বিল্ডিং উপাদান হবে মেশিনে তৈরী তাই কোন বাহুল্য থাকবে না, যত বেশী শিল্পজাত সামগ্রী ব্যবহার করা যায় ততই আধুনিক হবে এবং আলটো নিজেও এই ধারার একজন প্রবক্তা। কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ তার বাসস্থান নিয়ে যে চর্চা চালিয়ে এসেছে তা হঠাৎ করে মূল্যহীন হয়ে যায় কি ? আলটোর বিশেষত্ব এখানেই, তিনি আধুনিক, তিনি প্রযুক্তির সর্বোত্তম প্রয়োগ চান, কিন্তু প্রকৃতির সাথে বিরোধীতার মাধ্যমে নয়, গন মানুষের মধ্যে যে স্থাপত্য সংস্কৃতি বিরাজমান তাকে উল্টে দিতে তিনি মোটেই আগ্রহী নন। |
থ্রী ক্রস চার্চ (১৯৫৫-১৯৫৮)
|
চার্চের হলরুমকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় আবার মাঝখানে পার্টিশান সরিয়ে একত্রে ব্যবহারও করা যায়। দেয়ালগুলি খাড়া তারপর স্টীল ও কপারের দেয়াল এবং ছাদ। ওই উপরের অংশেই যত জানালা, কোন জানালার আকৃতি অন্যটির মত নয়, ছাদ অনিয়মিত ভল্টের মত, অর্থাৎ আকৃতিটি অনেকটা শামুকের মত, নানাদিক থেকে কখনও চেপে কখনও বা ফুলে উঠেছে। কনক্রীটের কলাম ঘুরে গিয়ে বীম হয়েছে, সেগুলি স্পেসের মধ্যে ভাগাভাগির নির্দেশকও বটে। ছাদের এই অনিয়ম তিনি করেছে শব্দের প্রতিফলনের জন্য। জানালা উচুঁতে এবং হেলানো থাকায় আলোর প্রাচুর্য রয়েছে। |
সামগ্রীকভাবে গীর্জাটি সাদামাটা, ইউরোপের গীর্জাগুলিতে যে ঐশ্বর্যের প্রদর্শনী থাকে তার ছিঁটেফোটাও এখানে নেই। ‘গীর্জা না হয়ে একটা কমিউনিটি হলও হতে পারত’ এমন একটা ভাব। আলটোর পরিণত বয়সের প্রকল্প এটি, এসময়ে তার চিন্তাধারায় কুশলতার চেয়ে দার্শনিকতা বেশী, চার্চকে সামাজিক প্রতিষ্ঠান হতে হবে, জৌলুস দেখিয়ে মানুষের মনকে কাছে টানা যায় না, তাই বাহুল্য প্রয়োজন নাই। ভবনের স্থাপত্যে আকৃতির যে বৈচিত্র, অভ্যন্তরে আলোর প্রাচুর্য এবং স্পেসের বহুমুখী ব্যবহারে যে আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে তাকেই তিনি যথেষ্ট মনে করেছেন। গীর্জার জন্য বেদী, ক্রশ, পিয়ানো বাদকদের জন্য প্লাটফর্ম, কোন কিছুতেই আতিশয্য নেই। পার্টিশান দেয়াল সরানোর জন্য যে প্রযুক্তির অবতারনা করেছেন তা শিল্প শহরের মানুষের কাছে আগ্রহের বিষয় হবে বলে ভেবেছেন তিনি। আজকের দুনিয়ায় উপাসনালয় বা সামাজিক সম্মিলনের জায়গাগুলি যেভাবে প্রাচুর্য প্রদর্শনীর আধার হিসাবে তৈরী হচ্ছে সেই দৃষ্টিতে দেখলে আলটোর সৃষ্টির মর্মে পৌঁছানো সম্ভব নয়, তার পরিচয় ফিনল্যান্ডীয় সারল্যে, নির্লোভ অথচ নতুন সৃষ্টির নিয়ত প্রচেষ্টায়। |