প্রকল্পের নাম: বড়াল বিদ্যা নিকেতন অবস্থান: কুমারগাড়া, চাটমোহর, পাবনা ক্লায়েন্ট: বড়াল বিদ্যা নিকেতন মোট নির্মিত এলাকা: ৩১৯ বর্গমিটার প্রকল্প শুরুর সময়: মার্চ ২০২৩ প্রকল্প সমাপ্তির সময়: ডিসেম্বর ২০২৩ মোট খরচ: ১ কোটি ৬৮ লাখ স্থাপত্য ডিজাইন টিম: স্থপতি ইকবাল হাবিব (দলনেতা), স্থপতি ইশতিয়াক জহির তিতাস, স্থপতি শারনাজ পারভীন কাঠামো নকশা: স্পেস ডিজাইন কনসোর্টিয়াম, আই-বিল্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ও কনস্ট্রাকশন বৈদ্যুতিক নকশা: ভিত্তি স্থপতি বৃন্দ লিমিটেড ফটোগ্রাফার: ওয়াসিক ইদাফ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: ‘আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস’ হতে পুরস্কারপ্রাপ্ত |
প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দারা যেখানে প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যতার সঙ্গে লড়াই করে বাঁচে, সেখানে শিশুদের জন্য একটি নান্দনিক এবং পরিবেশবান্ধব বিদ্যালয় গড়ে তোলা একটি চ্যালেঞ্জের পর্যায়ে পড়ে। পাবনার চাটমোহর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম কুমারগাড়া। এই গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বড়াল নদটি দখল-দূষণে মৃতপ্রায়। নদী রক্ষা আন্দোলনের অংশ হিসেবে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় এই বিদ্যালয়টি। তাই নদীর নামানুসারে বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয়েছে ‘বড়াল বিদ্যা নিকেতন’। |
ছবি: পাখির চোখে বড়াল বিদ্যা নিকেতন |
ছবি: প্রকল্পের ধারণা |
এই প্রকল্পের গল্পের শুরু এক আন্দোলনের মাধ্যমে। স্থানীয় কৃষক আর মৎস্যজীবীরা বাঁধ, স্লুইস গেট আর ক্রস ড্যামের মতো কাঠামোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শুরু করেছিলো। এসব কৃত্রিম বাঁধ বিলের প্রাকৃতিক পানি চলার পথ আটকে দিয়ে মাছের ভাণ্ডার আর উর্বর মাটির গুণ নষ্ট করে। প্রতিবছর নদীর সঙ্গে আসা পলি বিলে প্রাণ ফিরিয়ে আনত, অথচ "নিয়ন্ত্রণের" নামে সেই প্রবাহ আটকে দিয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য পুরোপুরি নষ্ট হচ্ছিল। অবশেষে, প্রকৃতি আর মানুষের এই দীর্ঘ লড়াই নতুন এক দিগন্তে পৌঁছাল; সরকার এগিয়ে এসে শুরু করল পুনরুদ্ধারের কাজ। এই উদ্যোগ- ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য একটি কেন্দ্র গড়ার তাগিদ দিল। বড়াল নদী রক্ষা আন্দোলনের অংশ হিসেবে শিশুদের পরিবেশ সম্বন্ধে সচেতন করতে ২০১৯ সালে নিজ জমি ও অর্থায়নে বড়াল বিদ্যানিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন মিজানুর রহমান ও দিল আফরোজ দম্পতি। পরিবেশ রক্ষার এমন প্রচেষ্টায় মুগ্ধ হয়ে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন পরিবেশকর্মী ও স্থপতি ইকবাল হাবিব। প্রকল্পের ধারণা : ‘বড়াল বিদ্যা নিকেতন’ মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সমতা ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম থেকে জন্ম নেওয়া একটি সম্মিলিত প্রয়াসের প্রতিচ্ছবি। প্রকৃতির ওপর মানুষের হস্তক্ষেপের ক্ষতিকর প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রকৃতিনির্ভর সমাধানের মাধ্যমে এটি গড়ে তোলাই ছিল এ প্রকল্পের মূলমন্ত্র। প্রকল্পটির ধারণা শুরু করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে, যাতে তারা প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্ক গড়তে পারে এবং তাদের চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি অর্জন করে। একটি প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান, যা মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থানের সুন্দর উদাহরণ হতে পারে – এ লক্ষ্য থেকে শুরু হয় প্রকল্পটির কাজ। |
|
প্রকল্পের সাইট : পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার কুমারগাড়া গ্রামে বড়াল নদীর তীরে বিদ্যালয়টি অবস্থিত। চাটমোহর রোড হতে দক্ষিণ পার্শ্বে সাইটের প্রবেশপথটি রয়েছে। বড়াল নদীটি সাইটের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। সাইটের চারপাশে প্রচুর গাছগাছালি ঘেরা পরিবেশ রয়েছে। সাইটের দক্ষিণ পাশে ভবিষ্যতে এক্সটেনশনের জায়গা রাখা রয়েছে। সাইটের পশ্চিম পাশে চাটমোহর টেকনিক্যাল স্কুল অবস্থিত। বিদ্যালয়ের প্রোগ্রামসমূহ : বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি ব্যতিক্রমী পদ্ধতিতে পাঠদানের ব্যবস্থা করেছে যাতে বাচ্চারা বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়। প্রতিষ্ঠানটিতে সপ্তাহে একবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। শিশুদের শেখানো হয় নাচ, গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা ও বিতর্ক। নিচতলায় লাইব্রেরি এবং দোতলায় রয়েছে কম্পিউটার ল্যাব। সাজানো বাগানে, হাসি-গানে প্রতিটি শিশুকে মানুষ করে তোলার অঙ্গীকার রয়েছে শিক্ষকদের মাঝে। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠার সময় শুধুমাত্র ক্লাস ওয়ান চালু করা হয়েছিল, এখন এটি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত চালু করা হয়েছে। প্রতি বছর একটি করে ক্লাস বাড়ানো হচ্ছে। প্রথম শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত ২৮০ জন শিক্ষার্থী এবং একজন প্রধান শিক্ষকসহ ১৪ জন যোগ্য শিক্ষক রয়েছেন। |
ডিজাইন পদ্ধতি : দুটি একতলা ও একটি দোতলা ভবন নিয়ে বিদ্যালয়টি ডিজাইন করা হয়েছে। দুটি একতলা ব্লকের নকশা করা হয়েছে সাইটের সীমানা রেখা মেনে, যেন সূর্যের আলো পৌঁছানোর জন্য, বৃষ্টির জল আর লতানো গাছের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে জায়গা থাকে।
২৫ মিটার লম্বা ব্লকের দুই পাশে ডানার মত একতলা ব্লকের অংশ মিলে তৈরি করা হয়েছে একটি উঠোন – দক্ষিণের আমবাগান ঘেরা এক খোলা উঠোন, যেখানে শিশুরা খেলা আর পড়াশোনায় মগ্ন হতে পারে। বিদ্যালয়ের উঠোন জুড়ে আছে শান্তিনিকেতনের আদলে তিনটি আমগাছ। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ এমনভাবে উঠানের দিকে মুখ করে রাখা হয়েছে, যেন শিক্ষার্থীরা প্রকৃতির মাঝে নিজেকে খুঁজে পায়। এর স্থাপত্যে সংবেদনশীলতার প্রাধান্য রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকতে উদ্বুদ্ধ করে।
নিচের স্তরে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে রহস্যময় গুহার মতো একটি মুক্ত পাঠাগার, যা প্রাকৃতিক তাপ নিরোধক। এটি ছোটদের খেলাধুলা আর আরামদায়ক পাঠের জন্য এক আদর্শ স্থান। পুরো কাঠামো এমনভাবে র্যাম্প আর সিঁড়ির মাধ্যমে সাজানো হয়েছে, যাতে সকল শিক্ষার্থী সহজে ও নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারে। |
|
ছবি: সাইট প্ল্যান |
ছবি: গ্রাউন্ড ফ্লোর প্ল্যান |
ছবি: ফার্স্ট ফ্লোর প্ল্যান |
নির্মাণ পদ্ধতি : এ প্রকল্পের কাঠামোগুলো নির্মাণ করা হয়েছে মূলত স্টিল এবং কাঠ দিয়ে। ফলে, নির্মাণ কাজে সময় কম লাগে, যা মোট খরচ কমানোর ক্ষেত্রে সাহায্য করে। প্রকল্পটির জন্য এটি একটি সাফল্যের জায়গা। |
ছবি: দক্ষিণ দিকের এলিভেশন |
ছবি: ছেদচিত্র |
স্টিল এবং কাঠের উপর ভিত্তি করে বিল্ডিং কাঠামোগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। স্টিল এবং কাঠ একটি শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করে, যা প্রচলিত উপকরণের তুলনায় কম কার্বন ফুটপ্রিন্ট উৎপাদন করে। এছাড়াও, প্রকৃতি ও শিশুশিক্ষার মেলবন্ধন ঘটাতে ইট, কাঠ, বাঁশ ও মাটি ব্যবহার করা হয়েছে।
গতানুগতিকতার বাইরে খোলামেলা ও পরিবেশবান্ধব আবহে ইটের গাঁথুনি ও দেয়ালের নকশায় রয়েছে পর্যাপ্ত আলো প্রবেশের ব্যবস্থা। শ্রেণিকক্ষের জানালাগুলোর মাঝে বাঁশের চিক ব্যবহার করা হয়েছে, যা প্রবল বৃষ্টিতে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা দেয়, আবার আলো-বাতাসের চলাচলও নিশ্চিত করে। জানালার পরিবর্তে দেওয়ালটি ইটের জালিকা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, যা শুধু আলো-বাতাস ঢোকার সুযোগই দেয় না, বরং শ্রেণিকক্ষের বদ্ধ পরিবেশটাও বদলে প্রাণবন্ত করে তোলে।
পুরো স্থাপনাটিতে ব্যবহৃত হয়েছে হাতে তৈরি মেঝের টাইলস, ইস্পাতের ফ্রেম, কাঠের ফ্রেম দিয়ে টালির ছাদ। দোতলা স্কুল ভবনের নিচতলায় খোলা বারান্দায় বাঁশের ভেলায় টাঙানো হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা বিষয়ভিত্তিক চিত্রকর্ম। |
|
বর্ধিত পিচ রুফ এই অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য শৈলী, যা স্থানীয় জলবায়ুর জন্য একটি কার্যকর নকশা সমাধান হিসাবে কাজ করে। সরাসরি সূর্যের আলো এবং ভারী বৃষ্টির বিরুদ্ধে এটি সুরক্ষা দেয় এবং ভেতরের পরিবেশ আরামদায়ক করে তোলে। স্টিল, মজবুত মেহগনি কাঠ, মাটির টাইলস, বাঁশের ফ্রেম, পর্দা এবং পোড়ামাটিসহ প্রতিটি উপাদান কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে সমর্থন করার জন্য বেছে নেওয়া হয়। কাদামাটি দিয়ে নির্মিত একটি লাইব্রেরি তৈরি করা হয়েছে, যার ভেতর একটি স্থিতিশীল তাপমাত্রা বজায় থাকে। প্রতিটি ঘর দক্ষিণ দিকে খোলা, সহিষ্ণু বায়ুচলাচলের (passive ventilation) জন্য ড্রপ-ডাউন বাঁশের চাটাইয়ের পর্দা এবং ছিদ্রযুক্ত (perforated) ইটের দেয়াল তৈরি করা হয়েছে। এই নকশা নীতিটির ফলে কৃত্রিম শীতলীকরণ ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়ে না। |
ছবি: সবুজ স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য |
পানি ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ : ডিজাইনে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য রেইন চেইন স্থাপন করা হয়েছে, যা ভূগর্ভস্থ জল পুনরায় পূরণ করতে সাহায্য করে। টেকসই জল ব্যবস্থাপনার প্রচারের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা কমিয়ে ভূগর্ভস্থ জল রিচার্জ এবং সঠিক নিষ্কাশন নিশ্চিত করে। আভ্যন্তরীণ নকশা পরিবেশ-বান্ধব, সহজে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় এমন কম VOC (এক ধরণের কেমিক্যাল, যা স্বাভাবিক অবস্থায় বাতাসে বাষ্পীভূত হতে পারে) যুক্ত ওয়াল পেইন্ট, শক্তি-সাশ্রয়ী লাইট এবং হাতে নির্মিত মেঝের টাইলস সহ নির্মাণ করা হয়েছে। তাপমাত্রার প্রভাব কমানোর জন্য আউটডোর এরিয়ায় সফট পেইভ ব্যবহার করা হয়েছে, যা মাটির ভেতরে প্রাকৃতিক জলের অনুপ্রবেশও ঘটায়। সাইটটি আশেপাশের স্থানীয় গাছ এবং ফলের বাগান দ্বারা আচ্ছাদিত এবং হাঁটার রাস্তার দুপাশে বিভিন্ন দেশীয় ফুলের গাছও রয়েছে। সেটব্যাক এরিয়াটি শ্রেণীকক্ষ হতে দৃশ্যমান, ফলে সহজেই ক্রস ভেন্টিলেশনের সুযোগ ঘটে। |
এই শিক্ষাকেন্দ্রের প্রতিটি কোণ যেন নতুন এক শিক্ষার কথা বলে, যেখানে প্রকৃতির সাথে মিশে রয়েছে খেলাধুলা আর শেখার আনন্দ। এটি শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্প্রীতি পুনঃস্থাপন এবং পরিবেশ সুরক্ষার প্রতি আমাদের দায়িত্বশীলতার চর্চা। চলনবিলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তথাকথিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়ে প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে তৈরি করা স্কুলটি বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলকও বটে। প্রকৃতি আর মানুষের এই বন্ধনই আমাদের ভবিষ্যতের আশা, যেখানে মানবসৃষ্ট ধ্বংসের বদলে প্রকৃতির শান্তির বার্তা পৌঁছে যাবে আজকের ও আগামী দিনের প্রজন্মের কাছে। |
সম্পাদনায় : স্থপতি ফাইজা ফাইরুজ |