প্রকল্পের নাম: বিলীয়মান বসতবাড়ি: নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়তা
অবস্থান: পশ্চিম বেলকার চর গ্রাম, গাইবান্ধা
জমির পরিমাণ: ২.২১ একর, ৯৬৩১৭.২৪ বর্গমিটার
নির্মিত স্থান: ১৮, ৭৭৭.০০ বর্গমিটার
আবাসনের মোট সংখ্যা: ৪৬
প্রকল্পের সূচনা: এপ্রিল, ২০০৪
প্রকল্পের সমাপ্তি: মার্চ, ২০০৯
খরচ:প্রকল্পটি ইউনাইটেড কিংডমের বিগ লটারি ফান্ড (বিএলএফ) এবং প্রাকটিক্যাল অ্যাকশন বাংলাদেশ দ্বারা অর্থায়ন করা হয়েছ। খরচ ভাগ করে নেওয়ার ভিত্তিতে বিএলএফ এর অনুদান ৫৯.৩% এবং প্রাকটিক্যাল অ্যাকশন বাংলাদেশের অনুদান মোট খরচের ৪০.৭%।
ফটোগ্রাফ: হাসান চন্দন, স্থপতি সুমন মল্লিক, প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন-বাংলাদেশ, গেটি ইমেজ
বিলীনমান জমি প্রকল্পের দলের সদস্যরা: জে. এ. আর্কিটেক্টস ডিজাইন লিমিটেড: প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন-বাংলাদেশ: স্থানীয় এনজিও: ফটোগ্রাফ: হাসান চন্দন, স্থপতি সুমন মল্লিক, প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন-বাংলাদেশ, গেটি ইমেজ পুরস্কার: |
বাংলাদেশে নদীভাঙন একটি নিয়মিত ঘটনা। নদীর স্রোত দিক পরিবর্তন করলে কখনো এক পাড় ভাঙে, আবার আরেক পাড়ে চর গড়ে ওঠে। নদীর এ ভাঙা-গড়ার কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জীবন হুমকির সম্মুখীন হয়। এই বদ্বীপ অঞ্চল গড়ে উঠেছে নদীর পানিবাহিত পলিমাটি দিয়ে। তাই নদীর দুই পাড়ের মাটি সাধারণত নরম এবং অস্থায়ী গঠনের হয়ে থাকে।ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা নদীভাঙন, ঘন ঘন বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। ‘বিলীয়মান বসতবাড়ি’ প্রকল্পের জায়গাটি, গাইবান্ধা জেলা, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে দুটি প্রধান নদী: তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থলে অবস্থিত। এই অত্যন্ত দুর্যোগপ্রবণ জেলায় নদীভাঙনের ফলে কৃষিজমি এবং বসতবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়। |
গাইবান্ধা জেলার পশ্চিম বেলকার চর গ্রামে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। এ অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্থ জনগোষ্ঠী প্রায়ই কাছাকাছি বাঁধের উপর আশ্রয় নেয় বা শহুরে বস্তিতে স্থানান্তরিত হয়, যেখানে নিরাপদ পানি, স্যানিটেশনের ব্যবস্থা নেই। এসব এলাকায় ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকার কারণে এই জনগোষ্ঠী মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ‘প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন বাংলাদেশ’ আনুষ্ঠানিকভাবে বন্যা ও নদী ভাঙন দ্বারা প্রভাবিত জনগোষ্ঠীর সহায়তা করার জন্য প্রকল্পটি শুরু করেছিল। উপদেষ্টা ফার্ম জে. এ. আর্কিটেক্টস লিমিটেড প্রকল্পটির নকশা ও নির্মাণ কাজের তদারকি করেছে। এ প্রকল্পের দুটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিলঃ |
ওপরের ছবি : শুষ্ক নদীর ধারে শীত মৌসুমে একটি গ্রাম (উরিয়া) নিচের ছবি : বর্ষাকালে একই নদীর ধারে একই গ্রাম |
|
ছবি : ক্লাস্টার-এর লেআউট |
বাংলাদেশের চিরাচরিত ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে গ্রামের লেআউটটি করা হয়েছে উঠানের চারপাশে ঘরগুলি বিন্যাসের মাধ্যমে। ঐতিহ্যগতভাবে এই উঠান প্রতিটি গুচ্ছের দৈনন্দিন সামাজিক কার্যকলাপের কেন্দ্র।গুচ্ছ গ্রামগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে দৈনন্দিন জীবনের সকল মৌলিক-চাহিদা এবং সুযোগ-সুবিধা অনুসারে ব্যবহার করা যায়। ১০টি পরিবারের একটি গুচ্ছের জন্য একটি গবাদি পশুর শেড নির্মাণ করা হয়েছে। গবাদি পশু পালন গ্রামবাসীদের আয়ের উৎস। প্রতিটি উঠানের চারপাশে টিউবওয়েলসহ মহিলাদের এবং পুরুষদের জন্য পৃথক কমিউনিটি ভিত্তিক ল্যাট্রিন এবং স্নানাগার এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি ঘর ৪-৫ সদস্যের একটি পরিবারের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। প্রতিটি ঘরে একটি বড় কক্ষ রয়েছে, যা পরিবারের সদস্যরা নিজেদের প্রয়োজনমত ভাগ করে নিতে পারে। উঠানের সামনে একটি বারান্দা রাখা হয়েছে, যা পরিবারের বিভিন্ন ধরণের ব্যবহার উপযোগী স্থান হিসাবে কাজ করে। প্রতিটি ঘরের জানালা স্থানীয় উপকরণ (কাঠ,বাঁশের মাদুর) দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। ঘরগুলির পাশে অন্য একটি ঘরের সংযোজনের ব্যবস্থা রয়েছে যা ভবিষ্যতের প্রয়োজনের জন্য পরিবারটি পরে তৈরি করতে পারবে। |
ছবি : হাউস টাইপ A (প্ল্যান) |
ছবি : হাউস টাইপ A (এলিভেশন) |
ছবি : হাউস টাইপ B (প্ল্যান) |
ছবি : হাউস টাইপ B (এলিভেশন) |
প্রতিটি গ্রামে একটি করে কমিউনিটি হলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাল্টিপারপাস কমিউনিটি হল গ্রামগুলির পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। গ্রামবাসীরা বিভিন্ন সামাজিক উদ্দেশ্যে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধার্থে জানালা ব্যবহারের পরিবর্তে প্রাকৃতিক বায়ুচলাচলের জন্য ডিজাইনে ইটের জালি ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের শিশুরা যাতে প্রাথমিক শিক্ষা পায় সে জন্য প্রতিটি গ্রামে একটি করে কমিউনিটি স্কুলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্কুলের লেআউটটিতে কয়েকটি শ্রেণীকক্ষ এবং একটি শিক্ষকের কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কমিউনিটিতে একটি মসজিদ ডিজাইন করা হয়েছে। |
ছবি : কমিউনিটি হল (প্ল্যান) |
ছবি : কমিউনিটি হল (এলিভেশন) |
ছবি : স্কুল (প্ল্যান) |
ছবি : স্কুল (এলিভেশন) |
ছবি : মসজিদ (প্ল্যান) |
ছবি : মসজিদ (এলিভেশন) |
এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠী, প্রকল্পটির নির্মাণকাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল। এর মাধ্যমে তাদের একটি বড় অংশ নির্মাণকাজে দক্ষ হয়ে পরবর্তীতে নিজেদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। গ্রামবাসীদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে কিছু কমিউনিটিতে দোকানের ব্যবস্থা করা হয়েছে যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করে। প্রকল্পটি গাইবান্ধা জেলায় একটি সমন্বিত এবং অংশগ্রহণমূলক দুর্যোগের ঝুঁকি কমানোর মডেল হিসেবে দেখানো হয়েছে। দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য বেশ কয়েকটি নতুন প্রযুক্তিগত বিকল্প গ্রহণ, সেগুলোর সফলভাবে উদ্ভাবন এবং পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যেমন: অনুর্বর এবং নিষ্ফলা বালি বার দ্বীপে ফসল কাটা, ভাসমান বাগান এবং মাছের ফাঁদ এবং খাঁচা তৈরী ইত্যাদি। গৃহহীন জনগোষ্ঠীর জন্য এই বসতি মডেলের উন্নয়ন তাদের জীবিকা পুনরায় শুরু করার এবং তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। |
|
এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং পরিকল্পনায় দুর্যোগের ঝুঁকি কমানোর কৌশলগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কমিউনিটির জনসাধারণ এবং সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষমতা বাড়ানো হয়। এছাড়াও, বিকল্প জীবিকা, উন্নত আয়ের ব্যবস্থা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের মাধ্যমে বেকার এবং নিম্ন আয়ের নারী-পুরুষ উপকৃত হয়েছে। সুবিধাবঞ্চিত পুরুষ, মহিলা এবং শিশুরা মৌলিক পরিষেবাগুলিতে উন্নত সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের সাথে সাথে ডিজাইন টিমের সদস্যরাও বিভিন্নক্ষেত্রে উপকৃত হয়। গুচ্ছ গ্রামের নকশার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়, যার ফলে টিমের সদস্যরাও পরবর্তীতে তাদের নতুন অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগাতে পারবে। |
ছবি : কমিউনিটির অদক্ষ দিনমজুর মাটি কাটায় অংশ নিচ্ছে |
|
এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের সকল দুর্যোগপ্রবণ এলাকার জন্য একটি অনুপ্রেরণা। এই মডেলটির গৃহহীন এবং দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বঞ্চিত লোকদের সহায়তাসহ ধারণাগত জায়গা থেকে নির্মাণের শেষ ধাপ পর্যন্ত কমিউনিটিকে অন্তর্ভুক্ত করার উদাহরণ হিসেবে পরবর্তীতে অনুসরণযোগ্য। |
ছবি : ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী নতুন নির্মিত গ্রামে বসতি স্থাপন করার পথে |
সম্পাদনায় : স্থপতি ফাইজা ফাইরুজ নির্ণয় উপদেষ্টা লিমিটেড, পান্থপথ |