| প্রকল্পের নাম: সোবহানবাগ মসজিদ আর্কিটেকচারাল কনসাল্টেন্ট: ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ | 
 | 
| পরিবর্তনশীল শহরে এক অবিচল বিশ্বাস 
 প্রায় একশ বছর ধরে ঢাকার পরিবর্তনের নীরব সাক্ষী সোবহানবাগ মসজিদ। শহর যত বেড়েছে, যত ঘন হয়েছে, ততই এই মসজিদ নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে - সময়, বিশ্বাস আর মানুষের যাত্রার এক স্থির চিহ্ন হয়ে। ১৯৩৭ সালে মৌলভী আব্দুস সোবহান এটি নির্মাণ করেন। ছোট পরিসরে হলেও, এর উদ্দেশ্য ছিল গভীর - একটি শান্ত নিবাস, যেখানে মানুষ সৃষ্টি কর্তার সঙ্গে সংযোগ খোঁজে। তখনকার ঢাকা ছিল শান্ত। গাছের সারি ঘেরা সরু পথ, ছোট ছোট বাড়ি, উঠোনে শিউলি-জবা ফুটত, আর ভোরের আজান বাতাসে ভেসে আসত। সেই নিস্তব্ধ শহরের এক কোণে মসজিদটি ছিল প্রশান্তির প্রতীক - আলোছায়া আর মানবিক স্কেলে গড়া এক সরল সৌন্দর্য। | 
 | 
| তখনই প্রশ্ন আসে এই শহরের চাপ, চলমান কোলাহল আর সীমিত জায়গার মধ্যে এই মসজিদ কীভাবে আবার নিঃশ্বাস নেবে? কীভাবে এটি ভিড়ের মাঝে শান্তির কেন্দ্রবিন্দু হতে পারবে? | শহরের ঘনত্বে শ্বাসরুদ্ধ পরিবর্তন সময় পেরিয়েছে, ঢাকার গায়ে জমেছে কংক্রিটের স্তর। নব্বইয়ের দশকে স্থানীয় এক দাতার উদ্যোগে মসজিদটি প্রথম বড় ধরণের রূপান্তর পায়। তখনই যুক্ত হয় এর পরিচিত লাল ইটের মুখাবয়ব - অনুপ্রেরণা ছিল লুই কান-এর সংসদ ভবনের নির্মিতিশৈলী। ইটের টেক্সচারে মিশে থাকে বাঙলার মাটির গন্ধ, আর সেই উপকরণই হয়ে ওঠে সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের প্রকাশভঙ্গি। এর মাঝে ঢাকার গতি বেড়েই চলছে। চারপাশে গজিয়েছে আবাসিক এলাকা, উঁচু দালান, ব্যস্ত রাস্তা, দোকান - সব মিলে মসজিদের চারপাশের বাতাস ক্রমে ভারী হয়ে উঠতে লাগল। একসময় খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা তিনতলা মসজিদটা যেন ধীরে ধীরে শহরের দেওয়ালে চেপে গেল। আলো, বাতাস, নীরবতা সব কমে এল। ভেতরে তবু থামেনি প্রার্থনা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এখানে নামাজ পড়েছে। শুক্রবার আর ঈদের দিনে রাস্তাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে মানুষ, শহরের কোলাহল মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়। কিন্তু জায়গা ফুরিয়ে গেছে। মসজিদের পুরনো কাঠামো হয়ে পড়ছে অনিরাপদ, ভিড়ে ঠাসা নগরের মাঝে সেটি সংকীর্ণ ও ক্লান্ত। সেইসাথে মসজিদের পাশেই ছিল পারিবারিক কবরস্থান যা নীরব, অপরিবর্তনীয় যেন সময়ের নোঙর। | 
| 
 | 
 | 
| নতুন আশ্রয়ের জন্ম ফর্ম বিশ্লেষণ: নতুন সোবহানবাগ মসজিদের নকশা শুরু হয় সরলতা আর স্পষ্টতার ধারণা থেকে। এখানে বিশ্বাস প্রকাশ পায় গম্বুজ বা অলংকরণে নয়, বরং ভারসাম্যে। বেছে নেওয়া হয় কিউব বা ঘনক্ষেত্র; একটি নিখুঁত, দৃঢ় ও শান্ত ফর্ম। লুই কানের সংসদ ভবনের জ্যামিতিক দৃঢ়তা ও কাব্যময় আলোছায়ার অনুপ্রেরণায় এই ঘনক্ষেত্র হয়ে ওঠে স্থিতির প্রতীক। একই সঙ্গে এটি স্মরণ করায় কাবা শরীফের সরলতা - যেখানে আকারের ভেতরেই নিহিত থাকে বিশ্বাসের মর্ম। | 
| মসজিদের প্রোগ্রামসূহ: 
 মাত্র ৮১৩ বর্গমিটার জমির মধ্যেই মসজিদটি উল্লম্বভাবে উঠে গেছে, সীমিত জায়গার ভেতর প্রশস্ততার অভ্যন্তরীণ অনুভূতি তৈরি করে। কলামবিহীন নামাজঘরটি খোলা আলো ও বাতাসে ভরা, যেন ভেতরের মানুষদের মনও মুক্ত হয়। নামাজ ঘরের চারপাশে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো হয়েছে মাদ্রাসা, পাঠাগার ও ছোট বাগানচত্বর, হিফজ ছাত্রদের আবাস এবং প্রশাসনিক কক্ষ; প্রতিটি জায়গা নিজ নিজ কাজে নিয়োজিত কিন্তু মূল নামাজঘরের পেছনে থেকে তার প্রার্থনা ও আধ্যাত্মিক কেন্দ্রকে সহায়তা করে। ঠিক এভাবেই লুই কানের ‘served and servant’ ধারণা এখানে জীবন্ত হয়ে ওঠে । যেখানে প্রধান স্থান পূর্ণতাকে ধরে রাখে, অন্য সবকিছু তার সেবক হিসেবে শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে কাজ করে। পুরো কাঠামোটি সামান্য ঘুরে কিবলামুখীভাবে বসানো হয়েছে, যাতে আধ্যাত্মিক দিক নির্দেশনা আর স্থাপত্যের জ্যামিতিক শৃঙ্খলা একসাথে মিলে যায়, দর্শন এবং ব্যবহারের অভিজ্ঞতায় সঙ্গতি বজায় থাকে। | 
| 
 
 | 
| পোডিয়াম লেভেল: মসজিদটির পোডিয়াম লেভেলে তথাকথিত কলাম ব্যবহার না করে পিলটিসের উপর তৈরি করা হয় - যাতে নিচ দিয়ে বাতাস, আলো ও পথচারীর অবাধ চলাচল থাকে। নিচতলার এই ছায়াময় খোলা অংশটি হয়ে উঠেছে ছোট্ট নিঃশ্বাস নেওয়ার পরিসর - না ফুটপাত, না প্রার্থনাস্থল, বরং এগুলোর মাঝামাঝি একটি জায়গা, যেখানে শহর একটু শ্বাস নেয়। পুরোনো সীমানা থেকে প্রায় ১৫ ফুট পেছনে এনে মসজিদের ভিত্তি নতুনভাবে স্থাপন করা হয়েছে, যাতে ফুটপাত ও রাস্তা আগের প্রশস্ততা ফিরে পায় - এ যেন নগরের প্রতি এক নীরব সম্মান। | 
| আভ্যন্তরীণ স্থাপত্য: ব্যস্ত শহরের গরম, ধুলা আর কোলাহলের বেড়াজাল পেরিয়ে যখন কেউ মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে, তখন ধীরে ধীরে শুরু হয় অন্তর্বর্তী অভিজ্ঞতা। ইটের জালিকার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো মেঝেতে আঁকে জ্যামিতিক খেলা । এই প্রাক-প্রার্থনার মুহূর্ত মানুষকে নামাজের জন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুত করে - পার্থিবতা থেকে পবিত্রতার দিকে। ভেতরের স্থাপত্যে, নামাজ ঘরের ছাদের গোলাকার খাঁজ কাটা (recessed) অংশ দিয়ে আলো নেমে আসে। এটি সরাসরি উজ্জ্বল হলেও নিয়ন্ত্রিত - নির্দিষ্ট ফোকাসে পৌঁছায়, নামাজরতদের চোখে কোনো তীব্রতা সৃষ্টি করে না, বরং ভেতরের পরিবেশকে শান্ত রাখে। এই আলোয় যেন বাংলার পুরনো সাতগম্বুজ মসজিদের স্মৃতি ধীরে ধীরে জাগে, নতুন রূপে, বিমূর্ত ও আধুনিক ভাষায়। প্রতিটি রশ্মি অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে এক নীরব সংলাপের আভাস তৈরি করে, যা স্থাপত্যকে শুধু দৃষ্টিনন্দনই নয়, অভিজ্ঞতামূলকও করে তোলে। | 
| নারীদের জন্য রয়েছে আলাদা নামাজের স্থান, যেখানে একটি ঝুলন্ত সিঁড়ি দিয়ে যাওয়া যায়। ম্যাজেনাইন (Mezzanine) লেভেলের অবস্থান এমনভাবে রাখা হয়েছে, যাতে মূল নামাজঘরের সঙ্গে চোখে দেখা এবং আত্মিক সংযোগ দুটোই বজায় থাকে। এখানে অন্তর্ভুক্তি, গোপনীয়তা ও মর্যাদার এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে। | 
| উচ্চতার সীমাবদ্ধতার মধ্যেও মিনারটি দাঁড়িয়ে আছে সংযত সৌন্দর্যে। গ্রন্থাগারের পাশে ছোট একটি উঠোনে আকাশের টুকরো ঝলমল করছে, ছায়া নেমে এসেছে শান্তভাবে, আর নীরবতা মিশে গেছে পরিবেশে - যেখানে মানুষ কিছু মুহূর্ত থেমে, নিঃশ্বাস নিতে পারে। বাইরের ফ্যাসাদ জুড়ে মার্বেলে খোদাই করা কালিমা তায়্যিবা, ছোট ছোট কিউবের সঙ্গে মিলিত হয়ে হিউম্যান স্কেলের একটি স্থাপত্যিক ভলিউম তৈরি করেছে। লুই কানের সংসদ ভবনের বিশাল শূন্যতার ভাবনা এখানে ধীরে ধীরে মানব মাপে রুপান্তরিত হয়েছে – একই ভাষা, ভিন্ন পরিমাপ। | 
| মসজিদটি একটি আলোকিত পর্দার মতো কাজ করে - দিনে সূর্যালোক ছেঁকে ভেতরে নিয়ে আসে, রাতে নরম আলো ছড়িয়ে দেয় বাইরে। শেখ সালিম চিশতির সমাধি থেকে প্রেরণা পাওয়া এই ক্যালিগ্রাফি ঐক্য, আনুগত্য ও ধারাবাহিকতার প্রতীক; আলো, শব্দ ও অর্থের মিলনে স্থাপত্য এখানে পরিণত হয়েছে এক নীরব জিকিরে। 
 ধারাবাহিকতার স্থাপত্য আজকের সোবহানবাগ মসজিদ অতীতকে পুনরাবৃত্তি করে না, আবার অস্বীকারও করে না। এটি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলেছে, কিন্তু হারায়নি বিশ্বাসের শান্ত স্বর। ঢাকার ঘন, উঁচু, ব্যস্ত বাস্তবতার ভেতরেও এটি দাঁড়িয়ে আছে দৃঢ় ও সংযত ভঙ্গিতে - অতীতের স্মৃতি বহন করে, ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দিকে তাকিয়ে। | 
| প্রতিবেদক: স্থপতি ফাইজা ফাইরুজ |