প্রকল্পের নাম : ‘সুফি বাড়ি’ স্থান : লক্ষীপুর, শ্রীপুর,গাজীপুর মোট নির্মাণাধীন এলাকা : ৮০২ বর্গমিটার সাইটের এলাকা : ৩৬০১৫ বর্গমিটার প্রকল্প সমাপ্তি : ২০২২ খরচ : ২,৬১,৭১,৮৭৫ টাকা ডিজাইন টিম :রুফলাইনারস_স্টুডিও অফ আর্কিটেকচার স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার : শান্তনু দে নির্মাণ : চারুতা প্রাইভেট লিমিটেড ফটোগ্রাফার : City Syntax |
ছবি : ডিজাইন টিম |
পৈতৃক শিকড় এবং শৈশব স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে, পশ্চিমবঙ্গের বংশোদ্ভূত একটি পরিবার বাংলাদেশে একটি আশ্রয়স্থল খোঁজে। প্রকৃতির কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই ক্ষণিকালয় চিরাচরিত চার দেয়ালের বাড়ির সীমানা অতিক্রম করে হয়ে ওঠে এক নৈসর্গিক অভয়ারণ্য। প্রকৃতির সাথে এই নিষ্কলুষ সহাবস্থান পরিবারের সদস্যদের অনুপ্রাণিত করে কখনো না মুছে যাওয়া স্মৃতি তৈরি করতে। এখানে জীবন ধীর গতিতে, স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে থাকে, আধুনিক সুযোগ-সুবিধাগুলি সহজেই গ্রামীণ পরিবেশের সাথে মিশে যায়। বাড়িটির শান্ত ও সুস্থির পরিবেশ, সমসাময়িক প্রশান্তির সাথে সাথে বসবাসকারীদের নিভৃতে দিন কাটানোর ব্যবস্থা করে দেয়। |
বাড়িটির নকশা করা হয়েছে প্রাকৃতিক সাইট ফোর্সের সাথে সামঞ্জস্য রেখে – প্রাকৃতিক সীমারেখা, ঋতু পরিবর্তন, এমনকি চারপাশের জনহীন প্রান্তর, বাড়ি নির্মাণের সঠিক স্থানটি নির্ধারণ করে দেয়। এই বাড়িটিতে সকল অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হলেও তা চারপাশের গ্রামীণ সৌন্দর্যের ধারাকে বাধাঁগ্রস্ত করেনি, বরং প্রাকৃতিক শোভা ও অধুনা প্রযুক্তি একে অন্যের পরিপূরক হয়ে বাসিন্দাদের জন্য নিশ্চিত করেছে এক প্রশান্তিময় গৃহকোণ। |
ছবি : কন্টেক্সট প্ল্যান |
ছবি : মাস্টারপ্ল্যান |
সাইটে বিদ্যমান বাঁশ বাগানটি চারদিক হতে বায়ু প্রবাহের একটি সংযোগস্থল, যা বাড়িটি নকশার মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বাড়িটির ব্লকগুলি বিক্ষিপ্তভাবে সাজানো হয়েছে গ্রামীণ পরিবারের প্যাটার্নগুলো মাথায় রেখে, যেন চারপাশের সবুজের সাথে ব্লকগুলো মিশে যায়। প্রতিটি ব্লক বিভিন্ন উচ্চতায় অবস্থিত। ব্লকগুলো মৌসুমী বন্যার জলসীমার উপরে অবস্থান করে এবং প্রাকৃতিক বায়ুচলাচলের স্বাভাবিক গতিপথকে বাঁধাগ্রস্ত করেনা। নকশার এই বৈশিষ্ট্যগুলো বাড়িটিতে সর্বদা প্রাকৃতিক বায়ুপ্রবাহ নিশ্চিত করে এবং আশেপাশের দৃষ্টিনন্দন পরিবেশকেও উপভোগের সুযোগ করে দেয়। |
ছবি : গ্রাউন্ড ফ্লোর প্ল্যান |
ছবি : ফার্স্ট ফ্লোর প্ল্যান |
বাড়িটির ল্যান্ডস্কেপ ঋতু পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে বিকশিত হতে থাকে। নিম্নাঞ্চলগুলো জলভরা পুকুরে রূপান্তরিত হয়, আর চারপাশের উর্বর জমি ও ফলের বাগান বাড়িটির সতেজতা নিশ্চিত করে। বাঁশের বাগানটি দুইভাবে ব্যবহৃত হয় - একটি, শান্তিপূর্ণ হাঁটার জন্য সুন্দর জায়গা, অন্যটি, স্থানীয় প্রাণীদের জন্য একটি বন্য অভয়ারণ্য। সাইটে এমনকিছু গাছ বেছে নেয়া হয়েছে, যেগুলো খোলা বসার জায়গাগুলিকে আবৃত করে রাখে এবং গ্রামীণ প্রকৃতির মনোরম দৃশ্যের মতোই চারপাশের পরিবেশকে ফুটিয়ে তোলে। |
|
খোলা ছাদ হতে লুকানো উঠোন, বাড়ির প্রতিটি ডিটেইল নকশা যেন প্রাকৃতিক পরিবেশকে আমন্ত্রণ জানায়। এখানে রাতে বাঁশবাগানের ঝিরিঝিরি শব্দ আর ঘরের প্রশস্ত জানালা দিয়ে আকাশের বিশাল রূপ একত্রে এক ঐশ্বরিক আবহ তৈরি করে। এমনকি বাথরুমগুলিও অবজারভেটরির মতোই নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগের জায়গায় রূপান্তরিত হয়। এই অভয়ারণ্যটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থা দ্বারা চালিত। সূর্যের আলো এবং বর্ষার পানির যথোপযুক্ত ব্যবহার এখানের ফসলি জমিকে উর্বর রাখে। ছোট আকারের নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার করে এখানে ভবিষ্যতে অফ-গ্রিড থেকে বাড়ির জ্বালানি চাহিদা সরবরাহ করে দেয়। স্থানীয় উপাদান দিয়ে যত্নের সাথে বাড়িটির নির্মাণ কাজ করা হয়। |
ঢাকা শহরের দৈনন্দিন কোলাহলপূর্ণ জীবন হতে একটু মন্থর গতিতে, উচ্চভূমি হতে নিম্নভূমিতে প্রকল্পটি একটি ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা প্রদান করে। বিল্ডিং ব্লকগুলোর ভেতরে প্রবেশ করলেই বোঝা যায় এ প্রকল্পের মহিমা। সময় এ জায়গায় যেন স্থির হয়ে যায়, ক্ষুদ্র পৃথিবীর আলোকরশ্মি হতে বিশাল-বিস্তৃত পরিবেশে আগমন ঘটে, যেখানে আকাশ নদীর সাথে মিলিত হয়। বাস্তব থেকে অবাস্তব, সচেতন থেকে অবচেতনে, আধ্যাত্মিকতায় আসা হয়, তাই তো এ প্রকল্পের নাম ‘A House at Nowhere’. |
|
নির্মাণসামগ্রীর বিবরণ : • সমস্ত গাছকে প্রকল্পের জমির মালিক হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। • বিদ্যমান ভূমি গঠন বিবেচনা করে ব্লকগুলি মাটির অগভীরে বিভিন্ন স্তরে স্থাপন করা হয় এবং গ্রেড বিম ফ্রেমে গঠন করা হয়। • ফ্লোরের স্ল্যাব পর্যন্ত কংক্রিট কলামগুলিকে কন্টিনিউ করা হয় এবং এরপর একটি বেসপ্লেট জয়েন্টের সাহায্যে স্টিলের I সেকশনে রূপান্তর করা হয়। এই স্টিলের কাঠামো হালকা ওজনের ইন্ডাস্ট্রিয়াল শীটের ছাদ ধরে রাখে/ ছাদের ওজন নেয়। • বিদ্যমান নিচু জমিতে ভিন্ন গভীরতায় দুটি পুকুরের ডিজাইন করা হয়েছে। একটিতে বিভিন্ন ধরণের মাছ চাষ করা হয় এবং আরেকটি ইন্টারেক্টিভ ঘাট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। • বাংলাদেশের চরম বন্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পুকুরের মাটি, মাঠ ভরাট করতে এবং পূর্ব দিকে একটি বাঁধ তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়। • সবুজ পিগমেন্টেড কংক্রিট, দেওয়াল এবং মেঝেতে বেছে নেওয়া হয় এবং কালো পিগমেন্টেড কংক্রিট, গোলাকার কলামের জন্য বেছে নেওয়া হয়। রঙগুলো বিদ্যমান সারফেসগুলিতে একটি জল রঙের পেইন্টিংয়ের মতো দেখায় এবং চারপাশের সবুজ পরিবেশের সাথে মিশে যায়। • এমন কিছূ উপাদান দ্বারা নির্মাণকাজ সমাপ্ত করা হয়, যা সহজে প্রকৃতির সাথে মিশে যায়। বাইরের বারান্দা, সিঁড়ি সবুজ রঙের পলিশড কংক্রিট দিয়ে ঢালাই করা হয়। রুমগুলো এবং বড় বারান্দাটি আঞ্চলিক মোটিফের সঙ্গে সবুজ কোটা পাথর দিয়ে রেন্ডার করা হয়েছে। সংযুক্ত ওয়াকওয়েগুলো কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি। সমস্ত দরজা এবং জানালা সেগুন কাঠ এবং বিভিন্ন অপারেটিং সিস্টেম সহ বড় গ্লাস দিয়ে তৈরি। |
বিশেষ বৈশিষ্ট্য: • নির্মিত ফর্মগুলো এবং প্রাকৃতিক উপাদানগুলো একীভূত করা - পুকুর, মাঠ, বাঁশের বাগান, ফলের বাগান, ঔষধি গাছ, ভেষজ-সবজি বাগান, গাছের করিডোর, অনসাইট স্থানীয় উদ্ভিদ নার্সারি এবং ঘাট। • পরীক্ষামূলক উপকরণ - পিগমেন্টেড কংক্রিট, মোটিফ এবং হাতে তৈরি কাঠের কোটা স্টোন। • স্বয়ংসম্পূর্ণতা - যান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর নির্ভর না করে বাড়িটির বাসিন্দাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনধারার ব্যবস্থা করে। |
সম্পাদনা : সাদিয়া বিনতে করিম, স্থপতি ফাইজা ফাইরুজ |