‘স্থাপত্য ও নির্মাণ’-এ জিন্দা পার্ক প্রকল্পটির মাস্টারপ্ল্যান এবং এন্ট্রেন্স কোর্ট সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছিল। এ পর্বে, জিন্দা পার্কের আরও দুটি স্থাপনা - প্রাইমারি স্কুল ভবন এবং লাইব্রেরি ভবন সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা দেয়া হলো।
প্রকল্পের তথ্যসমূহ: প্রকল্পের নাম: লিটল এঞ্জেল সেমিনারি স্কুল প্রকল্পের স্থান: জিন্দা পার্ক, পূর্বাচল ক্লায়েন্ট: তবারক হোসেন কুসুম খরচ: ১ কোটি টাকা নির্মিত সময়: ডিসেম্বর, ২০১২ |
ছবি: প্রাইমারি স্কুল ভবনের সামনের দিকের ভিউ |
জিন্দা পার্কের প্রথম নির্মাণ করা ভবনটি হলো এই স্কুল ভবন। স্কুল ভবনটি প্রথমদিকে একটি টিন-শেইড ভবন ছিল। এটি একটি প্রাইমারি স্কুল। স্কুল ভবনটিতে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ানো হয়। হয়। প্রতি ক্লাসে ৫০ জন ছাত্রছাত্রী আছে। সেকেন্ডারি স্কুলের ভবন এবং কলেজ ভবনটি বর্তমানে নির্মাণাধীন অবস্থায় আছে। জিন্দা পার্কের প্রতিটি বিল্ডিং ডিজাইন করা হয়েছে আমাদের চিরাচরিত নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে, তবে একটু ভিন্নভাবে। কিছু কিছু জায়গায় ১৫”দেয়াল আছে, যেখানে প্লাস্টার করা নেই। স্থপতি সায়েদুল হাসান রানা বলেন,আমাদের দেশের আবহাওয়া এবং জলবায়ুর জন্য একমাত্র সমাধান হলো পুরু দেয়াল। কংক্রিট ব্লকের ব্যবহার স্কুল ভবনটি থেকেই শুরু হয়। জিন্দা পার্কের প্রতিটি ভবনের নির্মাণকাজ শুরুর পূর্বে প্রতিটি ভবনের ‘ফিজিক্যাল মডেল’ বানানো হয়েছে, যাতে করে কমিউনিটির মানুষ তাদের মতামত রাখতে পারে। |
ছবি: স্থপতি সায়েদুল হাসান রানার প্রাইমারি স্কুল ভবনের স্কেচ |
ছবি: গ্রাউন্ড ফ্লোর প্ল্যান |
ছবি: ক্লাসরুম | শহুরে পরিবেশ হতে একদমই ভিন্ন, প্রকৃতির ছায়ায় ঘেরা জিন্দা পার্কের প্রতিটি ভবন। স্কুল ভবনটিও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে এ স্কুলের ক্লাসরুমগুলোর ডিজাইনগুলো এমনভাবে করা, যাতে করে ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখার পরিবেশের কোনো ব্যঘাত না ঘটে। নিচতলায় ৪টি ক্লাসরুম এবং অফিস ভবন রয়েছে এবং ফার্স্ট ফ্লোর-এ ৬টি ক্লাসরুম রয়েছে। ক্লাসরুমের ভেতর কোন তীব্র বা অপ্রয়োজনীয় শব্দ প্রবেশ করেনা। চিত্রে প্রদর্শিত ক্লাসরুমের বাইরের দেয়াল এবং জানালাগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, বৃষ্টির সময় ড্রাইভিং রেইন-এর কারণে ক্লাসরুমের ভেতরে বৃষ্টির ছাঁট প্রবেশ করতে পারেনা। |
ছবি: ক্লাসরুমের পাশে ছোট প্রাঙ্গণ |
কিছু কিছু দেয়ালে প্লাস্টার করা নেই, শুধুমাত্র সিমেন্ট দিয়ে পলিশ করা। ফার্স্ট ফ্লোর-এ ক্লাসরুমগুলোর পাশে একটি ছোট প্রাঙ্গণ রয়েছে, যেখানে ছাত্ররা জমায়েত হয়ে তাদের নিজস্ব চিন্তাধারা, মতবিনিময় করতে পারে (চিত্রে প্রদর্শিত)।ফার্স্ট ফ্লোরের মাঝ বরাবর জায়গায় একটি গ্যালারি স্পেস রয়েছে, যা ব্যবহার করা হয় ‘মিটিং স্পেস’ অথবা ‘পারফরম্যান্স স্পেস’ হিসেবে। গ্যালারিটি দুটি ভাগে বিভক্ত – সেমি আউটডোর স্পেস এবং আউটডোর স্পেস। আউটডোর স্পেসটিতে কিছু বসার জায়গা রয়েছে, সেখানে মূলত স্কুল ছুটির সময় অভিভাবকেরা বসে অপেক্ষা করতে পারেন। সেমি আউটডোর স্পেসটি মূলত ‘পারফরম্যান্স স্পেস’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গ্যালারি - এর দুই কর্ণারে দুটি পানি নিষ্কাশন-এর ব্যবস্থা আছে, যার ফলে বৃষ্টির সময় পানি জমে থাকেনা। স্কুল ভবনটির করিডোর-এর শেষ প্রান্তে ছবির ফ্রেমের মতো জানালা বসানো। |
ছবি: প্রাইমারি স্কুল ভবনের দক্ষিণ দিকের এলিভেশন |
ছবি: প্রাইমারি স্কুল ভবনের উত্তর দিকের এলিভেশন |
ছবি: ছেদচিত্র AA |
ছবি: ছেদচিত্র CC |
ছবি: প্রাইমারি স্কুল ভবনের সিঁড়ি |
ছবি: প্রাইমারি স্কুল ভবনের সামনের মাঠ |
ছবি: গ্যালারি স্পেস-এ বসার জায়গা |
প্রাইমারি স্কুল ভবনটির সামনে একটি বড় খেলার মাঠ রয়েছে। স্কুল ভবনটির সামনের পরিকল্পিত ল্যান্ডস্কেপটি পার্কের মালিকের তত্ত্বাবধানে করা। স্কুল ভবনটির নিচতলায়, মাঠের উল্টোপাশে একটি মঞ্চের জায়গা রয়েছে। এতে স্কুলের এসেম্বলি এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।স্কুল ভবনটি নির্মাণের সময় সিঁড়ির জায়গাটিকে প্রাধান্য দেয়া হয়। সিঁড়ির রেলিং এবং স্কুল ভবনের ছাদের রেলিং-এর উচ্চতা ভিন্ন। ছাদের রেলিংটি মূলত বাচ্চাদের হাইট অনুযায়ী ডিজাইন করা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, জিন্দা পার্কের এ স্কুল ভবনটি একটি অনুকরণীয় স্কুল ভবন হতে পারে। এ ভবনটি শুধু শিক্ষার গুণ ও মানের মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই, ছাত্রছাত্রীদের পারস্পরিক ভাব আদান-প্রদান, নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে বেড়ে ওঠা এবং নির্বিঘ্নে পড়ালেখার পরিবেশ পাওয়ার জন্য এ স্কুল ভবনকে একটি আদর্শ স্কুল ভবন বলা যেতে পারে। |
ছবি: স্ক্রিন ওয়াল |
প্রকল্পের তথ্যসমূহ: প্রকল্পের নাম: লাইব্রেরি প্রকল্পের স্থান: জিন্দা পার্ক, পূর্বাচল ক্লায়েন্ট: জিন্দা পার্ক খরচ: ২.৫ কোটি টাকা নির্মিত সময়: ২০১৬ |
ছবি: লাইব্রেরি ভবনের সামনের দিক |
জিন্দা পার্কের লাইব্রেরি ভবনটির সামনে এক ঝাঁক ঝাউ গাছের সারি ভবনটিতে প্রবেশের একটি চমৎকার ভিস্তা দেয়। লাইব্রেরি ভবনটি বাংলাদেশের গতানুগতিক লাইব্রেরির মতো না। এটি জিন্দা পার্ক প্রকল্পটির জন্য একটি কমিউনিটি লাইব্রেরি হিসেবে কাজ করে। |
ছবি: গ্রাউন্ড ফ্লোর প্ল্যান |
ছবি: ফার্স্ট ফ্লোর প্ল্যান |
ছবি: সেকেন্ড ফ্লোর প্ল্যান |
ছবি: থার্ড ফ্লোর প্ল্যান |
ছবি: ফোর্থ ফ্লোর প্ল্যান |
লাইব্রেরির প্রবেশপথটি সমতল হতে কিছু স্টেপ ডাউন করে নামানো। এটি স্থপতি পরিকল্পিতভাবে ডিজাইন করেছেন, যাতে করে বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশটি ওপরের ফ্লোরগুলো থেকে খুব কাছে মনে হয়। এর ফলে, লাইব্রেরি ভবনের ভেতর প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে একটি মনোরম বই পড়ার পরিবেশ তৈরি হয়। জিন্দা পার্কের বৃত্তাকার লাইব্রেরি ভবনটি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রথমত, এ ভবনটি লাইব্রেরির পাশাপাশি একটি ওয়াচ টাওয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এর সবচেয়ে ওপরের ফ্লোর (ফোর্থ ফ্লোর) - এ একটি বৃত্তাকার টেরাস রয়েছে। টেরাস থেকে জিন্দা পার্কের একটি ৩৬০° ভিউ উপভোগ করা যায়। ব্যবহারকারীরা চাইলে এ টেরাসে বসে প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে বই পড়ার আনন্দ পেতে পারে। |
ছবি: রুফ প্ল্যান |
ছবি: স্থপতির হাতে আঁকা স্কেচ |
ছবি: স্থপতির হাতে আঁকা স্কেচ |
ছবি: ছেদচিত্র AA |
ছবি: ছেদচিত্র BB |
লাইব্রেরির ভেতরের সিঁড়িটি একইসাথে গ্যালারি হিসেবেও কাজ করে। ব্যবহারকারীরা এ গ্যালারি স্পেসটিতে বসে বই পড়তে পারেন, গ্রুপ মিটিং কিংবা আড্ডাও দিতে পারেন। ওপরের লাইট সোর্স হতে লাইট পাওয়ার জন্য প্রতিটা ফ্লোর-এর গ্যালারিগুলো সরে গেছে। সবচেয়ে ওপরের ফ্লোর-এ একটি গোলটেবিল রাখা আছে, যেখানে বসে গোলটেবিল বৈঠক করা যেতে পারে। এছাড়াও, পুরো লাইব্রেরি ভবনটিতে ছোট ছোট ইনটিমেট বসার স্পেস রয়েছে, যেখানে বসে স্বাচ্ছন্দ্যে বই পড়ে সময় কাটিয়ে দেয়া যায়। |
ছবি: সিঁড়ি এবং অ্যাম্ফিথিয়েটার |
ছবি: ইন্টেরিয়র স্পেস |
লাইব্রেরির ভবনের ভেতরকার বড় জানালাগুলোর মাঝে বাইরের সবুজ প্রকৃতি দেখে মনে হয় এ যেন কোন আর্টিস্টের আঁকা ছবির ফ্রেম। ভবনটির প্রতিটি জায়গায় সূহ্ম এবং রুচিশীল ডিজাইন মানুষকে লাইব্রেরিতে আরও বেশি সময় কাটাতে বাধ্য করে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এমন লাইব্রেরি বিরল এবং একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। |
ছবি: প্রতিটি ওপেনিং থেকে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা যায় |
ছবি: লাইব্রেরি ভবনের ছাদ |
ছবি: লাইব্রেরি ভবনের ছাদ হতে দৃশ্যমান ভিউ |
'স্থাপত্য ও নির্মাণ' এবং 'নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর' - এর দলের সদস্যরা |
ছবি: দলের সদস্যরা |
সম্পাদনায়: স্থপতি ফাইজা ফাইরুজ |