ছবি: বইয়ের সামনের মলাট |
ছবি: বইয়ের পেছনের মলাট |
সমতটে সংসদ বাংলাদেশের স্থাপত্য সংস্কৃতি, লুই কান ও সংসদ ভবন লেখক: মীর মোবাশ্বের আলী পৃষ্ঠা: ২১৬ পৃষ্ঠা, রঙ্গিন। প্রকাশনাকাল: জুন, ২০০৬ প্রকাশক: জার্নিম্যান বুকস ISBN: 9789849144441
|
মীর মোবাশ্বের আলী |
কাজী আনিস উদ্দিন ইকবাল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক মীর মোবাশ্বের আলী প্রণীত সমতটে সংসদ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। লেখক দেশের একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক, ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তাদের শিক্ষাকালীন ডিজাইন প্রকল্পগুলির একজন সুসমালোচক হিসাবে শ্রদ্ধা পেয়ে থকেন। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র সমাবেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে সূদীর্ঘকাল ধরে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা এবং এই সময়কালে দেশের শিল্প স্থাপত্য এবং সর্বোপরী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অতিক্রান্ত কতগুলি সুস্পষ্ট পর্বের তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। বাংলাদেশের স্থাপত্য ঐতিহ্য সম্মন্ধে আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়ে লেখক এই জনপদের আদিতে চলে গেছেন, সেখান থেকে ধাপে ধাপে বর্তমানের পথে এগিয়ে গেছেন, তার মতে বাঙালী জাতির সত্যিকার উন্মেষ ঘটেছে চৈতন্যদেবের উত্থানের পথ ধরে। প্রত্যেক পর্বে কথকের মত সংক্ষিপ্ত আকারে সমাজ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, স্থাপত্য কীর্তি এবং সেগুলির পটভূমি তুলে ধরেছেন । |
ছবি: সংসদ ভবন |
তার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই কানের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি বাংলাদেশের সংসদ ভবনের উপর নিজস্ব বিশ্লেষণ দাঁড় করানো । বইটির নাম 'সমতটে সংসদ' রেখে তিনি যে একজন বাঙালীর দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখার চেষ্টা করবেন - তা সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। এদেশে পাথর পাওয়া যায় না, তাই অতিপ্রাচীন স্থাপনাগুলি কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, তবে পোড়া ইটের তৈরী বৌদ্ধ বিহারগুলির যেটুকু অবশিষ্ট আছে তা থেকে এই অঞ্চলের অতীত কিছুটা পাঠ করা যায় । লেখকও স্থাপত্যে আমাদের ঐতিহ্য খুঁজতে সেই পাল রাজাদের বা সুলতানী আমলের কীর্তিগুলোকে তুলে ধরেছেন। তিনি স্থাপত্য কলার অধ্যাপক, তাই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে ঐসব স্থাপনার স্থাপতিক বৈশিষ্ট সুচারু রূপে বিশ্লেষণ । বিভিন্ন পর্বকে ভালভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য, তিনি উদাহরণ হিসাবে কোন কোন ভবন বেছে নিয়ে তার বিশ্লেষণ করে যেভাবে ঐ পর্বের সাধারণ বৈশিষ্টগুলি বর্ণনা করেছেন, তাতে যথেষ্ট মুন্সীয়ানা আছে । |
ইতিহাস পর্যালোচনায় লিখিত ঐতিহাসিক তথ্যের পাশাপাশি তার নিজস্ব মতামত তিনি অনেকটা ইতিহাসের মত করেই উপস্থাপন করেছেন, যা হয়ত আরও অনেক প্রামান্য দলীল ভিত্তিক হওয়ার দাবী রাখে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকাল তিনি সংকীর্ণ বিদ্রোহী দৃষ্টিতে না দেখে, দেখেছেন বাস্তবতার নিরীখে, খোঁজ করার চেষ্টা করেছেন তাদের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য । তার দৃষ্টিতে বৃটিশদের কৃতিত্ত্বের পাল্লাই ভারী । সংসদ ভবনের আলোচনায় তিনি এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের পটভূমি তুলে ধরেছেন খুবই বিশদভাবে, যা নতুন প্রজন্মের কাছে জানাই ছিল না। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের প্রারম্ভে মুসলমানদের ক্ষমতার দাপট দেখানোর জন্য নির্মিত হয়েছিল কুতুব মিনার, আজও তা দাঁড়িয়ে আছে, মুসলমানরা ক্ষমতায় নেই. স্বাধীন ভারত কিন্তু সেই মিনার ভেঙে ফেলেনি বরং উৎসাহের সাথে রক্ষণাবেক্ষণ করছে, পর্যটকদের আকর্ষণ করছে এবং প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে । আমাদের সংসদ ভবনও আমাদের জন্য অর্থকরী হতে পারে, সেই ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেন । পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান, নিজের নামে দেশের দ্বিতীয় রাজধানী হিসাবে এই প্রকল্পটির উদ্যোগ নেন এবং স্থপতি নির্বাচিত হন তৎকালিন বিশ্বের নাম করা মার্কিন স্থপতি লুই আই কান। এই কাজটির দায়িত্ব নেবার এবং কাজ করার সময়ের অনেক অজানা কাহিনী তার লেখায় সন্নিবেশিত হয়েছে। তার গ্রন্থনায় কানের প্রতি একটা নির্মোহ ভাব রয়েছে, যা আজকাল আমাদের স্থপতিদের মাঝে অনেকটা ফ্যাশনের মত । তবে কানকে তিনি স্থপতি হিসাবে খাটো করেন নি, বরং তাকে দার্শনীক এবং স্থাপত্য ক্ষেত্রে যুগস্রষ্টা হিসাবে মর্যাদা দিয়েছেন। প্রশ্ন বিদ্ধ করেছেন শাসক এবং তাদের চামচাদের, এতব্যয় বহুল একটি কাজ তারা কেন করতে গেলেন? সংসদ ভবনের আলোচনায় বার বার মসজিদ প্রসঙ্গটি এসেছে, এর মধ্য দিয়ে তিনি একটি আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণও দাঁড় করিয়েছেন, যা হয়ত দেশের স্থপতিদের মাঝে পর্যালোচনার খোরাক যোগাবে। সংসদ ভবনে বসে সাংসদরা আইন প্রণয়ন করবেন, সংসদ ভবন তাই দেশের গণতান্ত্রিকতার প্রতিচ্ছবি, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এর সাফল্য নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন জোরালোভাবেই, পাশাপাশি স্থাপত্য কীর্তি হিসাবে এই ভবনটির মর্যাদা সারা বিশ্বে কোন পর্যায়ের তা জানাতে ভূল করেননি । বইটির প্রচ্ছদে সংসদভবনের আনুভূমিক রেখাগুলি একটা আমেজ সৃষ্টি করলেও প্রচ্ছদটি নিতান্ত মামুলী। সম্পূর্ণ বইটিতে লেখকের চমৎকার সচ্ছনুভাষার ব্যবহার যে কোন প্রতিষ্ঠিত লেখকেরই ইর্ষার বিষয় হতে পারে। বইটির অক্ষর বড়, তাতে কলেবর বেড়েছে, তবে সকলের জন্য পড়তে সুবিধা হবে। বেশকিছু মূল্যবান ছবি এবং ড্রইং সংযোজিত হয়েছে তবে বইয়ের গ্রাফিক্স-এর ক্ষেত্রে সার্বিক পরিকল্পনার দূর্বলতা সুস্পষ্ট। সবশেষে আকস্মিকভাবে দেশের সাম্প্রতিক কালের কিছু ভবনের ছবি ও বর্ণনা তিনি কেন জুড়ে দিলেন তা বোধগম্য নয়, এতে বইটির মূল ধারাটি অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থাপত্য কলা নিয়ে বাংলা ভাষায় লেখালেখি খুবই কম এবং যারা লিখবার মত জ্ঞানের অধিকারী তাদের অনীহাও প্রবল । এই প্রতিকুল সময়ে অধ্যাপক মীর মোবাশ্বের আলীর সমতটে সংসদ বইটি বাংলা ভাষায় স্থাপত্য বিষয়ক আলোচনার একটি দিগন্ত উন্মোচিত করেছে, সেজন্য তাকে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা। |